Skip to main content

আধুনিক গীতিকবিতা হিসেবে বৈষ্ণব পদাবলী/বৈষ্ণব পদাবলীকে গীতিকবিতা বলা যায় কী? | ধর্মনিরপেক্ষ গীতি কবিতা হিসেবে বৈষ্ণব পদাবলী-আলোচনা করো।

 আধুনিক গীতিকবিতা হিসেবে বৈষ্ণব পদাবলী/বৈষ্ণব পদাবলীকে গীতিকবিতা বলা যায় কী? | ধর্মনিরপেক্ষ গীতি কবিতা হিসেবে বৈষ্ণব পদাবলী-আলোচনা করো।

        (প্রথম সেমিস্টার CC2) বৈষ্ণব পদাবলী।


          আলোচনার শুরুতেই আমরা বলতে পারি যে-বৈষ্ণব পদাবলীতে আছে গীতিরস,আছে রোমান্টিকতা এ বিষয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই।আসলে গীতিকবিতাকে ইংরেজিতে বলা হয় lyre lyric,যার আভিধানিক অর্থ হলো গীতিকবিতা।আর এই লিরিক নামক বাদ্যযন্ত্রের সাহায্যে এগুলির গীত হত বলেই এদের এরূপ নামকরণ করা হয়েছিল বলে মনে করা হয়।তবে আদিতে গীতিকবিতা ছিল গীতাত্মক বৈষ্ণব পদাবলী। কিন্তু মূলত পাঠ্য কবিতা নয়, গেয় কবিতা। সুতরাং বৈষ্ণব পদাবলীকেlyric বা গীতিকবিতা আখ্যাই বিধেয়। প্রসঙ্গত বলা দরকার রবীন্দ্রনাথ কিন্তু বৈষ্ণব পদাবলী কে গীতিক কবিতা রুপে আখ্যায়িত করেছেন। তবে-


         বৈষ্ণব পদাবলী নায়ক-নায়িকার ও সখা-সখীদের উক্তি-প্রত্যুক্তি প্রধান পালার আকারে সজ্জিত হয়েছে । শুধু তাই নয়,কীর্তনীয়ারা অনেক সময়ই যেভাবে কীর্তনের পালাগুলি গান করে উপস্থাপনা করে থাকেন, তাতে ঐ পালাগুলিকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গীতিনাট্য (opera) বলাই শ্রেয়। তবে পালাবদ্ধ রসকীর্তনের ক্ষেত্রে এর নাট্যলক্ষণকে স্বীকার করা হলেও বস্তুত বৈষ্ণবপদাবলী বিচ্ছিন্ন পদের সমষ্টি বলেই একে গীতিনাট্য না বলে গতিকবিতা বলাই সঙ্গত।আর সেখানে আমরা জানি -


      ‌ রোম্যান্টিকতা গীতিকবিতার একটা বিশেষ লক্ষণ। আর সেখানে কল্পনার ঐশ্বর্য, আবেগের গভীরতা, সৌন্দর্যের নিবিড়তা এবং সুদুরের ব্যঞ্জনা- এই বিষয় গুলি রোম্যান্টিক মনোভাবের লক্ষণ বলে গৃহীত হয়ে থাকে। তবে রোমান্টিকতা রচনারীতিতে নয়,এটি একপ্রকার মানস-প্রতীতি বলা যায়। রোম্যান্টিক কবি বা শিল্পীর মর্ত্যচেতনাই প্রধান রূপে প্রতীয়মান।কিন্তু আকাঙ্ক্ষা, দুর্জ্জেয়ের প্রতি অভিসার, ব্যাকুলতা – রোম্যান্টিক প্রকৃতির ইহাই মূল বৈশিষ্ট্য এবং প্রধান উপাদান।যেখানে ধর্মানুভূতি ও ভাগবতচেতনাও রোম্যান্টিক লক্ষণযুক্ত হতে পারে।তবে-

