Skip to main content

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের পরিচয় দাও । অথবা শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের কাব্য কাহিনী সংক্ষেপে লেখো।

 শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের পরিচয় দাও। অথবা শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের কাহিনীটি সংক্ষেপে লেখো।   

               আলোচনার শুরুতেই আমরা বলতে পারি যে, মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হল 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'। আর এই শ্রীকৃষ্ণকীর্তন পুঁথিটি ১৯১৬ (১৩১৬ বঙ্গাব্দ) খ্রিস্টাব্দে বসন্ত রঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ বাঁকুড়া জেলার কামিল্যা গ্রাম থেকে আবিষ্কার করেন। গ্রন্থটি আবিষ্কারের পর থেকেই বাংলা সাহিত্যের দেখা দেয় কাব্যটিকে নিয়ে নানান সমস্যা ও বিতর্ক। বিতর্ক যাইই থাকুক কেন,১৩২৩ বঙ্গাব্দে বসন্ত রঞ্জনের সম্পাদনায় গ্রন্থটি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে প্রকাশিত হয়। তবে-- 

           এখানে উল্লেখ্য যে, পুঁথিটির মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য চিরকুট পাওয়া যায় । আর সেই চিরকুট লেখা ছিল শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ এই নামটি। কিন্তু এই শ্রীকৃষ্ণকীর্তন নামটি এতটাই জনপ্রিয় এবং প্রচলিত হয়ে যায় যে এই শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ নামটি কোন এক অজানা অন্তরালে হারিয়ে যায়। কেবলমাত্র শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ক্ষেত্রে নয়, মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যে আসল নাম হারিয়ে যাওয়ার অনেক ঘটনা এর আগেও দেখা গেছে। যেখানে--

                আমরা জানি যে চন্ডীদাসের পদাবলী বাংলায় দীর্ঘকাল ধরেই প্রচলিত। শুধুমাত্র প্রচলিত নয়, এই পদাবলীর অপূর্ব সুন্দর সুরমাধুরী বাংলার আকাশ বাতাসকে মাতোয়ারা করে তুলেছিল। তা সত্ত্বেও শ্রীকৃষ্ণকীর্তন পুঁথিটি আবিষ্কার হওয়ার পর চন্ডীদাস নাম নিয়ে বাংলা পদাবলী সাহিত্যে প্রবল বিতর্কের সৃষ্টি হয়। আর সেই বিতর্কটি 'চন্ডীদাস সমস্যা' নামে আজও বাংলা সাহিত্যে প্রচলিত। যেখানে বসন্ত রঞ্জন যে পুঁথিটি আবিষ্কৃত করেছিলেন তার বিষয়বস্তু রাধাকৃষ্ণ প্রেমলীলা হলেও এর মধ্যে পদাবলীর কোন বৈশিষ্ট্য বা ধর্ম নেই।তাই পুঁথিটির বিষয়বস্তুর উপর বিবেচনা করে কাব্যটির নামকরণ করা হয় 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'। অতঃপর-

              বাংলা সাহিত্যে চন্ডীদাসের সমস্যা প্রবল হয়ে ওঠে।তবে বসন্ত রঞ্জন আবিষ্কৃত পুঁথিটির বিষয়বস্তু রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা হলেও এর মধ্যে পদাবলীর বৈশিষ্ট্য বা ধর্ম নেই। আসলে এই পুঁথিটি নাটপালাধর্মী।তাই পুঁথিটির বিষয় বস্তু অনুযায়ী নামকরণ হয় 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'। কিন্তু--

                শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যটি আবিষ্কৃত হওয়ার পর থেকেই চন্ডীদাসকে নিয়ে বাংলা সাহিত্যে বিরাট সমস্যার সৃষ্টি হয়। কারণ পুঁথিটির ভাষা ও প্রকাশভঙ্গির মধ্যে পদাবলীর ভাষা ও প্রকাশভঙ্গি বেশ পার্থক্য আছে। তাই অধিকাংশই পন্ডিত মনে করেন চন্ডীদাস দুজন ছিলেন।তার মধ্যে একজন চৈতন্য পূর্ব বড়ু চণ্ডীদাস এবং অপরজন পদাবলীর চন্ডীদাস। যেখানে স্বয়ং চৈতন্যদেব সম্ভবত বড়ু চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের কাব্য রস আস্বাদন করতেন। আর তার বিবরণ আছে চৈতন্য ভাগবত গ্রন্থে-

     "বিদ্যাপতি চন্ডীদাস শ্রীগীতগোবিন্দ।

     এই তিন গীত করয়ে প্রভুর আনন্দ।।"

