ইসলাম ধর্মকেন্দ্রিক সাহিত্যে শাহ মুহম্মদ সগীরের কাব্য প্রতিভা আলোচনা করো।
ভূমিকাঃ- রোসাঙ রাজসভার দুই খ্যাতিমান কবি দৌলত কাজী ও আলাওল ছাড়াও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে ইসলামী ধর্মভাবনা বা সুফি ভাবনাকে কেন্দ্র করে বহু কবি সাহিত্য রচনা করেছেন। আর সেই সকল সাহিত্যের মধ্যে আছে কিসসা সাহিত্য, মর্সিয়া সাহিত্য, শায়েরী সাহিত্য, পুঁথি সাহিত্য প্রভৃতি। আর সেখানে মধ্যযুগের রোমান্টিক প্রনয়মূলক কাহিনী কাব্য ইউসুফ জোলেখা র রচয়িতা শাহ মুহম্মদ সগীর তাঁর কবিত্ব শক্তির কারণে সাহিত্যের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন ।আসলে তিনি ধর্মীয় নাগপাশে আবদ্ধ মধ্যযুগের সাহিত্যকে যাঁরা নিছক মানবীয় প্রেমের আধারে মুক্তি দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হলে শাহ মুহাম্মদ সগীর।তবে--
অখন্ড বঙ্গে সেইসব রচিত সাহিত্যগুলি সবই যে কবিত্বের নিরিখে উঁচু মানের তা বোধহয় বলা যাবে না। কিন্তু মুসলমানদের ধর্ম ও সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে যে সব সাহিত্যিক সাহিত্য রচনা করেছিলেন সেইসব সাহিত্যগুলির অনেকগুলিই সাহিত্যের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। যার মধ্যে শাহ মুহম্মদ সগীরের 'ইউসুফ জুলেখা' অন্যতম। আর সেখানে আমরা দেখতে পাই--
বাংলা সাহিত্যে রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যানের মধ্যে প্রাচীনতম আখ্যায়টি হল শাহ মুহম্মদ সগীরের 'ইউসুফ জুলেখা'। ইউসুফ জোলেখার মোট পাঁচটি পান্ডুলিপি এ পর্যন্ত পাওয়া গেছে। তবে মধ্যযুগের বহু কবির মতই এ কবির আবির্ভাব কাল নিয়ে বেশ বিতর্ক আছে। কবি যেহেতু তাঁর কাব্যে কোন আত্মবিবরণ মূলক অংশ যোগ করেন। সেহেতু তার সম্পর্কে কোন স্থির সিদ্ধান্ত আসা বেশ মুশকিলের বিষয়। তবে কাব্যটির ভাষার বিশ্লেষণ করে ভাষাতাত্ত্বিকরা জানিয়েছেন যে কাব্যটি শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের কিছু পরবর্তীকালে এবং মালাদার পশুর শ্রীকৃষ্ণ বিজয় এর পূর্ববর্তী কালের রচনা।
ইউসুফ জোলেখা কাব্যের সূচনা অংশে আছে আল্লাহ ও রসুল বন্দনা,এছাড়াও আছে রাজপ্রশস্তি ও পুস্তক রচনা প্রভৃতি কথা। অতঃপর কাব্যটি শুরু হয়েছে এভাবে- জোলেখার জন্মবৃত্তান্ত, জুলেখার রূপ বর্ণনা, জোলেখার আভরণ প্রভৃতির বর্ণনা। পশ্চিম দিকে রাজা তৈমুরের কন্যা জোলেখা স্বপ্ন দেখে এক অনন্য সুন্দর পুরুষকে। জোলেখা তিন বছরের তিনবার স্বপ্ন দেখে । তৃতীয় বছর স্বপ্নেই সে জানতে পারে এই যুবক আজিজ মিছির।আর এই সময় দৈববাণী মারফৎ জোলেখা জানতে পারে--
"আজিজ মিছির তোর পতি মাত্র লেখা।
তার যোগে হৈব তোর প্রভু সনে দেখা।।"
জোলেখা তখন রাজা আজিজ কে বিবাহ করে, কিন্তু রাজার সঙ্গে কন্যার মিলন হলো না। তবে আজিজ তাঁর অন্যান্য স্ত্রীদের সঙ্গে দিন কাটাতে থাকেন।
ইউসুফ জোলেখা কাব্যের উপজীব্য বিষয়, নায়ক ইউসুফ ও নায়িকার জোলেখার প্রণয় কাহিনী। তবে এটি সগীরের মৌলিক রচনা নয়।প্রাচীনকাল থেকে বাইবেল ও কোরানে ইউসুফকে কেন্দ্র করে নৈতিক উপাখ্যান চলে আসছে। এই কাহিনী অবলম্বনে ইরানীয় কবি আবুল কাসেম ফিরদৌসী ও সুফি কবি আব্দুর রহমান জামীর উভয়ে ইউসুফ জোলেখা নামে কাব্য রচনা করেছেন। এই দুজনের কাব্যের সঙ্গে সগীরের কাব্যের হুবহু মিল না থাকলেও বেশ কিছুটা মিল আছে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তবে--
পূর্বেই আমরা বলেছি, কাব্যটি শুরু হয়েছে আল্লাহ ও রসুল বন্দনা, মাতাপিতা ও গুরুজন বন্দনা রচনার কথা দিয়ে। তারপর কাহিনীটি শুরু হয়। আর এই কাব্যের মূল কাহিনী ইউসুফকে লাভ করার জন্য প্রেমিকা জোলেখার আজীবন প্রয়াসের ইতিহাস। আমরা জানতে পারি ইউসুফ আসলে ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি, দিব্যকান্তি সুপুরুষ। সংসারের লোভ, লালসা, কাম, মোহ ঐশ্বর্য থাকে উন্নত আদর্শের পথ থেকে সরাতে পারিনি। তাছাড়া তাঁকে আশ্রয় করে আল্লাহ বা ঈশ্বর সত্যের জয় ঘোষণা করেছেন। বারবার ইউসুফের বৈমাত্রেয় দশ ভাই তাঁকে বিপদে ফেলেছে। এমনকি তাঁকে মেরে ফেলার চেষ্টাও করা হয়েছিল। কিন্তু ঈশ্বরের কৃপায় সে সমস্ত বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়েছে। পাশাপাশি জোলেখাও অপেক্ষা করেছে ইউসুফের জন্য। স্বামী আজিজ মিসিরের মধ্যে জোলেখা প্রেমের দিকটিকে কোনদিন খুঁজে পাননি। ইউসুফকেও জোলেখা ভোগের দৃষ্টিতে দেখে ব্যর্থ হয়েছে। এরপর। বহু কৃচ্ছ্রসাধনায় জোলেখা ইউসুফকে স্বামীরূপে লাভ করেছে।
জোলেখা কাব্যটির মধ্যে আছে নাটকীয়তা, আছে আদর্শগত দ্বন্দ্ব। আদি মধ্য একটি নিটোল কাহিনী এ কাব্যে আছে। নাটক নিয়ে তার সঙ্গে গীতি প্রানতার কাহিনী কি দিয়েছে সজীবতা। তবে চরিত্র চিত্র নেই ছবির কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। ইউসুফের নৈতিকতা বাস্তব বুদ্ধি প্রলোভন জয় করার ক্ষমতা, ঈশ্বর ভক্তি পিতৃভক্তি স্নেহ প্রভৃতি বৈশিষ্ট্য তার মধ্যে লক্ষণীয় আসলে এসব তরুতেই সততা সংযম ত্যাগ ও উদ্যোগ অত্য্তীকরণ বুদ্ধির নিরিখে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে সংসারের কাম মোহ ঐশ্বর্যতাকে উন্নত আদর্শের পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি তবে কাব্যের শেষে কবি ইউসুফকে ঈশ্বরপ্রিত দুধ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন তার প্রেমিক সত্তার পাশাপাশি সামাজিক সত্তাকে কবিতা কি দেখিয়েছেন।
