Skip to main content

উনবিংশ শতকে বাংলার সামাজিক-ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনে রামমোহন রায়ের অবদান লেখো। West Bengal State University 4th Semester.

 উনবিংশ শতকে বাংলার সামাজিক-ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনে রামমোহন রায়ের অবদান লেখো। West Bengal State University 4th Semester.

ভূমিকাঃ

         আমরা জানি ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালির জীবনে ধর্ম, সমাজ, সাহিত্য ও রাজনীতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন দেখা যায়। আর সেই সকল পরিবর্তনের মূলে না থাকলেও প্রায় সবগুলোর সাথেই রামমোহন  রায়ের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ ছিল। আসলে হিউম্যানিস্টসুলভ অনুসন্ধিৎসা, সংস্কারসুলভ  মনোবল এবং ঋষিসুলভ প্রজ্ঞা রামমোহন এক যুগপ্রবর্তকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন।তবে--

             রামমোহন রায় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সমন্বয়ের মূর্ত প্রতীক ছিলেন। তাই ঊনবিংশ শতকে বাংলার ভূমিতে আংশিক হলেও যে নবজাগরণের বা নবযুগের সূচনা হয়েছিল, তার অগ্রদূত হিসেবে রামমোহনকে অভিহিত করলেও অত্যুক্তি হয় না।আসলে--

        রামমোহন ছিলেন এক অনন্য প্রতিভার অধিকারী। সংস্কৃত, আরবি ও ফরাসি ভাষায় ছিল তার অগাধ পাণ্ডিত্য। ইংরেজি, হিব্রু, গ্রিক ভাষাতেও ছিল তাঁর যথেষ্ট দক্ষতা। ফ্রান্সিস্ বেকন থেকে শুরু করে লক, হিউম, নিউটন প্রমুখ মনীষীগণের চিন্তাধারার সাথে ছিল তাঁর আন্তরিক পরিচয়।এমনকি আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ ও ফরাসি বিপ্লব তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। ধর্ম ও যুক্তিবাদের সমন্বয় সাধন করা সামাজিক ক্ষেত্রে কুসংস্কার মুক্ত স্বাধীন ও বলিষ্ঠ চিন্তা সূচনা করা এবং রাজনীতি ক্ষেত্রে স্বাধীনতা আন্দোলন করার ছিল তার জীবনের আদর্শ।আর এই কারণে তাকে ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ বলা হয়। আর বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার অবদান স্মরণ করে রামমোহনকে ভারত পথিক বলে উল্লেখ করেছেন।আসলে তিনি শুধু ভারত পথিক নয় তিনি বিশ্ব পথিক।

সমাজ সংস্কারক হিসেবে রাজা রামমোহন রায়ঃ-                         সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে রামমোহনের দান আজও চির স্মরণীয় হয়ে আছে। বর্ণাশ্রম প্রথা পরিহার না করেও তিনি জাতিভেদ প্রথার বিকৃত ফলাফলকে নিন্দা করেন। বাংলা তথা ভারতের সমাজ জীবনের অভিশাপ স্বরূপ 'সতীদাহ' নামক নিষ্ঠুর ও অমানবিক প্রথা দূরীকরণে তাঁর অবদান ছিল উল্লেখযোগ্য। রক্ষণশীল হিন্দু পন্ডিতের চোখরাঙানি ও বহু অত্যাচার সত্ত্বেও তিনি উচ্চকণ্ঠে এই বর্বর প্রথা রোধের দাবি জানান। অতঃপর -

              ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে তিনি প্রচার করেন যে, স্মৃতিশাস্ত্রে হিন্দু বিধবাদের সহমরণের কোন বিধান নেই। তবুও রক্ষণশীল পন্ডিতরা এর বিরুদ্ধে 'বিধায়ক' নামে একটি প্রচারপত্র বিলি করেন। আর তার প্রত্যুত্তরে রামমোহন ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দে আরেকটি পুস্তিকা প্রকাশ করে বিভিন্ন মুনিঋষি শাস্ত্রকারদের বক্তব্য ব্যাখ্যা করে দেখান যে, সতীদাহ প্রথা ধর্মসম্মত নয়। তাই এই পুস্তিকাগুলি তিনি ইংরেজি অনুবাদ করে রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে ইংরেজদের জনমত গড়ে তোলার চেষ্টাও করেছিলেন।তবে--    

              সমকালীন বেঙ্গল হরকরা, ইন্ডিয়া গেজেট, প্রভৃতি ইংরেজি পত্রপত্রিকাও সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। সতীদাহ প্রথা বিলেপের দাবি জানিয়ে তিনি গভর্নর জেনারেলের কাছে একটি গণস্বাক্ষর-সম্বলিত স্মারকলিপিও পেশ করেন। তবে তৎকালীন ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ হিন্দু ধর্মে হস্তক্ষেপ হবে এই ভয়ে বিষয়টি সম্পর্কে কিছুটা উদাসীনতা দেখান। কিন্তু--

          পরবর্তীতে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক বড়লাট হিসেবে যোগ দিলে অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন ঘটে।তবে বেন্টিঙ্ক এই বর্বর প্রথা রদ করার জন্য উদ্যোগী হন। এই এমন পরিস্থিতিতে রামমোহনের সাথে তাঁর কিছুটা মতভেদ দেখা দেয়। কিন্তু রামমোহন আইন জারি করে সতীদাহ প্রথা রোধের পক্ষপাতির ছিলেন না। তিনি চেয়েছিলেন প্রচারের মাধ্যমে হিন্দু-জনমতে পরিবর্তন দ্বারা এই ব্যবস্থার অবসান ঘটাতে। অবশেষে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে এক রেগুলেশন জারি করে সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করেন। আর রামমোহন রায় সেই আইনকে স্বাগত জানাতে দ্বিধা করেননি।তবে-

          এখানে বলে রাখা ভালো যে, রামমোহনের সক্রিয় সহযোগিতার ছাড়া সতীদাহ প্রথা নিবারণ বেন্টিঙ্কের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এছাড়াও রামমোহন রায় হিন্দু রমণীদের স্বামী বা পিতার সম্পত্তির অধিকার স্বীকৃতি আদায় করে নেয়। শুধু তাই নয় তিনি জাতিভেদ প্রথার বিরোধিতা করে অসবর্ণ বিবাহকে সমর্থন জানান। শুধু তাই নয়,পুরুষদের বহুবিবাহকে তিনি অবৈধ ও শাস্ত্রবিরোধী বলে ব্যাখ্যা করেন। অবশেষে তিনি বিধবাবিবাহকে পরিপূর্ণ সমর্থন জানিয়ে প্রচার করেন। 

ধর্মীয় সংস্কারে রামমোহন রায়ঃ-                                                আমরা জানি ভারতীয় সমাজ প্রধানত ধর্মাশ্রী। তাই ধর্মীয় ভ্রান্ত ধ্যানধারণাগুলিই কুসংস্কার রূপে সমাজ জীবনকে গ্রাস করেছিল। রামমোহন সনাতনী হিন্দু ধর্মের ক্ষেত্রে যে নতুন ভাবনার সূচনা করেছিলেন, তা একেবারে ধর্মে ও সমাজসংস্কারের ভিত্তি রচনা করেছিল। আর সেকারণেই রামমোহনকে বিভিন্ন ধর্মবিষয়ে তুলনামূলক আলোচনাশাস্ত্রের প্রবর্তক বলা যায়। তবে বিভিন্ন ধর্মশাস্ত্র ও অধ্যয়ন করে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, সকল ধর্মই মূলত একেশ্বরবাদী। তবুও-

      রামমোহন রায় বেদ ও উপনিষদ ব্যাখ্যা করে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, প্রাচীন হিন্দু শাস্ত্রে নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনাই শ্রেষ্ঠ ধর্ম বলে স্বীকৃত হয়েছে। তাই বহু দেবদেবীতে বিশ্বাস, প্রতিমাপূজা ও অর্থহীন আচার-অনুষ্ঠান প্রকৃত হিন্দু ধর্মের বিরোধী।আর এই উদ্দেশ্যে তিনি বেদান্তের ভাষ্য রচনা করেন এবং 'কেন' ও 'কন্থ' প্রভৃতি উপনিষদ প্রকাশ করেন। তাঁর ধর্মবিশ্বাস আলোচনার জন্য রামমোহন১৮১৫ সালে 'আত্মীয়তা' স্থাপন করেন। পরে ১৮২১ সালে 'ইউনিটারিয়ান' কমিটি নামে আর একটি সংস্থা গঠন করেন।তবে-