              আমরা জানি শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যটি ১২ টি খন্ডে এবং১টি পর্বে বিভক্ত। আর সেই খন্ড গুলি হল- জন্মখন্ড' তাম্বুলখন্ড,  দানখন্ড, নৌকাখন্ড, ভারখণ্ড, ছত্রখন্ড, বৃন্দাবনখন্ড, কালিয়াদমনখন্ড, যমুনাখন্ড, হারখন্ড, বাণখন্ড,বংশীখন্ড, এবং রাধাবিরহ। কৃষ্ণের জন্ম থেকে রাধা বড়াই এর মুখে কৃষ্ণ কথা শুনে অতি ক্ষুব্ধ হয়েছেন। শুধু তাই নয়, কৃষ্ণের পাঠানো ফুল তাম্বুলাদি রাধা প্রত্যাখ্যান করে কৃষ্ণকে অপমান করেছেন। কারণ-- 

          রাধার মতে কৃষ্ণ একটি সামান্য রাখাল বালক। আর সেই বালকের প্রেম গ্রহণ করার তাঁর পক্ষে কোন মতেই সম্ভব নয়। তখনও রাধার মনে আছে তৎকালীন সামাজিক সংস্কার।পাশাপাশি রাধা মনে করেন তাঁর সুন্দর স্বামী ঘরে থাকতে কেন তিনি কৃষ্ণ ভজন করবেন। তাই এখানে রাধাকে বলতে শুনি---

        "ঘরের স্বামী মোর   সর্বাঙ্গে সুন্দর

                    আছে সুলক্ষণ দেহা।

       নান্দের নন্দন    গরু রাখোয়াল

                   তা সমে কি মোর নেহা।।"


           রাধা নানাভাবে কৃষ্ণের বাসনাকে, কামনাকে প্রবলভাবে প্রতিহত করার চেষ্টা করেছেন। আর কৃষ্ণকে প্রতিহত করার জন্য রাধা কখনো কংসের ভয় দেখিয়েছেন, আবার কখনও সামাজিক সম্পর্কের দোহাই দিয়েছেন।তবে--

           রাধা কৃষ্ণকে যতই ভয় দেখাক না কেন তাঁর সকল প্রচেষ্টা অবশেষে ব্যর্থ হয়। আর এখানে আমরা দেখি যে,কৃষ্ণ জোর করে রাধার দেহ ভোগ করে সুখ লাভ করেছেন।বিশেষ করে নৌকাখন্ডে কৃষ্ণের সঙ্গে মিলন কালে রাধার মনে প্রথম প্রেম সঞ্চার হয়েছে। শুধু তাই নয়, কৃষ্ণের সাথে মিলনে রাধা এক অপার সুখ পেয়েছে। তাই আজ কৃষ্ণের যাবতীয় অত্যাচার তার কাছে অত্যাচার বলে মনে হয়নি। পাশাপাশি ভারখন্ডে ও ছত্রখন্ডে রাধার প্রেম চেতনার বিকাশ ঘটে, আর সেই প্রেম চেতনা বৃন্দাবনখন্ডে এসে আরও গভীরতর হয়। সেখানে কালিয়াদমন খন্ডে আমরা দেখি, রাধা আজ সকলের সামনে কৃষ্ণকে পরানপতি রুপে ঘোষণা করেছেন। ঠিক এরপরেই রাধাকে বলতে শুনি 

             "কি করিব ধনজন জীবন ঘরে। 

              কাহ্ন তোক্ষা বিণি সব নিফল মোরে।।"

              বংশীখন্ডে আমরা আরও দেখতে পাই যে, রাধার প্রেমের চরম পরিণতির কাহিনী। এখানে রাধার মধ্যে ফুটে উঠেছে বিরহ জনিত ব্যাকুলতা। যেখানে কৃষ্ণের বাঁশির সুরে রাধা আজ উদাসীন হয়ে পড়েন। তবে এখানেও রাধাকে বলতে শুনি--

             "আকুল শরীর মন বেআকুল মন।

             বাঁশির শবদেঁ আউলাইলোঁ রান্ধন।।"


             পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের রাধাবিরহ অংশে রাধার জীবনের চরম ব্যাকুলতা অশ্রু শায়রে শতদল হয়ে ফুটে উঠেছে। তবে বংশীখন্ড থেকে রাধার মনে শুরু হয়েছে সৃজনকল্পনা। আর সেই কল্পনার অভিমুখ ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় গভীর প্রেম সাগরে। যে রাধা একদিন এই কৃষ্ণকে অপমান করেছিল সেই রাধা আজ কৃষ্ণ বিরহে বিরোহিনী।

         

Comments

Popular posts from this blog

দর্শন প্রথম সেমিস্টার সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তর।

দর্শন প্রথম সেমিস্টার সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, মাইনর সিলেবাস)  ১)চার্বাক মতে ভূত কয়টি ও কি কি? উত্তরঃচার্বাক মতে ভূত চারটি- ক্ষিতি, অপ্ , তেজ ও মরুৎ ২) স্বভাববাদ কী? উত্তরঃ চার্বাক জড়বাদের ভিত্তি হল স্বভাববাদ। যে মতবাদ অনুসারে স্বভাব থেকেই ভূত সৃষ্টি, আবার স্বভাব থেকেই বিচ্ছেদ। যার জন্য ঈশ্বরকে স্বীকার করা প্রয়োজন নেই। ৩) অব্যাপ্যদেশ কথাটির অর্থ লেখো। উত্তরঃ অব্যাপ্যদেশ বলতে বোঝায়- অশাব্দ অর্থাৎ যাকে শব্দের দ্বারা প্রকাশ করা যায় না। ৫) জ্ঞান লক্ষণ প্রত্যক্ষ কাকে বলে?  কোন একটি ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে তার নিজের বিষয়ীভূত গুণ ছাড়াও যদি অপর একটি ইন্দ্রিয়ের বিষয়ীভূত গুণকে প্রত্যক্ষ করার হয়, তাহলে সেই প্রত্যক্ষকে জ্ঞানলক্ষণ প্রত্যক্ষ বলা হয়। ৬) ন্যায় মতে প্রমাণের প্রকার  উত্তরঃ ন্যায় মতে প্রমাণ চার প্রকার। প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান এবং শাব্দ। ৭) সন্নিকর্ষ কাকে বলে? উত্তরঃ ন্যায় মতে ইন্দ্রিয় ও কোন বাস্তব পদার্থের মধ্যে একপ্রকার বিশেষ সম্পর্ক ঘটলে তবেই আমাদের একটি বস্তুর প্রত্যক্ষজ্ঞান ।আর ঐ বিশেষ বিশেষ সম্পর্কের পারিভাষিক নাম হলো সন...

ব্রিটিশ(3rd.Sem) পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব

ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব(পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় তৃতীয় সেমিস্টার রাষ্ট্রবিজ্ঞান মাইনর সিলেবাস)। ব্রিটেনের সংবিধান অলিখিত বলে বিভিন্ন ঐতিহাসিক দলিল, শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতি, পার্লামেন্ট প্রণীত আইন প্রভৃতির মাধ্যমে পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব অর্জিত হয়েছে। ব্রিটেনের পার্লামেন্ট আইনানুগ সার্বভৌমত্ব অর্জন করেছে, রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব নয়। আর সেখানে আইনানুগ সার্বভৌমত্ব বলা হয়, কারণ-       যেকোনো বিষয়ে পার্লামেন্ট আইন প্রণনয়নের অধিকারী। এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র হওয়ায় পার্লামেন্টে কোন আইন প্রণয়নের সময় প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় না। কমন্সসভা তথা নিম্নকক্ষের সার্বভৌমত্বকেই বলা হয় পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব।     ••ব্রিটিশ পার্লামেন্টকে সার্বভৌমত্ব বলার কারণ- ১) পার্লামেন্টের ওপর আইনগত কোনরূপ বাধানিষেধ আরোপ করা যায় না। ২) পার্লামেন্ট প্রণীত আইনের বৈধতার ব্যাপারে আদালত কোন প্রশ্ন তুলতে পারেনা। ব্রিটেনের আদালত পার্লামেন্ট প্রণীত আইনের ওপর বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার দ্বারা সীমিত করতে পারে না। ৩) ব্রিটিশ পার্লামেন্টের আইন প্রণয়ন ক্ষমতার উপর শাসনবিভাগ অনুরূপ ন...

ইতিহাস (3rd Semester) সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর।

 তৃতীয় সেমিস্টার ইতিহাস মাইনর সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, তৃতীয় সেমিস্টার ইতিহাস মাইনর)। ১)বন্দেগান-ই-চাহালগানি বলতে কী বোঝায়? •উত্তরঃবন্দেগান-ই-চাহালগান বলতে চল্লিশ জন তুর্কি ও অ-তুর্কি দাসদের সমন্বয়ে গঠিত একটি বাহিনীকে বোঝায়। এই বাহিনীকে ডাল চালিশা বা তুরকান-ই- চাহালগানি নামে ডাকা হতো। ২)আমির খসরু কে ছিলেন? •উত্তরঃ আমির খসরু ছিলেন প্রখ্যাত সুফি সাধক বা আরেফ নিজামউদ্দিন আওলিয়ার ছাত্র এবং অন্যতম প্রধান খলিফা। যাঁকে 'ভারতের তোতা' উপাধি দেওয়া হয়েছিল। ৩) মহরানা প্রতাপ কে ছিলেন?  •উত্তরঃ মেবারের শিশোদিয়া রাজবংশের একজন হিন্দু রাজপুত রাজা ছিলেন মহারানা প্রতাপ সিং। যিনি রাজপুতদের বীরত্ব ও দৃঢ় সংকল্পের প্রতীক। বহু বছর ধরে তিনি মুঘল সম্রাট আকবরের সঙ্গে লড়াই করেন। ৪) জায়গীরদারী সংকট কী? •উত্তরঃ জায়গিরদারী সংকট ছিল মোগল সাম্রাজ্যের একটি অর্থনৈতিক সংকট। এই সংকটে জমি বা জায়গিরের অভাব দেখা দিয়েছিল। যার ফলে প্রশাসনিক খরচ মেটানো এবং যুদ্ধের খরচ বহন করা সম্ভব হতো না। ৫) দাক্ষিণাত্য ক্ষত কী? •উত্তরঃ দাক্ষিণাত্য ক্ষত বলতে ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীত...