বৌদ্ধদর্শন ও সাংস্কৃতিক চর্চায় বৌদ্ধ বিহার গুলির ভূমিকা আলোচনা করো।(পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, প্রথম সেমিস্টার, বাংলা মাইনর)
বৌদ্ধদর্শন ও সাংস্কৃতিক চর্চায় বৌদ্ধ বিহার গুলির ভূমিকা আলোচনা করো।(পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, প্রথম সেমিস্টার, বাংলা মাইনর)
আলোচনার শুরুতেই আমরা বলতে পারি যে,আমরা জানি খ্রীষ্ট্রীয় পঞ্চম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত বাংলায় সংস্কৃত চর্চার প্রধান কেন্দ্র ছিল মেদিনীপুর জেলার তাম্রলিপ্ত, হুগলি জেলার ভুরিশ্রেষ্ঠ, বীরভূম জেলার সিধল ও বরেন্দ্রভূমের বনগ্রাম প্রভৃতি স্থানে। শুধু তাই নয়,প্রসিদ্ধ চৈনিক পর্যটক উয়াং চুয়াং ও অন্যান্য চৈনিক পরিব্রাজকগও বাংলার বুকে প্রচুর সংস্কৃত চর্চার কেন্দ্র দেখেছিলেন।আর সেখানে যে শুধু ব্রাহ্মণ পন্ডিতগণ সংস্কৃত চর্চা করতেন তা নয়, বৌদ্ধ পন্ডিতগণও সংস্কৃত চর্চা করতেন। তবে বৌদ্ধদের শিক্ষা কেন্দ্র ছিল জগদ্দল, সোমপুরী, পান্ডুভূমি প্রভৃতি স্থানে। এই যুগের বিখ্যাত বাঙালি বৌদ্ধপন্ডিতগ হলেন অতীশ দীপঙ্কর, শীলভদ্র, শান্তিদেব, জ্ঞানশ্রীমিত্র প্রমুখ। যারা সংস্কৃত ও অপভ্রংশ এই দুই ভাষাতেই তারা মৌলিক ও টিকাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। আর সেখানে আমরা দেখি-
বৌদ্ধ বিহার প্রধানত বৌদ্ধ ধর্মের সাথে যুক্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সেখানে ভিক্ষুদের বাসস্থান, ধর্মীয় আচারাদি সম্পন্ন ও ধ্যান করার স্থান এবং বৌদ্ধ শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে একে চিহ্নিত করা যায়। ভিক্ষুদের জন্য লিখিত বৌদ্ধ ধর্মের অনুশাসনমূলক গ্রন্থসমূহ থেকে পাঁচ ধরনের আবাসনের কথা জানা যায়। সেগুলি হলো-
১)বিহার, ২)আদ্যযোগ, ৩)পাসাদ,
৪)হাম্মীয় এবং ৫)গুহা।
তবে এগুলির মধ্যে বর্তমানেটিকে আছে শুধু বিহার ও গুহা। তবে --
বৌদ্ধ বিহারগুলি সাধারণত প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী কুষাণ রীতিতে গড়া। আর সেগুলি ছিল গুলি বর্গাকৃতি ব্লক রীতির এবং একটি অভ্যন্তরীণ অঙ্গনের চারদিকে চার সারিতে ছিল কক্ষসমূহ। সাধারণত এসব বিহার নির্মিত হতো পাথর অথবা ইট দিয়ে। বিহারের সাংগঠনিক কার্যাদি সম্প্রসারিত হলে বিহারসমূহ আরও অনেক আনুষঙ্গিক বস্তসহ ব্যাপকভাবে ইটের কাঠামোতে নির্মিত হতে থাকে। এগুলি সাধারণভাবে কয়েক তলা বিশিষ্ট হতো এবং অভ্যন্তরীণ অঙ্গনসহ স্তম্ভের উপর ভর করে তৈরি করা হতো টানা বারান্দা। যেগুলির কোন কোনটির মধ্যে মঞ্চসহ স্তূপ বা কেন্দ্রীয় মন্দির দেখা যেত। মন্দিরের ভেতরে বুদ্ধ, বোধিসত্ত্ব অথবা বৌদ্ধ নারী দেবীর মূর্তি স্থাপন করা হতো। গুপ্ত ও পাল যুগে কমবেশি এ ধরনের রীতিতেই বিহারসমূহ স্থাপন করা হতো বাংলা ও বিহারে। সময়ের পরিক্রমায় বিহারসমূহ গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রে পরিণত হয়।আর সেখানে--
বিখ্যাত চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন-সাং এর বিবরণ থেকে কয়েকটি বিকাশমান বিহারের নকশা ও কাঠামো সম্পর্কে আমরা ধারণা পাই। তিনি পুন্ড্রবর্ধনের (মহাস্থান) রাজধানী শহর থেকে প্রায় ৬.৫ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত বিশাল পো-শি-পো বিহারের কথা উল্লেখ করেছেন। বিহারটি এর প্রশস্ত হলঘর এবং লম্বা লম্বা কক্ষের জন্য বিখ্যাত ছিল। জেনারেল কানিংহাম এই বিহারকে ভাসু বিহার বলে শনাক্ত করেন। অতঃপর--
