জীবনীগ্রন্থ হিসেবে চৈতন্যভাগবত কতটা স্বার্থক, আলোচনা করে দেখাও।
ভূমিকাঃ- আলোচনা শুরুতেই আমরা বলতে পারি যে, বাংলা ভাষায় চৈতন্যজীবনী গ্রন্থ প্রণয়নের প্রথম দাবিদার বৃন্দাবন দাস। তবে এই বৃন্দাবন দাসের পরে বাংলা ভাষায় আরো অনেক চৈতন্যজীবনী প্রণেতার নাম আমরা পেয়ে থাকি। উদাহরণস্বরূপ আমরা বলতে পারি, লোচন দাস জয়নন্দ কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোবিন্দ দাস প্রমুখ কবি। এখানে বলে রাখা দরকার যে, চৈতন্যদেবকে অবলম্বন করে অসংখ্য চৈতন্য জীবনে গ্রন্থ রচিত হলেও বৃন্দাবন দাস কর্তৃক বাংলা ভাষায় চৈতন্য জীবনী গ্রন্থ রচনার প্রথম পথপ্রদর্শক। যেখানে-
কবি বৃন্দাবন দাস মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের নানান লৌকিক অলৌকিক জীবনী কাহিনী অত্যন্ত সহজ সরল, আড়ম্বরহীন এবং কাব্য মাধুর্যমন্ডিত করে বৈষ্ণব সমাজে বিশেষ করে সাধারণ বৈষ্ণব অনুরাগী মানুষের কাছে প্রথম তুলে ধরলেন চৈতন্যদেবকে। আসলে কবি বৃন্দাবন দাস ছিলেন পরম বৈষ্ণব ভক্ত। তবে তিনি চৈতন্যকে প্রত্যক্ষভাবে না দর্শন করলেও কবির কৈশোর কালের কিছু সময় চৈতন্য ধরাধামে অতিবাহিত করেছিলেন। প্রসঙ্গত বলে রাখা দরকার যে চৈতন্যদেবের মৃত্যুর কয়েক বছর পর তার গুরু ও পরামর্শদাতা নিত্যানন্দের নির্দেশে গ্রন্থটির নামকরণ করেন চৈতন্যভাগবত। আর এই গ্রন্থে কবি চরিত্রকে বৈষ্ণব সমাজে অবতার রূপে প্রতিষ্ঠিত করেন। তবে-
কবি বৃন্দাবন দাস এই চৈতন্যদেবকে বিশ্বাস করতেন শ্রীকৃষ্ণরুপে। আর সেই বিশ্বাস থেকে তিনি চৈতন্য ভাগবত গ্রন্থে শিশু বিশ্বম্ভরের শৈশবলীলা থেকে পরবর্তী জীবনলীলা গুলি তিনি ভাগবতীয় ও কৃষ্ণের লীলার অনুরূপ করে গড়ে তোলেন। এখানে কবি চৈতন্যকে কৃষ্ণ বলে উপলব্ধি করার কারণে চৈতন্যের জীবন বিশেষ করে তাঁর বাল্যকাল থেকে যৌবন পর্যন্ত লীলাকে ভাগবতের আদর্শ অনুসারে বৈষ্ণব সমাজের কাছে উপস্থাপিত করেন চৈতন্যভাগবত গ্রন্থে। আর এই গ্রন্থির মূল উপাদান তিনি সংগ্রহ করেন গুরু নিত্যানন্দের কাছ থেকে।। শুধু তাই নয় অন্যান্য যেসব চৈতন্য পদকর্তা আছে তাদের কাছ থেকেও তিনি উপাদান সংগ্রহ করেন। যার ফলে এই চৈতন্য ভাগবত গ্রন্থটি তথ্যবহুল এবং প্রামাণ্যগ্রন্থ হিসাবে বৈষ্ণব পাঠককুল এবং সাধারণ মানুষের কাছে সমাদৃত হয়। আর সেই গ্রন্থটি-
বৃন্দাবন দাস আদি, মধ্য এবং অন্ত এই তিনটি খন্ডে চৈতন্যভাগবত গ্রন্থটি রচনা করেন। তবে তিনি তিনটি খন্ডে চৈতন্যদেবের নানান লীলা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন। গ্রন্থটি তিনটি খন্ডে বিভক্ত হলেও এখানে আছে মোট ৫১ টি অধ্যায়। আর সেখানে আদিখণ্ডে আছে- চৈতন্যের জন্ম থেকে গয়া গমন ঘটনা, মধ্যখণ্ডে আছে- গয়া থেকে প্রত্যাবর্তনের পর নবদ্বীপলীলা ও সন্ন্যাস গ্রহণ। গ্রন্থটির অন্ত খন্ডে চৈতন্য দেবের কেশবভারতীর কাছে দীক্ষা গ্রহণ এবং তার পরবর্তী জীবনের ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে।
চৈতন্য ভাগবত গ্রন্থটি তিনটি খন্ডে এবং ৫১ টি অধ্যায়ী রচিত হওয়ার কারণে গ্রন্থটির মধ্যে বেশ কিছু ত্রুটি বিচ্যুতি দেখা যায়। আর সেই ত্রুটি বিচ্যুতিকে সামনে রেখে অবাস্তবতা, ঐতিহাসিক ক্রমহীনতার উল্লেখ করেন। তবে সমালোচনা যাইই করা হোক না কেন, তৎকালীন সমকালের মানদন্ডে যদি আমরা বিচার করি তবে উক্ত ত্রুটি বিচ্যুতির বিষয়গুলি গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয় না। কারণ মধ্যযুগে আমরা দেখতে পাই, লেখকদের মধ্যে বাস্তব ইতিহাসবোধ এর অভাব অনেকটাই স্বাভাবিক ছিল। ইতিহাসবোধ বা বিজ্ঞান চেতনা তৎকালীন সময়ে অভাব থাকলেও গ্রন্থটির মধ্যে প্রকটিত হলেও তৎকালীন বৈষ্ণব সমাজে চৈতন্য ভাগবত গ্রন্থটি বিশেষ জায়গা করে নেয়।
পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, অলৌকিক অনৈতিহাসিক ঘটনা চৈতন্যভাগবত গ্রন্থে যাই থাকুক না কেন, সেদিকে আমারা দৃষ্টি নিক্ষেপ না করি, চৈতন্য রস সাধনের দিকে দৃষ্টিপাত করি তাহলে আমরা অবশ্যই বলতে পারি জীবনীগ্রন্থ হিসাবে চৈতন্য ভাগবত গ্রন্থটি অনেক মূল্যবান, প্রামাণ্য, এবং সার্থক গ্রন্থ। তাই বিখ্যাত সমালোচক ডঃ বিমানবিহারী মজুমদার মনে করেন-
"ঐতিহাসিকের বহির্মুখী দৃষ্টির নিকট খুঁটিনাটি ঘটনায় বৃন্দাবন দাসের সামান্য ত্রুটি-বিচ্যুতি ধরা পড়লেও ষোড়শ শতকের বাংলার ধর্ম, সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ে চৈতন্যভাগবত ঐতিহাসিক তথ্যের আকরস্বরূপ।"
** আরোও বিশদ আলোচনায় "শেষের কবিতা সুন্দরবন" ইউটিউব চ্যানেল ভিজিট করুন
Comments
Post a Comment