Skip to main content

উনিশ শতকের কাব্য রচনায় রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় এর কবি কৃতিত্ব লেখো।

 উনবিংশ শতকের মধ্যভাগে বাংলা কাব্য জগতে ঈশ্বর গুপ্ত ও মধুসূদনের মধ্যে যার আবির্ভাব হয়েছিল তিনি হলেন কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। যিনি কবি ঈশ্বর গুপ্তের 'সংবাদ প্রভাকার' পত্রিকায় প্রথম আত্মপ্রকাশ করেন কবি হিসেবে। ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আবদ্ধ বাংলা কাব্যে ঐতিহাসিক কাব্যের সূত্রপাত করলেন । তাই সুকুমার সেন বলেন-

        "ইংরেজি কাহিনী কাব্যের রোমান্স রসের যোগান দিয়া রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় নবযুগের দিকে বাংলা সাহিত্যের মুখ ফিরাইলেন।"

                   ঈশ্বর গুপ্তের শিষ্য রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম জীবনের কবি গানের বাঁধনদার হয়েও পাশ্চাত্য শিক্ষা ও ভাবধারায় ধাবিত হয়ে আধুনিক বাংলা কাব্যে নতুন সুরের প্রবর্তন করেন। বাংলা কাব্যের পুরাতন রীতি তিনি অনুসরণ করেছিলেন ঠিকই কিন্তু ঐতিহাসিক কাহিনী মধ্যে দিয়ে স্বদেশ প্রেমের আবেগকে তিনি বাংলা কাব্যের সঞ্চার করে দিলেন। তাঁর কাব্য রচনা মূল প্রেরণা দেশাত্মবোধ। উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে পরাধীনতার গ্লানিকে কেন্দ্র করে যে দেশাত্মবোধের উদ্বোধন ঘটে রঙ্গলাল সেই যুগধর্মকে তাঁর কাব্যে রূপ দিয়েছেন। শুধু তাই নয় স্বদেশপ্রেম ও ইতিহাসের পটভূমিকায় বীররসকে কেন্দ্র করে বাংলা কাব্যে আনলেন মানব চেতনা। অতঃপর তাঁর নিজের সম্পাদনা 'সংবাদ রসসাগর' প্রকাশ করেন ।এছাড়াও তিনি ঈশ্বর গুপ্তের সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় নিয়মিত লেখক ছিলেন।

                   রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কাব্য "পদ্মিনী উপাখ্যান"। এই আখ্যান কাব্যের বিষয়বস্তু টডে র রাজস্থান এর কাহিনী অবলম্বনে রচিত। যে কাহিনীতে আছে আলাউদ্দিনের চিতোর আক্রমণ এবং জহরব্রতে আগুন জ্বালিয়ে পদ্মিনীর আত্মহূতি দানের কাহিনী। আসলে কাহিনীটি পুরোপুরি ঐতিহাসিক নয়। রাণা ভীমসিংহের পত্নী পদ্মিনীর অলৌকিক সৌন্দর্যই চিতোর ধ্বংসের যে কারণ সেকথাই রঙ্গলাল তার গ্রন্থে ব্যক্ত করেছেন। পদ্মীনী ও রাজপুত রমণীদের অগ্নিকুণ্ডে আত্মবিসর্জনের কাহিনী অনেকখানি নিরুত্তাপ ও আবেগহীন হয়ে পড়েছে। কাহিনীর বিন্যাস একঘেয়ে ও নীরস। তবুও এ কাব্যের মাধ্যমে কবি স্বদেশবাসীর মধ্যে জাতীয় গৌরব ও ভাবাবেগ সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। আর সেখানে আমরা দেখি-

"স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়। দাসত্ব শৃঙ্খল বল, কে পরিবে পায় হে, কে পরিবে পায়।।"

                  কাব্যের কাহিনী,চরিত্র এবং রচনারীতি বিশেষ উল্লেখযোগ্য নয়। তবে স্বাদেশিক রস,বীররস ও করুণ রসের সমাবেশে গ্রন্থটিতে রোমান্টিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু রচনা রীতি ছিল একেবারেই প্রাচীনপন্থী। তবে তিনি কাব্যপ্রেমী বাঙালিকে জাগ্রত করার চেষ্টা করেছেন। এছাড়াও তাঁর উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব ভাষা এবং অলংকার প্রয়োগ। যেটি তিনি মধুসূদনকে অনুসরণ করে রপ্ত করেছেন।

           কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরেকটি অন্যতম কাব্য 'শূরসুন্দরী ।যে কাব্যে রাজপুত নারীর শৌর্যগাথা তুলে ধরেছেন। নারীর সতীত্ব রক্ষা এই কাব্যের পতিপাদ্য বিষয়। প্রতাপের সৌর্যবীর্য ও স্বদেশপ্রেম, শক্তিসিংহের ভাতৃপ্রেম, পৃথ্বীরাজের দুর্বলতা কাব্যে স্পষ্ট। এছাড়াও আকবরের সুন্দরী নারীর প্রতি কামনা বাসনা এ কাব্যে সুন্দরভাবে বর্ণিত হয়েছে। নারীর সতীত্ব রক্ষার কাহিনী ছাড়া কাব্য হিসাবে শূরসুন্দরী অত্যন্ত দুর্বল। কিন্তু আখ্যান কাব্যের বর্ণনা অতি মনোরম। যেখানে আকবরের প্রাসাদের এবং অন্তঃপুরের বর্ণনা কাব্যে প্রাধান্য লাভ করেছে। আকবর সতীত্বের কাছে পরাজিত হয়ে নিজের দোষ স্বীকার করে সতীকে বলেছে--

         "ধন্য বীরঙ্গনা তুমি বীরের নন্দিনী। 

           বীরগণ অন্তরেতে আনন্দ স্যন্দিনী।।"


    'কাঞ্চীকাবেরী'রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের আর একটি অন্যতম কাব্য। যার বিষয় উড়িষ্যার ইতিহাসের এক রোমান্টিক কাহিনী। তবে এই কাহিনী তার নিজস্ব সম্পদ নয়। পুরুষোত্তম দাসের প্রাচীন উড়িষ্যা কাব্য তিনি অনুসরণ করেছেন। কাহিনীটি সাত স্বর্গে বিন্যস্ত। যেখানে চতুর্থ সর্গ ছাড়া অন্য স্বর্গগুলিতে কবির কৃতিত্ব সমধিক ।তাই সুকুমার সেন লিখলেন--

       "কাঞ্চীকাবেরীর বিষয় বেশ রোমান্টিক। তাহার উপর ভক্তিরসের প্রবাহ থাকায় অধিকতর হৃদয়গ্রাহী।" 

        কাব্যটি ইতিহাস দৃষ্টিতে অখন্ডতা লাভ করেছে ।যেখানে প্রেম, ভক্তি ও রোমান্স এই কাব্যে রসসৃষ্টির প্রধান উপাদান।


রঙ্গলাল এর কৃতিত্ব--


    রঙ্গলালের কাব্য উঁচুমানের না হলেও নানা কারণে তিনি বাংলা কাব্যে আজও স্মরণীয় হয়ে আছেন । তাঁর বাংলা কাব্যে অবদান গুলি হল-

১) বাংলা কাব্যে তিনি ঈশ্বর গুপ্তের উত্তরসূরী এবং মধুসূদনের পূর্বসূরী।

২) 'পদ্মিনী উপখ্যান' আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম স্বদেশ চেতনামূলক আখ্যান কাব্য।

৩) বাংলা কাব্যের দেশপ্রেমের উজ্জীবনে এবং দেশপ্রেমমূলক রোমান্স সৃষ্টিতে তিনি ছিলেন পথিকৃৎ।

৪) সংস্কৃত, ইংরেজি, ওড়িয়া এবং ফরাসি কবিতার অনুবাদেও তাঁর উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব আছে। 

৫) কৃতিত্ব আছে কাব্য প্রকরণে পুরাতন রীতি গ্রহণ করে, বিদেশী কবিদের অনুসরণ করে পাশ্চাত্য ভাবধারাকে কাব্যে আনায়ন করা। 

৬) বাংলা কাব্য জগতে তিনি প্রমাণ করলেন অভিনব কাব্যরীতির সংযোগে  গতানুগতিকতার গ্লানিমুক্ত কবিতা রচনা করা যায়।

          পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাব্যে প্রাচীনতা যাই থাকুক না কেন তাঁর কাব্যে স্বদেশপ্রেমকে আমরা কখনোই অস্বীকার করতে পারি না। যে স্বদেশ প্রেম বাঙালি জাতিকে উদ্বুদ্ধ করে। তাছাড়াও তাঁর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, মমতাময় জীবনবোধ কাব্যে লক্ষণীয়। আর এই কারণে পদ্মিনী উপাখ্যানের নিষ্ঠুর সংগ্রাম অপেক্ষা মমতাময় প্রণয়চিত্ত দীপ্ততর। আসলে তিনি উনিশ শতকের বয়ঃসন্ধি সমাকুল আবেগপুষ্ট বাঙালি মানস এ কথা আমরা বলতেই পারি।

          

Comments

Popular posts from this blog

জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে বুদ্ধিবাদ বা প্রজ্ঞাবাদ(Rationalism)আলোচনা করো। (For BA. Second Semester & Higher Secondary Course)

 জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে বুদ্ধিবাদ বা প্রজ্ঞাবাদ(Rationalism)আলোচনা করো। (For BA. Second Semester & Higher Secondary Course) ভুমিকাঃ আমরা জানি জ্ঞানের উৎপত্তি বা উৎস নিয়ে পাশ্চাত্য দর্শনে দুটি উল্লেখযোগ্য পরস্পর বিরোধী মতবাদ দেখা যায়। আর এই দুটি পরস্পর বিরোধী মতবাদের মধ্যে একটি অন্যতম মতবাদ হলো বুদ্ধিবাদ বা প্রজ্ঞাবাদ। আর সেই বুদ্ধিবাদ অনুসারে-        আমরা জানি পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসে বুদ্ধিবাদের প্রধান প্রবক্তা হলেন দার্শনিক ডেকার্ট। আর এই দার্শনিক ডেকার্টকে আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শনের জনক বলা হয়। তবে তার পরবর্তী বুদ্ধিবাদী দার্শনিক হিসেবে স্পিনোজা, লাইবনিজ এবং কান্ট বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। সেখানে জ্ঞান উৎপত্তিতে-- ডেকার্ট এর অভিমতঃ            দার্শনিক ডেকার্ট এর মতে দর্শনচিন্তার প্রথম সূত্র হলো সংশয় বা সন্দেহ। আর এই সংশয় নিয়েই দর্শন আলোচনা শুরু হয় এবং সুশৃংখল সংশয়-পদ্ধতির মাধ্যমে সংসায়াতীত, স্বতঃপ্রমাণিত ও সার্বিক মূল সত্যে পৌঁছানো যাবে। এই মূল সত্য থেকে গাণিতিক অবরোহ পদ্ধতিতে সিদ্ধান্ত পাওয়া যাবে এবং তা অবশ্যই নির্মূল ও নির্ভরযোগ্য হবে। আর গণিতের অভ্রান্ততা এবং নিশ্চয়তাকে

ব্যাপ্তি কাকে বলে? ব্যাপ্তি কয় প্রকার ও কি কি? ব্যাপ্তিজ্ঞান লাভের উপায়/ব্যাপ্তিগ্রহের উপায় গুলি আলোচনা

 ব্যাপ্তি কাকে বলে? ব্যাপ্তি কয় প্রকার ও কি কি? ব্যাপ্তিজ্ঞান লাভের উপায়/ব্যাপ্তিগ্রহের উপায় গুলি আলোচনা করো। ব্যাপ্তি:- ন্যায় দর্শনমতে ব্যাপ্তি জ্ঞান হলো অনুমিতির অপরিহার্য শর্ত। ব্যাপ্তিজ্ঞান ব্যতীত অনুমিতির জ্ঞান লাভ সম্ভব নয়। সুতরাং আমরা বলতে পারি, যেখানেই ধূম সেখানেই বহ্নি। এই সাহচর্য নিয়ম হলো ব্যাপ্তি।                 এখানে সাহচর্য কথাটির অর্থ হলো সমনাধিকরণ। অর্থাৎ যেখানে যেখানে ধূম থাকবে সেখানে সেখানে বহ্নি থাকবে। আর নিয়ম কথাটির অর্থ হলো নিয়ত বা ব্যতিক্রমহীনতা। সুতরাং সাহচর্য নিয়ম কথাটির মানে হল ব্যতিক্রমহীন সাহচর্য। আর সেখানে ধুম ও বহ্নির অর্থাৎ হেতু ও সাধ্যের সাহচর্য নিয়মই হল ব্যাপ্তি।    ব্যাপ্তি দুই প্রকার।         ১) সমব্যাপ্তি           ২) বিষমব্যাপ্তি। ১। সমব্যাপ্তিঃ               সমব্যাপক দুটি পদের ব্যাপ্তিকে সমব্যাপ্তি বলা হয়। এখানে ব্যাপক ও ব্যাপ্য-র বিস্তৃতি সমান হয়। যেমন, যার উৎপত্তি আছে, তার বিনাশ আছে। উৎপত্তি হওয়া বস্তু ও বিনাশ হওয়া বস্তুর বিস্তৃতি সমান। উৎপত্তিশীল ও বিনাশশীল সমব্যাপ্তি বিশিষ্ট। ২। বিষমব্যাপ্তি/অসমব্যাপ্তি :-             অসমব্যাপক দুটির প

তৃতীয় সেমিস্টার ইতিহাস ছোট প্রশ্নোত্তর।

 ১) কুতুবউদ্দিন আইবক কে ছিলেন? উত্তর-কুতুবউদ্দিন আইবক গজনীর সুলতান মহম্মদ ঘুরির দাস ও সেনাপতি ছিলেন। তিনি দিল্লীর প্রথম তুর্কি সুলতান ছিলেন। তাঁর শাসনের শুরুর সাথে ভারতের এক নতুন যুগের সূচনা হয়। ২) নব্য মুসলমান কারা ছিলেন? কে তাদের দমন করেছিলেন? উত্তর - জালাল উদ্দিন ফিরোজ খিলজির আমলে হলান্ড বা আব্দুল্লা খানের নেতৃত্বে মোঘল আক্রমণ সংঘটিত হয় । তার আক্রমণ জালাল উদ্দিন কর্তৃক প্রতিহত হয় । সেই সময় কিছু বন্দি মঙ্গল জালাল উদ্দিনের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে । ধর্মান্তরিত হতে হবে এই শর্তে জালাল উদ্দিন তাদের আবেদনের সাড়া দেন। তারা এতে সম্মত হয় ।এই ধর্মান্তরিত মোঙ্গলেরা নব্য মুসলমান নামে পরিচিত। নব্য মুসলমানরা আলাউদ্দিনকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করলে সেই আলাউদ্দিন এর আদেশে একদিনে ৩০ হাজার নব্য মুসলমানকে হত্যা করে অর্থাৎ আলাউদ্দিন নব্য মুসলমানদের দমন করে। ৩) মালিক কাফুর দ্বারা বিজিত দাক্ষিণাত্যের দুটি রাজ্যের নাম করো। উত্তর - মালিক কাফুর ছিলেন সুলতান আলাউদ্দিনের একজন দক্ষ সেনাপতি । তাঁর দ্বারা দক্ষিণ ভারতের বিজিত রাজ্য দুটি হল দেবগিরি এবং বরঙ্গল। ৪) পাইবস ও সিজদা কি? উত্তর - পাইবস হল সম্রাটের প