Skip to main content

চর্যাপদের সাহিত্যমূল্য বা কাব্যমূল্য বা ঐতিহাসিক বা সামাজিক গুরুত্ব আলোচনা করো। (প্রথম সেমিস্টার মেজর এবং মাইনর সিলেবাস)

 চর্যাপদের সাহিত্যমূল্য বা কাব্যমূল্য বা ঐতিহাসিক বা সামাজিক গুরুত্ব আলোচনা করো। (প্রথম সেমিস্টার মেজর এবং মাইনর সিলেবাস)

ভূমিকাঃ- প্রাচীন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের একমাত্র নিদর্শন চর্যাপদ। বৌদ্ধ সহজিয়া সাধক সম্প্রদায়ের সাধারণ সংগীতের সংকলন গ্রন্থ এই চর্যাপদ। তবে চর্যার গানগুলির মধ্যে ধর্ম সাধনার গূঢ়তত্ত্ব নানাবিধ রূপ ও সংকেতের মাধ্যমে লিপিবদ্ধ হয়েছে। সাধারণ বিচারের চর্যাপদের গুরুত্ব একটি বিশেষ ধর্ম সম্পর্কে মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার কথা ছিল। কিন্তু তা যে হয়নি তার কারণ চর্চার পদকর্তারা সাধক হলেও কবি ছিলেন এবং তারা পদ রচনা করতে গিয়ে সমকালীন সমাজকে চিত্রিত করেছেন। আর সেই চিত্রের মধ্যে সমকালীন মানব জীবন, ইতিহাস, ভাষা এবং কাব্য ধারা সম্পর্কে উপলব্ধি করা যায়। আর এখানেই চর্যাপদের ঐতিহাসিক গুরুত্ব নিহিত।সেখানে আমরা দেখি-

প্রথমতঃ- চর্যাপদের ভাষা প্রাচীন বা মধ্যভারতী কোন আর্য ভাষা নয়, আসলে এ হলো নব্য ভারতীয় আর্য ভাষার অন্যতম নিদর্শন। তবে বলা বাহুল্য,তা অবশ্যই বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন। চর্চার ভাষায় বাংলার সমজাতীয় মৈথিলী, উড়িয়া ও অসমীয়া ভাষার কিছু কিছু নিদর্শন থাকলেও এর মূল কাঠামো তৎকালীন গৌড়বঙ্গের সদ্য নির্মীয়মান ভাষা। তাই সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় বলেন-

   "The Language of the Caryas is the genuine vernacular of Bengal at its basis."

দ্বিতীয়তঃ- চর্যাপদে প্রায় হাজার বছর পূর্বের সামাজিক, রাষ্ট্রিক উপাদান ছড়িয়ে রয়েছে। তৎকালীন বঙ্গীয় তাম্রপট্টলিপিতে ও সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিতমানসে বঙ্গ ইতিহাসের যে উপকরণ পাওয়া যায়, চর্যাগানের ঐতিহাসিক ও সমাজচিত্রের সঙ্গে তার মিল রয়েছে। আছে আদি জনগোষ্ঠীর বিশেষ করে বঙ্গাল, শবর, চন্ডাল, ডোমদের পরিচয়। তবে তৎকালীন সময়ে ব্রাহ্মণ্য সমাজবিধি এদেরকে বেঁধে ফেলতে পারেনি। যাদের মধ্যে মধ্যে ছিল সাহস, শক্তি ও প্রাণের স্ফূর্তি ।আর তাদের আত্মভাবনার পরিচয় পেতে গেলে চর্যাপদের গুরুত্ব অপরিসীম।

তৃতীয়তঃ- সমকালীন সাধারণ গৃহজীবনের বাস্তব ছবি চর্যাপদের মধ্যে নিহিত আছে। প্রাচীন বাংলায় শশুর শাশুড়ি, ননদ, বধূ নিয়ে যে যৌথ পরিবার; যে পরিবারের জীবন সুখে- দুঃখে,আশায়- নিরাশায়, করুণ- মধুর সেই যৌথ পরিবারভিত্তিক সাধারণ জীবনের অসাধারণ পরিচয় আছে চর্যাপদে। যে গৃহজীবনে দুঃখ দারিদ্র, অভাব অনটন থাকলেও প্রাণের অকৃত্রিম স্পর্শ অনুভব করা যেত- আর তার পরিচয় পেতে গেলে চর্যাপদ আমাদের সহায়তা করতে পারে।

চতুর্থতঃ- বৌদ্ধ ধর্মের বিবর্তনের ইতিহাস বস্তুনিষ্ঠ বর্ণনায় কাব্যরূপ লাভ করেছে চর্যাপদে। তাই একসময়ের বৌদ্ধদের জীবনচর্যার বাস্তব দলিল হল চর্যাপদ। কারণ তত্ত্বরসিক সিদ্ধাচার্যরা জীবন রসিক শিল্পী।

পঞ্চমতঃ- অধ্যাত্ম সংগীত হিসেবে সহজিয়া বৌদ্ধদের শূন্যবাদ ও বিজ্ঞানবাদের সমন্বয়ে গঠিত সহজ মহাসুখ প্রতীতির বিভিন্ন দিক চর্যাপদে আছে। এই আধ্যাত্মিক তাৎপর্যের কারণে, সাধনতত্ত্ব ও সাধনসঙ্গীত হিসেবে চর্যাপদের মর্যাদা রয়েছে।

ষষ্ঠতঃ- চর্যাগান অধ্যাত্মসংগীতে হলেও বহিরঙ্গের রসাবেদনে ও সৌন্দর্য ব্যঞ্জনায় এগুলিকে কাব্যের কোঠা থেকে বাদ দেওয়া যায় না।শান্তরস, করুন রসের আবেদনে, আখ্যানধর্মিতায়, ছোটগল্পের আভাসে, হেঁয়ালির সমাহারে, আলংকারিক প্রয়োগে প্রাচীন বাংলার কাব্যিক উপাদান এই গানের গুরুত্ব কে বাড়িয়ে দেয়।

সপ্তমতঃ- পরবর্তীকালের সাহিত্যে প্রভাবের দিক থেকেও চর্যাপদের গুরুত্ব স্বীকৃত। নাথ সাহিত্যে,মঙ্গলকাব্যে, বৈষ্ণব পদাবলীতে, বাউল গানে চর্যাপদের ধর্মীয় প্রভাব সবচেয়ে বেশি। বৌদ্ধ সহজিয়াদের ধর্মীয় ভাবনার সাথে পরবর্তী কালের বাংলা সাহিত্যের সাদৃশ্য যথেষ্ট।

অষ্টমতঃ- মধ্যযুগের বাংলা কাব্যের ব্যবহৃত মাত্রা ছন্দের পূর্ণরূপ হল চর্যাগীতির ছন্দ। তাই সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন-

       " The meters of the Carya poems are Matravritta(O.D.B.L.)."

                পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, চর্যাগান শুধু প্রাচীন বাংলার আদিমতম নিদর্শন হিসেবে নয়, সমকালীন রাষ্ট্রিক ও সামাজিক চিত্রের উপস্থাপনে ধর্ম বিবর্তনের দিক থেকে, অধ্যাত্ম সংগীতের প্রকাশে এবং সর্বোপরি পরবর্তী সাহিত্যে প্রভাবের দিক থেকে এই গ্রন্থের গুরুত্ব অপরিসীম।

Comments

Popular posts from this blog

দর্শন প্রথম সেমিস্টার সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তর।

দর্শন প্রথম সেমিস্টার সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, মাইনর সিলেবাস)  ১)চার্বাক মতে ভূত কয়টি ও কি কি? উত্তরঃচার্বাক মতে ভূত চারটি- ক্ষিতি, অপ্ , তেজ ও মরুৎ ২) স্বভাববাদ কী? উত্তরঃ চার্বাক জড়বাদের ভিত্তি হল স্বভাববাদ। যে মতবাদ অনুসারে স্বভাব থেকেই ভূত সৃষ্টি, আবার স্বভাব থেকেই বিচ্ছেদ। যার জন্য ঈশ্বরকে স্বীকার করা প্রয়োজন নেই। ৩) অব্যাপ্যদেশ কথাটির অর্থ লেখো। উত্তরঃ অব্যাপ্যদেশ বলতে বোঝায়- অশাব্দ অর্থাৎ যাকে শব্দের দ্বারা প্রকাশ করা যায় না। ৫) জ্ঞান লক্ষণ প্রত্যক্ষ কাকে বলে?  কোন একটি ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে তার নিজের বিষয়ীভূত গুণ ছাড়াও যদি অপর একটি ইন্দ্রিয়ের বিষয়ীভূত গুণকে প্রত্যক্ষ করার হয়, তাহলে সেই প্রত্যক্ষকে জ্ঞানলক্ষণ প্রত্যক্ষ বলা হয়। ৬) ন্যায় মতে প্রমাণের প্রকার  উত্তরঃ ন্যায় মতে প্রমাণ চার প্রকার। প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান এবং শাব্দ। ৭) সন্নিকর্ষ কাকে বলে? উত্তরঃ ন্যায় মতে ইন্দ্রিয় ও কোন বাস্তব পদার্থের মধ্যে একপ্রকার বিশেষ সম্পর্ক ঘটলে তবেই আমাদের একটি বস্তুর প্রত্যক্ষজ্ঞান ।আর ঐ বিশেষ বিশেষ সম্পর্কের পারিভাষিক নাম হলো সন...

ব্রিটিশ(3rd.Sem) পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব

ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব(পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় তৃতীয় সেমিস্টার রাষ্ট্রবিজ্ঞান মাইনর সিলেবাস)। ব্রিটেনের সংবিধান অলিখিত বলে বিভিন্ন ঐতিহাসিক দলিল, শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতি, পার্লামেন্ট প্রণীত আইন প্রভৃতির মাধ্যমে পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব অর্জিত হয়েছে। ব্রিটেনের পার্লামেন্ট আইনানুগ সার্বভৌমত্ব অর্জন করেছে, রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব নয়। আর সেখানে আইনানুগ সার্বভৌমত্ব বলা হয়, কারণ-       যেকোনো বিষয়ে পার্লামেন্ট আইন প্রণনয়নের অধিকারী। এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র হওয়ায় পার্লামেন্টে কোন আইন প্রণয়নের সময় প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় না। কমন্সসভা তথা নিম্নকক্ষের সার্বভৌমত্বকেই বলা হয় পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব।     ••ব্রিটিশ পার্লামেন্টকে সার্বভৌমত্ব বলার কারণ- ১) পার্লামেন্টের ওপর আইনগত কোনরূপ বাধানিষেধ আরোপ করা যায় না। ২) পার্লামেন্ট প্রণীত আইনের বৈধতার ব্যাপারে আদালত কোন প্রশ্ন তুলতে পারেনা। ব্রিটেনের আদালত পার্লামেন্ট প্রণীত আইনের ওপর বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার দ্বারা সীমিত করতে পারে না। ৩) ব্রিটিশ পার্লামেন্টের আইন প্রণয়ন ক্ষমতার উপর শাসনবিভাগ অনুরূপ ন...

ইতিহাস (3rd Semester) সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর।

 তৃতীয় সেমিস্টার ইতিহাস মাইনর সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, তৃতীয় সেমিস্টার ইতিহাস মাইনর)। ১)বন্দেগান-ই-চাহালগানি বলতে কী বোঝায়? •উত্তরঃবন্দেগান-ই-চাহালগান বলতে চল্লিশ জন তুর্কি ও অ-তুর্কি দাসদের সমন্বয়ে গঠিত একটি বাহিনীকে বোঝায়। এই বাহিনীকে ডাল চালিশা বা তুরকান-ই- চাহালগানি নামে ডাকা হতো। ২)আমির খসরু কে ছিলেন? •উত্তরঃ আমির খসরু ছিলেন প্রখ্যাত সুফি সাধক বা আরেফ নিজামউদ্দিন আওলিয়ার ছাত্র এবং অন্যতম প্রধান খলিফা। যাঁকে 'ভারতের তোতা' উপাধি দেওয়া হয়েছিল। ৩) মহরানা প্রতাপ কে ছিলেন?  •উত্তরঃ মেবারের শিশোদিয়া রাজবংশের একজন হিন্দু রাজপুত রাজা ছিলেন মহারানা প্রতাপ সিং। যিনি রাজপুতদের বীরত্ব ও দৃঢ় সংকল্পের প্রতীক। বহু বছর ধরে তিনি মুঘল সম্রাট আকবরের সঙ্গে লড়াই করেন। ৪) জায়গীরদারী সংকট কী? •উত্তরঃ জায়গিরদারী সংকট ছিল মোগল সাম্রাজ্যের একটি অর্থনৈতিক সংকট। এই সংকটে জমি বা জায়গিরের অভাব দেখা দিয়েছিল। যার ফলে প্রশাসনিক খরচ মেটানো এবং যুদ্ধের খরচ বহন করা সম্ভব হতো না। ৫) দাক্ষিণাত্য ক্ষত কী? •উত্তরঃ দাক্ষিণাত্য ক্ষত বলতে ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীত...