Skip to main content

বাংলা গদ্য সাহিত্যের ইতিহাসে সবুজপত্রের ভূমিকা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ- আলোচনা করো।

বাংলা গদ্য সাহিত্যের ইতিহাসে সবুজপত্রের ভূমিকা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ- আলোচনা করো।

        আমরা জানি ১৯১৪ সালে তৎকালীন বাংলাদেশে যে পত্রিকাটি ভূমিষ্ঠ হয়েছিল সেটি হলো সবুজপত্র ।যার প্রচ্ছদ ছিল সম্পূর্ণ সবুজ। আর এই পত্রিকাটি বাংলা তথা ভারতবর্ষ শুধু নয়, সমগ্র বিশ্বের ইতিহাসেই এক গভীর সংকটকালের মধ্যে আবির্ভাব হয়। ইউরােপের অতৃপ্ত জাতীয়তাবাদী দেশগুলি নিজ নিজ অস্তিত্বরক্ষার তাগিদেই ক্রমশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিতে পরিণত হয়ে উঠেছিল। আর ঠিক তখন -

         পুঁজি ও বাজার সংগ্রহের অশুভ প্রতিযােগিতা ক্রমশ ইউরােপীয় দেশগুলিকে ঠেলে দিল মানব-সভ্যতার চরম বিপর্যয়ের মুখে । প্রথম মহাযুদ্ধের দিকে। প্রত্যক্ষভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা ঘটে ১৯১৪-র জুলাইতে। এই যুদ্ধে ইংল্যাণ্ড অতর্কিত ভাবে জড়িয়ে পড়ে । স্বভাবতই প্রত্যক্ষভাবে না হলেও ইংল্যাণ্ডের উপনিবেশ ভারতীয় উপমহাদেশের অর্থনীতি রাজনীতি-সংস্কৃতিতে ছড়িয়ে পড়ে মহাযুদ্ধের অশুভ কালাে ছায়া। তবে--

         রবীন্দ্রনাথ এর আগেই ইউরােপ-আমেরিকা ভ্রমণকালে‘গীতাঞ্জলী’র বাণী ও ভারতীয় অধ্যাত্মবাদের বার্তা পৌছে দিয়ে এসেছেন। ১৯১8-তেই ইউরােপ-ভ্রমণ সেরে এসে রবীন্দ্রনাথের আশাবাদী কল্যাণবাদী মন যুদ্ধের মধ্যেই প্রত্যাশা করেছিলেন শুভ-প্রভাতের সম্ভাবনা। যুদ্ধ তার কাছে জড়তা ও অশুভ অন্ধকার থেকে মুক্তির বার্তা নিয়ে এসেছিল। 'সবুজপত্রে'র আবির্ভাব লগ্নটি জানতে হলে এই আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিতটি অবশ্যই স্মরণ করতেই হবে।

               আমরা জানি বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে এক নতুন পর্বের সূচনা ঘটে 'সবুজপত্র'র আবির্ভাবে। তবে প্রকাশের আকাঙ্ক্ষা প্রমথ চৌধুরীর ছিল না। সম্পূর্ণ পরিশীলিত, রুচিশীল বিদগ্ধ নাগরিক মন নিয়ে তিনি চেয়েছিলেন স্বভাবে-চরিত্রে-আচরণে-ভাষায় এক যুক্তিঋদ্ধ ঋজুতা ও মেদহীন ব্যক্তিত্বের দীপ্তি। তার এই জীবনদৃষ্টিই তাঁকে সাহিত্যক্ষেত্রে নতুন পথের সন্ধান দিয়েছিল । আসলে সাহিত্য চিস্তায় ও ভাযাচর্চায় সকল প্রকার ভাবালুতা, অস্পষ্টতা, অত্যুক্তি, বিশেষণ বাহুল্য, ক্রিয়াপদের একঘেয়েমি সমূলে উচ্ছেদ করতে চেয়েছিলেন প্রমথ চৌধুরী।

            ‘সবুজপত্রে'র মাধ্যমে শুধু নিজ সাহিত্যচর্চায় নয়, ‘সবুজপত্রে'র সমস্ত লেখক গােষ্ঠীর চর্চার মধ্যেই প্রথম চৌধুরী সঞ্চারিত করতে চেয়েছিলেন যুক্ত, প্রসাদগুণ ও দৃঢ় প্রকৃতিস্থতা, মার্জিত রসিকতা, পরিশীলিত নাগরিক রুচি ও সংস্কৃতিবােধ। প্রমথ চৌধুরী কৃয়নগরের নাগরিক হলেও বস্তুত ছিলেন বিদ্যানগরের নাগরিক। বিশ্বের বিদ্যা তাঁর চেতনায় সংহত হতে পেরেছিল।আর সেকারনেই  রবীন্দ্রনাথ এই পত্রিকা সম্বন্ধে অপরিসীম শ্রদ্ধাশীল ছিলেন।

                সবুজপত্রের ' পূর্ববর্তী লেখক গােষ্ঠীর মধ্যে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, সুরেশ সমাজপতি, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রভৃতি লেখকবৃন্দের মধ্যেও প্রগাঢ় মননশীলতা ছিল। কিন্তু তাদের সাধনার লক্ষ্য ছিল দেশ-কাল-সমাজ। ছিল তাদের দৃষ্টি  কল্যাণমুখী, দেশীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। 'সবুজপত্রে'র লেখকগােষ্ঠীর মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্নতর। তাদের লক্ষ্য ছিল বিশ্বনাগরিকতা, বৈদগ্ধমার্জিত বুদ্ধির উদ্বোধন।

               সবুজপত্রে'র লেখকগােষ্ঠীর মধ্যে অন্যতম ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর । ছিলেন অতুলচন্দ্র গুপ্ত, কিরণশংকর রায়, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখােপাধ্যায়, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ ব্যক্তিত্ব।বিশুদ্ধ জ্ঞানচর্চার তাগিদেই সবুজপত্রের মজলিশে বের্গস, ফ্রয়েড, রাসেল, অ্যাডলার, ক্রোচে প্রভৃতির চর্চা চলত। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান- দর্শন-সাহিত্য চর্চার ফলে এই মজলিশটি হয়ে উঠেছিল আধুনিক সাহিত্যিক মনের বৃহৎ রসায়নাগার।

              'সবুজপত্র' ভাষার ক্ষেত্রে যে নতুন আন্দোলন উপস্থিত হয়েছিল তা হল চলিত ভাষার একচ্ছত্র অধিকার। অবশ্য এই চলিত গদ্য আদৌও পূর্ববর্তী প্যাঁরীচাদ বা কালীপ্রসন্নের ককনি বুলি নয়। অমার্জিত কথ্যবুলিকে প্রমথ চৌধুরী গ্রহণ করেননি। তার চলিত ভাষাও ছিল মার্জিত পরিশীলিত বিদগ্ধ মনের প্রতিফলন। 

           প্রমথ চৌধুরী তথা 'সবুজপত্রে'র এই চলিত ভাষারীতির অবাহনকে রবীন্দ্রনাথ অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছিলেন। তাই সবুজপত্রে র পৃষ্ঠায় রবীন্দ্রনাথের যে দুটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল, তার ভাষা ছিল চলিত রীতি অনুসারী। 'ঘরেবাইরে' এবং 'চার অধ্যায়' সবুজপত্রেই প্রকাশিত হয়েছিল। 'সবুজপত্রে'র সর্বাপেক্ষা বড়াে কৃতিত্ব এই যে চরিত্রধর্ম ও ভাষারীতির দিক থেকে এই পত্রিকাটি রবীন্দ্রনাথকেও প্রভাবিত করতে পেরেছিল। 'সবুজপত্র' প্রকাশের পর এই পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হয়ে রবীন্দ্রনাথ আর সাধুগদ্য লেখেননি।

                 আসলে 'সবুজপত্রে'র নবসাহিত্য আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্রে ছিল যৌবনের শক্তি। যৌবনের প্রাণধর্মই ছিল ‘সবুজপত্রে'র চালিকাশক্তি। পত্রিকার প্রথম সংখ্যাতেই রবীন্দ্রনাথ 'সবুজের অভিযান' কবিতায় এই যৌবনশক্তিকে আবাহন জানিয়েছিলেন। ফলে সবদিক থেকেই প্রমথ চৌধুরীর 'সবুজপত্র' ছিল বাংলা সাময়িক পত্রের ইতিহাসে এক স্বতন্ত্র ধারার প্রবর্তক এবং যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

Comments

Popular posts from this blog

জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে বুদ্ধিবাদ বা প্রজ্ঞাবাদ(Rationalism)আলোচনা করো। (For BA. Second Semester & Higher Secondary Course)

 জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে বুদ্ধিবাদ বা প্রজ্ঞাবাদ(Rationalism)আলোচনা করো। (For BA. Second Semester & Higher Secondary Course) ভুমিকাঃ আমরা জানি জ্ঞানের উৎপত্তি বা উৎস নিয়ে পাশ্চাত্য দর্শনে দুটি উল্লেখযোগ্য পরস্পর বিরোধী মতবাদ দেখা যায়। আর এই দুটি পরস্পর বিরোধী মতবাদের মধ্যে একটি অন্যতম মতবাদ হলো বুদ্ধিবাদ বা প্রজ্ঞাবাদ। আর সেই বুদ্ধিবাদ অনুসারে-        আমরা জানি পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসে বুদ্ধিবাদের প্রধান প্রবক্তা হলেন দার্শনিক ডেকার্ট। আর এই দার্শনিক ডেকার্টকে আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শনের জনক বলা হয়। তবে তার পরবর্তী বুদ্ধিবাদী দার্শনিক হিসেবে স্পিনোজা, লাইবনিজ এবং কান্ট বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। সেখানে জ্ঞান উৎপত্তিতে-- ডেকার্ট এর অভিমতঃ            দার্শনিক ডেকার্ট এর মতে দর্শনচিন্তার প্রথম সূত্র হলো সংশয় বা সন্দেহ। আর এই সংশয় নিয়েই দর্শন আলোচনা শুরু হয় এবং সুশৃংখল সংশয়-পদ্ধতির মাধ্যমে সংসায়াতীত, স্বতঃপ্রমাণিত ও সার্বিক মূল সত্যে পৌঁছানো যাবে। এই মূল সত্য থেকে গাণিতিক অবরোহ পদ্ধতিতে সিদ্ধান্ত পাওয়া যাবে এবং তা অবশ্যই নির্মূল ও নির্ভরযোগ্য হবে। আর গণিতের অভ্রান্ততা এবং নিশ্চয়তাকে