                জনপ্রিয় না হওয়ায় ১৮২৮ সালে অধিকতর আদিত্য সুসংবদ্ধ 'ব্রাহ্মসভা' প্রতিষ্ঠা করেন।ব্রাহ্মসমাজ নাম দিয়ে এই সভা ভারতবর্ষের ধর্ম ও সমাজ জীবনে বিভিন্ন প্রগতি সাধন করেছিল। এই সভার অধিবেশনে বেদ, উপনিষদ পাঠ, বৈদিক শ্লোকের ব্যাখ্যা ও সংগীত পরিবেশিত হতো। পরম শ্রদ্ধার সাথে সকলেই জাতি, ধর্ম, সম্প্রদায়, সামাজিক পদমর্যাদা নির্বিশেষে এই সভায় যোগদান করতে পারতেন ।তবে-

                  এই সভায় পান-ভোজন, প্রাণীহিংসা, চিত্র বা প্রতিমূর্তি ব্যবহার, অপর সম্প্রদায়ের সমালোচনা, ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ প্রভৃতি নিষিদ্ধ ছিল। ব্রাহ্মসভা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রামমোহন কোন নতুন সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠা না করলেও প্রচলিত হিন্দু ধর্মের মূলে কুঠারাঘাত করেছিলেন।যার ফলে একদিকে যেমন হিন্দুধর্মের বহু সংস্কার সাধিত হয়েছিল, তেমনি কালক্রমে ব্রাহ্মসভা 'ব্রাহ্মসমাজ' নাম দিয়ে একটি স্বতন্ত্র সম্প্রদায়ে পরিণত হয়েছিল।

Comments

Popular posts from this blog

জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে বুদ্ধিবাদ বা প্রজ্ঞাবাদ(Rationalism)আলোচনা করো। (For BA. Second Semester & Higher Secondary Course)

 জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে বুদ্ধিবাদ বা প্রজ্ঞাবাদ(Rationalism)আলোচনা করো। (For BA. Second Semester & Higher Secondary Course) ভুমিকাঃ আমরা জানি জ্ঞানের উৎপত্তি বা উৎস নিয়ে পাশ্চাত্য দর্শনে দুটি উল্লেখযোগ্য পরস্পর বিরোধী মতবাদ দেখা যায়। আর এই দুটি পরস্পর বিরোধী মতবাদের মধ্যে একটি অন্যতম মতবাদ হলো বুদ্ধিবাদ বা প্রজ্ঞাবাদ। আর সেই বুদ্ধিবাদ অনুসারে-        আমরা জানি পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসে বুদ্ধিবাদের প্রধান প্রবক্তা হলেন দার্শনিক ডেকার্ট। আর এই দার্শনিক ডেকার্টকে আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শনের জনক বলা হয়। তবে তার পরবর্তী বুদ্ধিবাদী দার্শনিক হিসেবে স্পিনোজা, লাইবনিজ এবং কান্ট বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। সেখানে জ্ঞান উৎপত্তিতে-- ডেকার্ট এর অভিমতঃ            দার্শনিক ডেকার্ট এর মতে দর্শনচিন্তার প্রথম সূত্র হলো সংশয় বা সন্দেহ। আর এই সংশয় নিয়েই দর্শন আলোচনা শুরু হয় এবং সুশৃংখল সংশয়-পদ্ধতির মাধ্যমে সংসায়াতীত, স্বতঃপ্রমাণিত ও সার্বিক মূল সত্যে পৌঁছানো যাবে। এই মূল সত্য থেকে গাণিতিক অবরোহ পদ্ধতিতে সিদ্ধান্ত পাওয়া যাবে এবং তা অবশ্যই নির্মূল ও নির্ভরযোগ্য হবে। আর গণিতের অভ্রান্ততা এবং নিশ্চয়তাকে

ব্যাপ্তি কাকে বলে? ব্যাপ্তি কয় প্রকার ও কি কি? ব্যাপ্তিজ্ঞান লাভের উপায়/ব্যাপ্তিগ্রহের উপায় গুলি আলোচনা

 ব্যাপ্তি কাকে বলে? ব্যাপ্তি কয় প্রকার ও কি কি? ব্যাপ্তিজ্ঞান লাভের উপায়/ব্যাপ্তিগ্রহের উপায় গুলি আলোচনা করো। ব্যাপ্তি:- ন্যায় দর্শনমতে ব্যাপ্তি জ্ঞান হলো অনুমিতির অপরিহার্য শর্ত। ব্যাপ্তিজ্ঞান ব্যতীত অনুমিতির জ্ঞান লাভ সম্ভব নয়। সুতরাং আমরা বলতে পারি, যেখানেই ধূম সেখানেই বহ্নি। এই সাহচর্য নিয়ম হলো ব্যাপ্তি।                 এখানে সাহচর্য কথাটির অর্থ হলো সমনাধিকরণ। অর্থাৎ যেখানে যেখানে ধূম থাকবে সেখানে সেখানে বহ্নি থাকবে। আর নিয়ম কথাটির অর্থ হলো নিয়ত বা ব্যতিক্রমহীনতা। সুতরাং সাহচর্য নিয়ম কথাটির মানে হল ব্যতিক্রমহীন সাহচর্য। আর সেখানে ধুম ও বহ্নির অর্থাৎ হেতু ও সাধ্যের সাহচর্য নিয়মই হল ব্যাপ্তি।    ব্যাপ্তি দুই প্রকার।         ১) সমব্যাপ্তি           ২) বিষমব্যাপ্তি। ১। সমব্যাপ্তিঃ               সমব্যাপক দুটি পদের ব্যাপ্তিকে সমব্যাপ্তি বলা হয়। এখানে ব্যাপক ও ব্যাপ্য-র বিস্তৃতি সমান হয়। যেমন, যার উৎপত্তি আছে, তার বিনাশ আছে। উৎপত্তি হওয়া বস্তু ও বিনাশ হওয়া বস্তুর বিস্তৃতি সমান। উৎপত্তিশীল ও বিনাশশীল সমব্যাপ্তি বিশিষ্ট। ২। বিষমব্যাপ্তি/অসমব্যাপ্তি :-             অসমব্যাপক দুটির প

তৃতীয় সেমিস্টার ইতিহাস ছোট প্রশ্নোত্তর।

 ১) কুতুবউদ্দিন আইবক কে ছিলেন? উত্তর-কুতুবউদ্দিন আইবক গজনীর সুলতান মহম্মদ ঘুরির দাস ও সেনাপতি ছিলেন। তিনি দিল্লীর প্রথম তুর্কি সুলতান ছিলেন। তাঁর শাসনের শুরুর সাথে ভারতের এক নতুন যুগের সূচনা হয়। ২) নব্য মুসলমান কারা ছিলেন? কে তাদের দমন করেছিলেন? উত্তর - জালাল উদ্দিন ফিরোজ খিলজির আমলে হলান্ড বা আব্দুল্লা খানের নেতৃত্বে মোঘল আক্রমণ সংঘটিত হয় । তার আক্রমণ জালাল উদ্দিন কর্তৃক প্রতিহত হয় । সেই সময় কিছু বন্দি মঙ্গল জালাল উদ্দিনের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে । ধর্মান্তরিত হতে হবে এই শর্তে জালাল উদ্দিন তাদের আবেদনের সাড়া দেন। তারা এতে সম্মত হয় ।এই ধর্মান্তরিত মোঙ্গলেরা নব্য মুসলমান নামে পরিচিত। নব্য মুসলমানরা আলাউদ্দিনকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করলে সেই আলাউদ্দিন এর আদেশে একদিনে ৩০ হাজার নব্য মুসলমানকে হত্যা করে অর্থাৎ আলাউদ্দিন নব্য মুসলমানদের দমন করে। ৩) মালিক কাফুর দ্বারা বিজিত দাক্ষিণাত্যের দুটি রাজ্যের নাম করো। উত্তর - মালিক কাফুর ছিলেন সুলতান আলাউদ্দিনের একজন দক্ষ সেনাপতি । তাঁর দ্বারা দক্ষিণ ভারতের বিজিত রাজ্য দুটি হল দেবগিরি এবং বরঙ্গল। ৪) পাইবস ও সিজদা কি? উত্তর - পাইবস হল সম্রাটের প