অপরদিকে জুলেখা এক মানবী আদর্শে পূর্ণ বিকশিত হয়েছে এই জুলেখা সুন্দরী প্রকল্প প্রগলভা বুদ্ধমূর্তি যপলা এক যুবতী তাকে না দেখেই আজিজ মিশরকে প্রতিরূপে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু পরে ভুল বুঝতে পেরে অন্তর জ্বালায় ক্ষতবিক্ষত হয়েছে এরপর সেই ইউসুফকে ভালোবেসেছে। এক্ষেত্রে তার অসঙ্গী মূর্তি তাকে দিশেহারা করে তুলেছে চির কল্যাণী নারীর সত্যতা তার মধ্যে বিকশিত হয়নি সে সাধারণ মানেবিরুপি চিহ্নিত হয়ে রইল। তবে জুলেখার প্রেমের তিনটি স্তর আমরা দেখতে পাই রূপের প্রতি আসক্তি কর্মের প্রতি আসক্তি এবং প্রেমের প্রতি প্রবল আকর্ষণ ।জুলেখা শেষ পর্যন্ত অন্তততন্ত্রের ক্ষতবিক্ষত নারীত্বের পরম প্রাপ্তিতে পুণ্য ও ধন্য হয়েছে।
কবি তার কাব্যে আঙ্গিক সচেতন ভাষা ছন্দ ও অলংকারের সার্থক প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। কাব্যটির মধ্যে প্রচুর প্রাকৃত ভাবাপন্ন শব্দের প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়।
এত মূল্য শুনি সাধু সকল নিরাশ।
জোলেখা আইল ঝাটে আজিজক পাশ।।
প্রাকৃত ভাষা বা মৈথিলি ভাষার প্রভাবে ষ>খ তে রূপান্তরিত হয়েছে। যেমন-
বিষ> বিখ, পুরুষ>পুরুষ
শুধু তাই নয়, এখানে দেখা যায় যৌগিক স্বরের সৃষ্টি। র এর স্থানে ন এর ব্যবহার, সর্বনাম ব্যবহারে কর্মকারকে ক্ বিভক্তির প্রয়োগে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ভাষারীতির সঙ্গে সাদৃশ্য আছে। এছাড়াও কাব্যছ বিভিন্ন রাগের উল্লেখ কবি করেছেন। যেমন মালসী, ধানসী, সুহী, ভাটিয়াল প্রভৃতি।
আসলে মুহাম্মদ সগীর বাইবেল, কোরান থেকে কাহিনী চয়ন করলেও বাংলার প্রকৃতি, পরিবেশ ও সমাজ বর্ণনায় বাস্তবতার পরিচয় দিয়েছেন। 'জোলেখার বারোমাসী'অংশে প্রকৃতি ও মানব মনস্তত্ত্ব মিশে গিয়েছে। আবার --
বাংলার রীতিনীতি, সমাজ সংস্কার, পারিবারিক জীবনের ছবি কবি বাস্তবতার সাথে চিত্রিত করেছেন। সমকালীন সমাজের বিনিময় প্রথা, অবৈধ প্রেম, সামাজিক অনুশাসন নিপুনভাবে বর্ণিত হয়েছে কাব্যে। বিশেষ করে মানব-মানবীর রোমান্টিক প্রণয়গাথার নিরিখে ইউসুফ জোলেখা পরবর্তী কাব্যধারাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে।আর সেই পথেই লোরচন্দ্রানী কিংবা লায়লা-মজনু র মতো কাব্য রচিত হয়েছে পরবর্তীকালে। সেজন্য মধ্যযুগের গতানুগতিক দেববাদভিত্তিক বাংলা সাহিত্যে সগীরের 'ইউসুফ-জোলেখা' মানব-মানবীর রোমান্টিক প্রেমকাব্য হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
ঠিক এরূপভাবে সাজেশন, বিষয়ভিত্তিক আলোচনার ভিডিও পেতে ভিজিট করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল "SHESHER KOBITA SUNDORBON"।
Comments
Post a Comment