হিউয়েন-সাং কর্ণসুবর্ণ এর (রাঙামাটি, মুর্শিদাবাদ, পশ্চিম বাংলা) নিকট অবস্থিত বিখ্যাত লো-টো-মো-শি বিহারের (রক্তমৃত্তিকা বিহার) কথাও উল্লেখ করেছেন। বিহারটির অবস্থান রাঙামাটি অঞ্চলে (বর্তমান চিরুটি, মুর্শিদাবাদ, পশ্চিম বাংলা) শনাক্ত করা হয়েছে। এখানে উৎখননের পর প্রথাগত নকশার ভেতর বিন্যস্ত কয়েকটি মঠ-কক্ষ ছাড়াও পাওয়া গিয়েছে সম্প্রসারিত অংশে কিছু স্থাপনা, যেমন- মন্দির, স্তূপ, প্যাভিলিয়ন ইত্যাদি।
বাংলার প্রাচীনতম বিহারের মধ্যে একটি বিহার পাওয়া গিয়েছে বিহারাইলে (রাজশাহী জেলা, বাংলাদেশ)। বিহারের নকশা প্রাচীন রীতি অনুযায়ী করা হয়েছিল অর্থাৎ প্রধান অঙ্গনের চারদিকে সারিবদ্ধ কক্ষসমূহ নির্মাণ করা হয়েছিল। বিহারটি গুপ্ত যুগে নির্মিত হয়েছিল বলে ধরে নেওয়া হয়। সোমপুর মহাবিহার, পাহাড়পুর প্রাচীন বাংলায় পাল যুগে বেশ কিছুসংখ্যক বিহার গড়ে উঠেছিলো।এগুলি সম্ভবত অতিরিক্ত উপাসনা গৃহ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এ ধারার বিহারের মধ্যে এটিই ছিল প্রথম বিহার এবং এর সুখ্যাতি এগারো শতক পর্যন্ত স্থায়ী ছিল বলে মনে করা হয়।তবে-
বিখ্যাত নালন্দা মহাবিহারটি কয়েক শতক পূর্বে নির্মিত হয়েছিল। হিউয়েন-সাং বিহারটির ঐশ্বর্য ও বিশালত্বের বর্ণনা দিয়েছেন। তিববতীয় ও চৈনিক সূত্রে এ বিহার সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। পাল-পরবর্তী যুগেও বিহারটির খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল।তিববতীয় সূত্র থেকে বিক্রমশীলা মহাবিহার সম্পর্কে জানা যায়। বিহারটি নির্মাণ করেছিলেন পাল রাজা ধর্মপাল। এর প্রকৃত অবস্থান ভাগলপুর (বিহার) জেলার ক্ষুদ্র গ্রাম অন্তিচকে। এ বিহারে ১০৭টি মন্দির এবং ৫০টি অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ছিল। এ প্রতিষ্ঠানসমূহে ১০৮ জন ভিক্ষুর জন্য কক্ষ বরাদ্দ ছিল। বিহারটি প্রতিবেশী দেশসমূহের শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করেছিল।তবে--
পালযুগের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য বিহার গুলো ত্রৈকুট, দেবীকোট (প্রাচীন কোটিবর্ষ বা বর্তমান বাণগড়ের সঙ্গে একে শনাক্ত করা হয়েছে), পন্ডিত বিহার এবং জগদ্দল মহাবিহার। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত সময়ে উৎখনন কার্য পরিচালনা করার ফলে পশ্চিম বাংলার বর্ধমান জেলার ভরতপুরে বৌদ্ধ বিহার কমপ্লেক্স আবিষ্কৃত হয়েছে। আদি মধ্যযুগে বিহারটি নির্মিত হয়েছিল বলে মনে করা হয়। জগজ্জীবনপুরে (মালদহ জেলা, পশ্চিম বাংলা) সাম্প্রতিক উৎখননের ফলে নয় শতকের আরেকটি বৌদ্ধ বিহার আবিষ্কৃত হয়েছে। দুর্ভাগ্য যে, বিহারটির উপরিকাঠামোর কিছুই টিকে নেই। তবে প্রত্নস্থলটিতে বারান্দাসহ আয়তাকার আঙ্গিনামুখী বেশ কয়েকটি মঠ-কক্ষ পাওয়া গেছে। এগুলোর আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্যটি হলো যে, এর কোণের কক্ষগুলি ছিল বৃত্তাকার,জগজ্জীবনপুর বিহারের সাধারণ গঠন এবং আকৃতি নালন্দার মতোই ছিল বলে মনে করা হয়।
এইরকম আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ভিত্তিক আলোচনা, বিষয় ভিত্তিক সাজেশন পেতে ভিজিট করুন আমাদের "SHESHER KOBITA SUNDORBON"
YOUTUBE CHANNEL নমস্কার। অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন 🙏
Comments
Post a Comment