ঘরে বাইরে উপন্যাসের নিখিলেশ চরিত্রটি রবীন্দ্র বিশ্বাসের প্রতিরূপ-আলোচনা করো।(চতুর্থ সেমিস্টার বাংলা অনার্স, পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়)
ঘরে বাইরে উপন্যাসের নিখিলেশ চরিত্রটি রবীন্দ্র বিশ্বাসের প্রতিরূপ-আলোচনা করো।(চতুর্থ সেমিস্টার বাংলা অনার্স, পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়)
ভূমিকাঃ- আলোচনার শুরুতেই আমরা বলতে পারি যে,বাংলা সাহিত্যের একটি অন্যতম কালজয়ী উপন্যাস ঘরে বাইরে। আর সেই উপন্যাসে কয়েকটি উচ্চবিত্ত মানুষের পরিচয় আমরা দেখতে পাই। সেই সকল মানুষগুলোর মধ্যে অন্যতম নিখিলেশ, সন্দীপ এবং বিমলা। আসলে এই চরিত্রগুলিকে উপন্যাসে এক আত্মসমীক্ষার আলোকে তুলে ধরা হয়েছে। যেখানে উপন্যাসে আছে দুটি পুরুষ চরিত্র নিখিলেশ এবং সন্দীপ। আর আছে একটি অন্যতম নারী চরিত্র বিমলা। এই তিনটি চরিত্রের আত্মভাবনার ফসল হল 'ঘরে বাইরে'। আর সেই উপন্যাসের--
প্রেক্ষাপট বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন।যে সময়ে উচ্চ মধ্যবিত্তেদের একটা সমাজ গড়ে উঠেছিল। সেই সমাজে ছিল ব্যক্তি স্বাধীনতা, ছিল মানবতাবোধ, আরোও ছিল সমাজের উদারতা। যেখানে নিখিলেশ উচ্চ শিক্ষিত এবং চরিত্রবান। শুধু তাই নয়, শুধু তাই নয় নিখিলেশ ধনী ব্যক্তি, বিরাট তার জমিদারি, বলা যায় রাজার মতোই। কিন্তু তার মধ্যে পূর্বপুরুষের কোন চরিত্র দোষ ছিলনা, ছিলনা স্বার্থপরতা। তবে এই নিখিলেশ পত্নীর যথার্থ ভালবাসা প্রত্যাশা করে, তবে সে পূজো চাইনি, চাইনি ভক্তি বা শ্রদ্ধা। শুধু ভালোবাসাই তার একান্ত কামনার বিষয় ছিল। নিখিলেশ যাই বলুক না কেন তার প্রতি বিমলা তাকে একসময় বলেছে-
"প্রিয়তম, তুমি আমার পূজা চাওনি,
সে তোমারই যোগ্য।"
বিমলার নেকলেস সম্পর্কে যাই বলুক না কেন নিখিলেশ কিন্তু বিমলকে চার দেয়ালের মধ্যেই বন্দি রাখতে চাই নি কখন। সেই চেয়েছিল বিমলা বাইরের কাজকর্মে স্বামী স্ত্রী পরস্পরকে জানবে চিনবে। আর তার ফলস্বরূপ নিখিলেশ লেখাপড়া শেখাতে চেয়েছি ল। আসলে আসলে বাইরে বেরিয়ে বৃহত্তর পৃথিবীর পরিচয় পাঠ বিমলক বাইরের আলোয় তার নেকলেস টি বিচার করতে শিখুক বিমলা। এই কারণে নেকলেস কে আমরা আধুনিক ও উদার বলতে পারি কারণ নারীকে বন্দিনী করে রাখা ইচ্ছে তা কোনদিনই ছিল না। তাই জগতে বিমলকে যুক্ত জগতে করে দিতে চেয়েছে আর এখানে নিখিলেশ কে বলতে শুনি-
"আমি লোভী নই, প্রেমিক।"
নিখিলেশের স্বভাবের মধ্যে একটি বড় গুণ হলো অন্য কারোর দোষ ধরা তার স্বভাব নয়। এখানে নিখিলেশ বৌদিদের সব অনুরোধই সে রেখেছে এবং বঞ্চিত বলে তাদের ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতো। তবে বিমলা সম্পর্কে নিখিলেশ যথেষ্ট উদার ছিল। তাই সে স্ত্রীকে স্পষ্ট ভাষায় বলেছে-
"আমি তোমাকে ছুটি দিলুম। আমি যদি
তোমার আর কিছু হতে না পারি, অন্তত
আমি তোমার হাতের হাত-কড়া হব না।"
আসলে নিখিলেশ যথার্থ দেশপ্রেমিক।আর দেশপ্রেমিক হিসেবে সে দেশের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দেশেই উৎপন্ন করবে বলে নানা চেষ্টা শুরু করে দেয়।তবে সে এই সময়কালে টাকার অভাব অনুভব করে। সেই অনুভব থেকে সে একটি ব্যাঙ্ক খোলে।আর সেই ব্যাঙ্কের জমা টাকার উপর মোটা সুদের ব্যবস্থা করলে অসংখ্য মানুষ টাকা জমা রাখার আগ্ৰহ দেখায়। কিন্তু সেটিও বেশিদিন চললো না। এই নিখিলেশ দেশকে সত্যকার দেবতা বলে মান্যতা দেয়।আর এই মান্যতা থেকে সে বলে--
"আমি নর-নারায়ণের উপাসক। মানুষের
মধ্যেই ভগবানের সত্যকার প্রকাশ,তেমনি
দেশের মধ্যে।"
আসলে তার মধ্যে ছিল প্রবল আত্মবিশ্বাস,আত্মনিষ্ঠা, সত্যনিষ্ঠা। তাই সে অন্যায়কে কখনো কর্তব্য বলে মানে না। আবার অধর্মকে পুণ্য বলে চালাতে চাইনি।সেকারণে যাকিছু মন্দ,তা সে দেশকে দিতে চায় না।আসলে নিখিলেশ কল্যাণকর্মে বিশ্বাসী।আর এই কাজ করতে গিয়ে সে ওপর মহলকে এড়িয়ে চলে।তবে--
স্বদেশিয়ানায় নিখিলেশের সংযম ছিল। তাই অকারণে সে কখনো উত্তেজিত হয়নি। কিন্তু বিলিতি সুতা বিক্রি করে যারা সংসার চালায় তাদের সে বারণ করতে পারে না। আবার দেশি জিনিস সকলে যাতে কেনে সেকথাও সে জানায়।সে ভালো করেই জানে যে, দেশের লোকের সাধ্য নেই বেশি পয়সা দিয়ে দেশের জিনিস কিনবে। ঠিক এমনই পরিস্থিতিতে সন্দীপ তার কাছে আসলে তাকেও টাকা দেয় দেশের উপকারের জন্য। তবে তাদের মধ্যে বেশ মতের অমিল ছিল। তবুও তার সংসার চালানোর জন্য নিখিলেশ কার্পণ্যহীনভাবে টাকা জুগিয়ে যেত। আবার -
নিখিলেশের মধ্যে বেশ শান্তভাব ছিল। উত্তেজনার কাছে সে কখনো মাথা নত করতো না। বিমলা তাকে উত্তেজিত করার জন্য নানা কথা বললেও নিখিলেশ কোন প্রতিবাদ করতো না,এমনই স্বভাব চরিত্র সে অধিকারী। নিখিলেশের চরিত্রে কোন কর্তৃত্ব নেই,জোর ফেলাবার প্রয়াস নেই,জোর করে কেড়ে নেবার প্রবৃত্তিও নেই।তাই সংস্কারের বশবর্তী হয়ে বিমলা যেন তার আনুগত্য না করে, প্রাচীন ধারানুসারে বিমলা যেন স্ত্রীর কর্তব্য পালন না করে। নিখিলেশের এই মনোভাবের প্রেক্ষিতে বিমলা বর্হিজীবনে নিজেকে মেলে ধরে এবং স্বামীর প্রতি উদাসীন হয়ে পড়ে। নিখিলেশ এসব জেনেও কান্না দিয়ে বিমলাকে বন্দী রাখতে চায় না।তাই নিখিলেশকে বলতে শুনি--
"ভালোবাসা সেখানে একেবারে মিথ্যা হয়ে
গেছে সেখানে কান্না যেন সেই মিথ্যাকে বাঁধতে
না চায়।"
যে কোন ঘটনাকে স্বীকার করে নেওয়া বা মান্যতা দেওয়ার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল নিখিলেশের। নিখিলেশ একদিন তার শোবার ঘরে যায় একটা বই আনতে।আর সেদিন সে দেখতে পেল যে তার ছবির সামনে বেশ কিছু পুরনো ফুল, যেগুলো শুকিয়ে কালো হয়ে গেছে সেগুলি পড়ে আছে। কিন্তু এর আগে বিমলা প্রতিদিন স্নানের পরে তার ছবির সামনে ফুল রেখে প্রণাম কর করতো। তবে আজকাল সেসব বিষয়েই বিমলা ধার ধারে না। বিষয়টি জেনে নিখিলেশ নিজেকে বেশ নিশ্চিন্ত বোধ করে। কারণ নিখিলেশ আজ কোন মনগড়া কল্পনার ধার ধারে না, সত্যকে সে গ্ৰহণ করতে শিখে গেছে।আসলে--
সন্দীপ নিখিলেশের মন মানসিকতা আগেই জেনে গেছিল। এই সন্দীপ ধূর্ত, চতুরতা দিয়েই তার মোহ এবং দুর্বলতা কে ঢাকতে চায়। কিন্তু নিখিলেশ কখনোই বিমলার কাছে সন্দীপের চাতুর্যতা তুলে ধরেনি। কারণ বিমলা মনে করতেই পারে যে সন্দীপ সম্পর্কে তার ঈর্ষা আছে। এমনকি নিখিলেশ সন্দীপ সম্পর্কে বিমলাকে কখনো সাবধানও করিনি। বলা যেতে পারে এখানে নিখিলেশের বাস্তবতা বোধ একটু কম ছিল।তবে--
সন্দীপের ধারণা ছিল নিখিলেশ আসলে একটা আইডিয়াচালিত মানুষ। তার সংসারের মধ্যে, তার ঘরের মধ্যে বিপদ আছড়ে পড়েছে জেনেও সে উদাসীন থাকে। আর এই উদাসীনতা তার জীবনে চরম ট্রাজেডি এনে দেয়। আজ নিখিলেশ ট্রাজেডির নায়ক। তার আত্মা আজ ব্যথিত, যন্ত্রণায় বিদ্ধ। তবুও সে তার জীবনকে হেসে উড়িয়ে দিতে চায়। অথচ এই নিখিলেশ বিমলাকে তার মনের মনিকোঠায় রেখেছিল। সেই নিখিলেশ আজ তার স্ত্রীর সম্পর্কে বলে--
"একদিনও ওকে ধুলোর ওপর নামাইনি।...... ও
যদি কাগজের খেলার নৌকার মতো আজ হঠাৎ
নর্দমার ঘোলা জলে ডুবে যায় তাহলে সেই সঙ্গে
আমার...।"
আসলে এই পরিস্থিতিতে নিখিলেশের কিছু করার ছিল না। কারণ পরিস্থিতি তার আয়ত্বের বাইরে চলে গেছে। নিয়ন্ত্রণ করার কোনো ক্ষমতা নিখিলেশের আজ আর নেই।
ঠিক এইরকম আরো অনেক আলোচনা, বিষয় ভিত্তিক সাজেশন পেতে ভিজিট করুন আমাদের "SHESHER KOBITA SUNDORBON" YOUTUBE চ্যানেলে।
Comments
Post a Comment