         বর্তমান সময়কালে আধুনিক গীতিকবিতার সঙ্গেই রোম্যান্টিকতার সম্পর্কের কথা বলা হলেও  প্রাচীনকালে বহু ধর্মসাধনায়ও রোম্যান্টিক মনোভাব অনুপস্থিত ছিল না। আর সেখানে আমরা অপ্রাপণীয় ঈশ্বরকে যখন একান্ত আপনার করে পেতে চাই। এবং পাই বলে মনে করি, ভগবৎপ্রাপ্তির সুদুর্গম পথে যখন ভক্তের চলে অভিসার—তখনই তো রোম্যান্টিকতার প্রাচুর্য দেখা যায়। তার মধ্যে থাকে প্রচুর রোম্যান্টিক রস । আমাদের দেশের বৈষ্ণব কবিরা ভগবানকে প্রেমিকরূপে কল্পনা করে থাকেন ।তবে তারা নিজেরা প্রেমিকার ভূমিকা গ্রহণ করেন না।প্রেমিকা স্বয়ং রাধা-চন্দ্রাবলী, নিজেরা সখী বা মঞ্জরীরূপে দুর থেকে কল্পনানেত্রে সেই লীলা প্রত্যক্ষ করেছেন। সুতরাং বৈষ্ণব কবিতায় রোম্যান্টিকতার সুর আছে এ কথা বলা যেতেই পারে।যেখানে--


            মধ্যযুগে বাংলাদেশে গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম প্রবর্তিত ছিল। তবে তার অনেক আগে থেকেই এরূপ মধুর রসাত্মক পরকীয়া প্রীতির বাহনরূপে অনেক কবিতাই ছিল। সেযুগে অপ্রাপণীয়কে পাবার আকাঙ্ক্ষা থেকেই এরকম রোম্যান্টিক অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছিল । আর সেই পদগুলির ভাষা ছিল সংস্কৃত এবং প্রাকৃত।তার প্রভাব পড়েছিল গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের ওপর । তবে বিষয়টি  সন্দেহাতীত ঘটনা। কিন্তু 

প্রসিদ্ধ বৈষ্ণবভক্ত অধ্যাপক খগেন্দ্রনাথ মিত্র বলেন-

         “ভগবানকে পতি ও আপনাকে পত্নী বা নায়িকাবোধে ভজনা করা শ্রীচৈতনা প্রবর্তিত বৈষ্ণব ধর্মের একটি অঙ্গ বলিয়া গণ্য হয়।"

সুতরাং বৈষ্ণব দর্শনের এই দিকটিই রোম্যান্টিকতার ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত এ তথ্য প্রমানিত সত্য।তবে-


            বৈষ্ণব পদাবলীর পশ্চাৎপটে একটা ভাবলোক – নিত্যবৃন্দাবন বর্তমান থাকলেও কার্যত বৈষ্ণব কবিতার পটভূমিকায়—প্রকৃতির সৌন্দর্যে, রাধাকৃষ্ণের নিবিড় মিলন রস ও তীব্র বেদনায়, রূপানুরাগে বাস্তবজগৎকেই প্রতিস্থাপন করা হয়েছে তা আমাদের স্বীকার করতেই হবে।আর সেখানে আমরা দেখি -

        "রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর। 

         প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর।।"

রোম্যান্টিক মর্ত্যবাসনা থেকেই এ পদগুলি সৃষ্টি করি হয়েছে।এখানে পার্থিব কবিতা বলতে তার রোম্যান্টিক বৈশিষ্ট্যকেই নির্দেশ করা হয়েছে।


         বৈষ্ণব কবিতার মধ্যে যে আকুলতা, অপ্রাপ্যকে পাবার আকাঙ্ক্ষা, শুধুই পূর্ণতার দিকে এগিয়ে চলা—এর মধ্যেই তো আধুনিক গীতিকবিতার জীবন লক্ষণ বর্তমান। গীতি কবিতার রোম্যান্টিক আবেদনে প্রাপ্তির সন্ধানে ছুটে চলে সৌন্দর্য, আনন্দ ও প্রেমের নবতর ব্যঞ্জনা। যার মধ্যে রোমান্টিকতায় বিরাজ করে থাকে।আর -