ব্যাপ্তি কাকে বলে? ব্যাপ্তি কয় প্রকার ও কি কি? ব্যাপ্তিজ্ঞান লাভের উপায়/ব্যাপ্তিগ্রহের উপায় গুলি আলোচনা

 ব্যাপ্তি কাকে বলে? ব্যাপ্তি কয় প্রকার ও কি কি? ব্যাপ্তিজ্ঞান লাভের উপায়/ব্যাপ্তিগ্রহের উপায় গুলি আলোচনা করো। ব্যাপ্তি:- ন্যায় দর্শনমতে ব্যাপ্তি জ্ঞান হলো অনুমিতির অপরিহার্য শর্ত। ব্যাপ্তিজ্ঞান ব্যতীত অনুমিতির জ্ঞান লাভ সম্ভব নয়। সুতরাং আমরা বলতে পারি, যেখানেই ধূম সেখানেই বহ্নি। এই সাহচর্য নিয়ম হলো ব্যাপ্তি।                 এখানে সাহচর্য কথাটির অর্থ হলো সমনাধিকরণ। অর্থাৎ যেখানে যেখানে ধূম থাকবে সেখানে সেখানে বহ্নি থাকবে। আর নিয়ম কথাটির অর্থ হলো নিয়ত বা ব্যতিক্রমহীনতা। সুতরাং সাহচর্য নিয়ম কথাটির মানে হল ব্যতিক্রমহীন সাহচর্য। আর সেখানে ধুম ও বহ্নির অর্থাৎ হেতু ও সাধ্যের সাহচর্য নিয়মই হল ব্যাপ্তি।    ব্যাপ্তি দুই প্রকার।         ১) সমব্যাপ্তি           ২) বিষমব্যাপ্তি। ১। সমব্যাপ্তিঃ               সমব্যাপক দুটি পদের ব্যাপ্তিকে সমব্যাপ্তি বলা হয়। এখানে ব্যাপক ও ব্যাপ্য-র বিস্তৃতি সমান হয়। যেমন, যার উৎপত্তি আছে, তার বিনাশ আছে। উৎপত্তি হওয়া বস্তু ও বিনাশ হওয়া বস্তুর বিস্তৃতি সমান। উৎপত্তিশীল ও বিনাশশীল সমব্যাপ্তি বিশিষ্ট। ২। বিষমব্যাপ্তি/অসমব্যাপ্তি :-             অসমব্যাপক দুটির প

তৃতীয় সেমিস্টার ইতিহাস ছোট প্রশ্নোত্তর।

 ১) কুতুবউদ্দিন আইবক কে ছিলেন? উত্তর-কুতুবউদ্দিন আইবক গজনীর সুলতান মহম্মদ ঘুরির দাস ও সেনাপতি ছিলেন। তিনি দিল্লীর প্রথম তুর্কি সুলতান ছিলেন। তাঁর শাসনের শুরুর সাথে ভারতের এক নতুন যুগের সূচনা হয়। ২) নব্য মুসলমান কারা ছিলেন? কে তাদের দমন করেছিলেন? উত্তর - জালাল উদ্দিন ফিরোজ খিলজির আমলে হলান্ড বা আব্দুল্লা খানের নেতৃত্বে মোঘল আক্রমণ সংঘটিত হয় । তার আক্রমণ জালাল উদ্দিন কর্তৃক প্রতিহত হয় । সেই সময় কিছু বন্দি মঙ্গল জালাল উদ্দিনের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে । ধর্মান্তরিত হতে হবে এই শর্তে জালাল উদ্দিন তাদের আবেদনের সাড়া দেন। তারা এতে সম্মত হয় ।এই ধর্মান্তরিত মোঙ্গলেরা নব্য মুসলমান নামে পরিচিত। নব্য মুসলমানরা আলাউদ্দিনকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করলে সেই আলাউদ্দিন এর আদেশে একদিনে ৩০ হাজার নব্য মুসলমানকে হত্যা করে অর্থাৎ আলাউদ্দিন নব্য মুসলমানদের দমন করে। ৩) মালিক কাফুর দ্বারা বিজিত দাক্ষিণাত্যের দুটি রাজ্যের নাম করো। উত্তর - মালিক কাফুর ছিলেন সুলতান আলাউদ্দিনের একজন দক্ষ সেনাপতি । তাঁর দ্বারা দক্ষিণ ভারতের বিজিত রাজ্য দুটি হল দেবগিরি এবং বরঙ্গল। ৪) পাইবস ও সিজদা কি? উত্তর - পাইবস হল সম্রাটের প