          রোমান্টিক গীতি-কবিতার উপযোগী ভাষা ও ছন্দ চয়নেও বৈষ্ণব কবিরা বেশ তৎপর ছিলেন। ব্রজবুলির ভাষা তো একান্তভাবে গীতি-কবিতারই ভাষা-বৈষ্ণব কবিতায় ব্যবহৃত ছন্দই তো এখনো পর্যন্ত আধুনিক গীতিকবিতায় ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তাই অধ্যাপক অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন-

       "বৈষ্ণব কবিগণ রাধাকৃষ্ণের বিরহ-মিলন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, আবেগ ও আর্তিকে যে শিল্প প্রকরণের সাহায্যে ব্যক্ত করিয়াছেন তাহাকে রোম্যান্টিক আশ্রয়ী বলিতে হইবে।"

 সুতরাং  বৈষ্ণব পদাবলীর রূপকল্পে রোম্যান্টিক সৌন্দর্য ও ব্যঞ্জনা অনুসৃত হয়েছে বাক্‌নিমিতি, ছন্দকৌশল, শব্দযোজনা ও আবেগের নিবিড়তা।আর এই দিকথেকে বিচার করিলে বৈষ্ণব পদাবলীকে রোম্যান্টিক কবিতা বলতেই হয়।

                 পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে,নিছক তত্ত্বরূপে বিচার করতে গেলে বৈষ্ণব কবিতাকে রোম্যান্টিক আখ্যা দেওয়ার পক্ষে বেশ কিছু বাধা রয়েছে বটে, কারণ,বৈষ্ণব কবিতাকে বলা হয় বৈষ্ণব তত্ত্বের রসভাষ্য।যা একটা বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের একটি গোষ্ঠীবদ্ধ কাব্যকলা। বৈষ্ণবতত্ত্বে ও বৈষ্ণব কবিতায় কল্পনার বিপুল ঐশ্বর্যের সমারোহ নেই। কিন্তু বৈষ্ণব কবিতার পদের সঙ্গে যে রোম্যান্টিক চেতনার স্ফুর্তি বিকশিত হয়ে উঠেছে, তা অস্বীকার করবার উপায় নেই। তাই নিছক সাহিত্য হিসেবে যখন বিচার করব, তখন বৈষ্ণব কবিতাকে রোম্যান্টিক গীতিকবিতা বলাই শ্রেয়।


Comments

Popular posts from this blog

দর্শন প্রথম সেমিস্টার সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তর।

দর্শন প্রথম সেমিস্টার সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, মাইনর সিলেবাস)  ১)চার্বাক মতে ভূত কয়টি ও কি কি? উত্তরঃচার্বাক মতে ভূত চারটি- ক্ষিতি, অপ্ , তেজ ও মরুৎ ২) স্বভাববাদ কী? উত্তরঃ চার্বাক জড়বাদের ভিত্তি হল স্বভাববাদ। যে মতবাদ অনুসারে স্বভাব থেকেই ভূত সৃষ্টি, আবার স্বভাব থেকেই বিচ্ছেদ। যার জন্য ঈশ্বরকে স্বীকার করা প্রয়োজন নেই। ৩) অব্যাপ্যদেশ কথাটির অর্থ লেখো। উত্তরঃ অব্যাপ্যদেশ বলতে বোঝায়- অশাব্দ অর্থাৎ যাকে শব্দের দ্বারা প্রকাশ করা যায় না। ৫) জ্ঞান লক্ষণ প্রত্যক্ষ কাকে বলে?  কোন একটি ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে তার নিজের বিষয়ীভূত গুণ ছাড়াও যদি অপর একটি ইন্দ্রিয়ের বিষয়ীভূত গুণকে প্রত্যক্ষ করার হয়, তাহলে সেই প্রত্যক্ষকে জ্ঞানলক্ষণ প্রত্যক্ষ বলা হয়। ৬) ন্যায় মতে প্রমাণের প্রকার  উত্তরঃ ন্যায় মতে প্রমাণ চার প্রকার। প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান এবং শাব্দ। ৭) সন্নিকর্ষ কাকে বলে? উত্তরঃ ন্যায় মতে ইন্দ্রিয় ও কোন বাস্তব পদার্থের মধ্যে একপ্রকার বিশেষ সম্পর্ক ঘটলে তবেই আমাদের একটি বস্তুর প্রত্যক্ষজ্ঞান ।আর ঐ বিশেষ বিশেষ সম্পর্কের পারিভাষিক নাম হলো সন...

ব্রিটিশ(3rd.Sem) পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব

ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব(পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় তৃতীয় সেমিস্টার রাষ্ট্রবিজ্ঞান মাইনর সিলেবাস)। ব্রিটেনের সংবিধান অলিখিত বলে বিভিন্ন ঐতিহাসিক দলিল, শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতি, পার্লামেন্ট প্রণীত আইন প্রভৃতির মাধ্যমে পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব অর্জিত হয়েছে। ব্রিটেনের পার্লামেন্ট আইনানুগ সার্বভৌমত্ব অর্জন করেছে, রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব নয়। আর সেখানে আইনানুগ সার্বভৌমত্ব বলা হয়, কারণ-       যেকোনো বিষয়ে পার্লামেন্ট আইন প্রণনয়নের অধিকারী। এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র হওয়ায় পার্লামেন্টে কোন আইন প্রণয়নের সময় প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় না। কমন্সসভা তথা নিম্নকক্ষের সার্বভৌমত্বকেই বলা হয় পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব।     ••ব্রিটিশ পার্লামেন্টকে সার্বভৌমত্ব বলার কারণ- ১) পার্লামেন্টের ওপর আইনগত কোনরূপ বাধানিষেধ আরোপ করা যায় না। ২) পার্লামেন্ট প্রণীত আইনের বৈধতার ব্যাপারে আদালত কোন প্রশ্ন তুলতে পারেনা। ব্রিটেনের আদালত পার্লামেন্ট প্রণীত আইনের ওপর বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার দ্বারা সীমিত করতে পারে না। ৩) ব্রিটিশ পার্লামেন্টের আইন প্রণয়ন ক্ষমতার উপর শাসনবিভাগ অনুরূপ ন...

ইতিহাস (3rd Semester) সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর।

 তৃতীয় সেমিস্টার ইতিহাস মাইনর সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, তৃতীয় সেমিস্টার ইতিহাস মাইনর)। ১)বন্দেগান-ই-চাহালগানি বলতে কী বোঝায়? •উত্তরঃবন্দেগান-ই-চাহালগান বলতে চল্লিশ জন তুর্কি ও অ-তুর্কি দাসদের সমন্বয়ে গঠিত একটি বাহিনীকে বোঝায়। এই বাহিনীকে ডাল চালিশা বা তুরকান-ই- চাহালগানি নামে ডাকা হতো। ২)আমির খসরু কে ছিলেন? •উত্তরঃ আমির খসরু ছিলেন প্রখ্যাত সুফি সাধক বা আরেফ নিজামউদ্দিন আওলিয়ার ছাত্র এবং অন্যতম প্রধান খলিফা। যাঁকে 'ভারতের তোতা' উপাধি দেওয়া হয়েছিল। ৩) মহরানা প্রতাপ কে ছিলেন?  •উত্তরঃ মেবারের শিশোদিয়া রাজবংশের একজন হিন্দু রাজপুত রাজা ছিলেন মহারানা প্রতাপ সিং। যিনি রাজপুতদের বীরত্ব ও দৃঢ় সংকল্পের প্রতীক। বহু বছর ধরে তিনি মুঘল সম্রাট আকবরের সঙ্গে লড়াই করেন। ৪) জায়গীরদারী সংকট কী? •উত্তরঃ জায়গিরদারী সংকট ছিল মোগল সাম্রাজ্যের একটি অর্থনৈতিক সংকট। এই সংকটে জমি বা জায়গিরের অভাব দেখা দিয়েছিল। যার ফলে প্রশাসনিক খরচ মেটানো এবং যুদ্ধের খরচ বহন করা সম্ভব হতো না। ৫) দাক্ষিণাত্য ক্ষত কী? •উত্তরঃ দাক্ষিণাত্য ক্ষত বলতে ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীত...