ঘরে বাইরে উপন্যাসটিতে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব কতখানি আছে তা আলোচনা করো। (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্র বিশ্ববিদ্যালয় চতুর্থ সেমিস্টার বাংলা অনার্স)
ঘরে বাইরে উপন্যাসটিতে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব কতখানি আছে তা আলোচনা করো। (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্র বিশ্ববিদ্যালয় চতুর্থ সেমিস্টার বাংলা অনার্স)
ভূমিকাঃ
ঘরে বাইরে উপন্যাসটি ১৯১৬ সালে সবুজপত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। আর সেই উপন্যাসটি চৌদ্দটি পর্বে এবং বিমলার আত্মকথা দিয়ে শুরু ও তারই আত্মকথা দিয়ে শেষ হয়েছে। যেখানে স্বদেশী আন্দোলনের পটভূমিকায় রচিত এই উপন্যাসে একদিকে আছে জাতিপ্রেম ও সংকীর্ণ স্বাদেশিকতার সমালোচনা, অন্যদিকে আছে সমাজিক প্রভাব । বিশেষ করে নিখিলেশ বিমলা এবং সন্দীপ এই তিন চরিত্রের আকর্ষণ,বিকর্ষণের নিখুঁত বিশ্লেষণ।আছে নারী পুরুষের প্রেম মনস্তাত্ত্বিক সম্পর্ক ।তবে সম্পর্ক, আকর্ষণ-বিকর্ষণ যাই থাকুক না কেন, ঘরে বাইরে উপন্যাসটি আমরা নিঃসন্দেহে একটি রাজনৈতিক উপন্যাস বলে অভিধা করতে পারি। আর সেখানে আমরা দেখি--
ঘরে বাইরে" স্বদেশী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক উপন্যাস হিসেবেই অধিক পরিচিত।আর সেখানে গল্পের মূল চরিত্র নিখিলেশ,বিমলা এবং সন্দীপ।এই তিন চরিত্রের কারো না কারো আত্মজবানীতে প্রকাশ পেয়েছে উপন্যাসের মূল বিষয়। প্রকাশ পেয়েছে তিনজনের আত্মকথায় তাদের জীবনবোধ আর রাজনৈতিক বোধ । তবে আমরা বলতে পারি যে,এই তিনজনকে শুধুমাত্র তিনটি চরিত্র হিসেবে দেখলে আমাদের একটু ভুল হবে। কারণ এই তিন ধরনের চরিত্রগুলি হলো,চিন্তা-বিশ্বাসের মানুষের দূত। আসলে তাদের চিন্তা ও রাজনৈতিক মতাদর্শের পার্থক্য যেন সেই সময়ের বাংলাকেই প্রকাশ করছে। কিন্তু --
নিখিলেশ, বিমলা এবং সন্দীপ এই তিন চরিত্রের মধ্যে প্রকট হয়ে উঠেছে তাদের সম্পর্কের মনস্তত্ত্ব ও সামাজিক টানাপোড়েন। সেই সাথে উপন্যাসটির বিষয় মানসিক দ্বন্দ্ব, চাওয়াপাওয়া, শূন্যতাবোধ আর টানাপড়েন নিয়েই পরিসমাপ্তির সীমারেখার প্রান্তে এসে পড়েছে। তবে- এই মানসিক টানাপড়েনের মূলে আছে তাদের সম্পর্কের টানাপড়েন। নিখিলেশ আর বিমলা স্বামী-স্ত্রী। এক সময় তাদের মাঝে প্রবেশ করে সন্দীপ।তবে সন্দীপের ব্যক্তিত্ব শেষের খানিকটা অংশ বাদে প্রায় পুরোটা উপন্যাস জুড়েই আচ্ছন্ন করে রাখে বিমলাকে। অন্যদিকে সন্দীপও তার ব্যবহার করতে ছাড়ে না। আর নিখিলেশ যেন অন্যজগতের কেউ।তবে-
রাজনীতির পটভূমিতে এই উপন্যাসটি রচিত হলেও রাজনীতির কোন কথা বিশেষভাবে প্রাধান্য লাভ করেনি। এই উপন্যাসের পটভূমিতে আছে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের রেশ। যেখানে সন্দীপের চরিত্রটি রচনার মূলে তৎকালীন সময়ের রাজনৈতিক নেতার ছাপ পড়তেও পারে, তবুও রাজনীতির প্রত্যক্ষ কোন কথা এই উপন্যাসে নেই। তবে রবীন্দ্রনাথ একটি সত্যের উপনীত হতে চেয়েছিলেন। আর সেই সত্যটি হলো-
"সত্য প্রেমের পথ আরামের পথ নয়,
সে পথ দুর্গম। সিদ্ধিলাভ সকলের শক্তিতে
নেই এবং সকলের ভাগ্যেও ফলে না।"
কিন্তু দেশের প্রেমে যদি দুঃখ ও অপমান সহ্য করি, তাহলে মনে এই সান্ত্বনা থাকবে যে, কাঁটা বাঁচিয়ে চলবার ভয়ে সাধনায় মিথ্যাচারণ করিনি। যদিও রবীন্দ্রনাথ এ কথা নিখিলেশর মুখ দিয়ে বলিয়েছেন, কিন্তু ঔপন্যাসিকের এ কথা নিজের মনের।
উপন্যাসের পটভূমি পুরোপুরি রাজনৈতিক না হলেও এই উপন্যাসটিতে লেখকের রাজনৈতিক ভাবনা পরিচয় পাওয়া যায়।। ১৯১৬ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকালে কলকাতার জনজীবনে রাজনৈতিক চিন্তা, অস্থিরতা এবং কিছুটা অবিচলতা এসেছিল। আর এই চিত্র উপন্যাসে আমরা পাই। বলা যায় বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের ঢেউ তখন বাংলার রাজনৈতিক জীবনকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। উন্মাদনা সুস্থ চিন্তা বিচার বুদ্ধিকে তখন অবিচল করে তুলেছিল। আর কি বলার উক্তির মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ এ কথা স্পষ্ট করে তুলেছেন। আর সেখানে বিমলাকে বলতে শুনি-
"যে দেশের নামে যারা ত্যাগ করবে তারা
সাধক, কিন্তু দেশের নামে উপদ্রব যারা
করবে তারা শত্রু। তারা স্বাধীনতার গোঁড়া
কেটে স্বাধীনতার আগায় জল দিতে চায়।"
উপন্যাসটিতে আমরা দেখি বেশ কিছু ভন্ড ও অসাধু দেশ প্রেমিক স্বদেশী আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে আবেগে উচ্ছ্বাসে দেশের দুর্দশার জন্য অশ্রু বিসর্জন করে। তবে বলা যায় এটি ছিল তাদের আত্মপ্রচার এবং অহংকারের প্রকাশের চমক। কারণ তাদের কথাবার্তার মধ্যে ছিল চটকদারি, অন্তঃসারশূন্যতা, প্রতারণা। বলতে কোন বাধা নেই রবীন্দ্রনাথ সন্দীপকে এই ধরনের চরিত্র হিসাবে উপন্যাসে তুলে ধরেছেন। তবে তখনকার দেশপ্রেমিকদের মধ্যে কোন ভন্ডামী ছিল না ছিল না কোন চটকদারি তা তাদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল প্রবল আদর্শবাদী দেশনেতা। তারা দেশের স্বাধীনতার জন্য, দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বদ্ধপরিকর। তাই দেশের শৃঙ্খলা মোচনের জন্য ফাঁসির দড়ি তাদের কাছে কেবলমাত্র একটি দড়ি ছাড়া আর কিছুই নয়। আসলে তাদের মূল মন্ত্র ছিল বন্দেমাতরম সংগীত। তবে তারা সন্দীপের মত লম্পট ছিল না। সন্দীপ অনেক নারীর সর্বনাশ করেছে। আর বন্ধু নিখিলেশের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বিমলাকে নিয়ে মজা লুঠবার নানান ফন্দি এঁটেছে। আসলে রবীন্দ্রনাথ স্বদেশী আন্দোলনের সময় কিছু ভন্ড ব্যক্তির চরিত্রের দোষগুলি সন্দীপের চরিত্রের মধ্যে তুলে ধরেছেন। তবে
রবীন্দ্রনাথের মনে সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কে একটি ভিন্ন ধারণা ছিল বলা যায় তিনি সে যুগের স্বদেশী বিপ্লবীদের শ্রদ্ধার চোখে দেখেননি। তাই আমরা বলতে পারি, রবীন্দ্রনাথ দেশপ্রেমিকদের হেয় প্রতিপন্ন করেছেন। আর তার প্রমাণ পাওয়া যায় সবুজপত্রে এবং তার কয়েক বছর বাদে প্রবাসীতে তিনি নিজের পক্ষের কথা বলেন। কিন্তু তিনি ভালো করেই জানেন যে, দেশবাসীকে ক্ষেপিয়ে তুলে স্বাধীনতা আনা সম্ভব নয়। শুধুমাত্র বিদেশের জিনিস বর্জন করে স্বাধীনতা আনা সম্ভব নয়। আর এই জাতীয় মনোভাব তিনি নিখিলেশ এবং চন্দ্রনাথ বাবুর মাধ্যমে উপন্যাসে সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। তাই বলা যায়-
ঘরে বাইরে উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথের কিছু রাজনৈতিক চিন্তা চেতনার প্রকাশ ঘটেছে। আর সেখানে আমরা দেখি,উপন্যাসের পটভূমিকায় আছে বঙ্গভঙ্গ সময়কালে বিশেষ আন্দোলন।যে আন্দোলনের মধ্যে ছিল একটি রাজনৈতিক উত্তেজনা। আর সেই উত্তেজনার সুযোগ নিয়ে দেশের মধ্যে শুরু হয়েছিল উপদ্রব।সেই উপদ্রবের স্বরূপ উদঘাটিত হয়েছে আলোচ্য উপন্যাসে। আসলে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে জাতীয় উন্মাদনা দেশের মানুষের স্থির বুদ্ধিকে কিভাবে বিপদে চালিত করতে পারে, দেশের মানুষকে সঠিক পথের দিশা না দেখিয়ে বিপথে চালিত করতে পারে, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ রবীন্দ্রনাথের।আর ঘরে বাইরে উপন্যাসের মধ্যে আমরা পাই রবীন্দ্রনাথের সেই মনোভাবের পরিচয়। তবে-
রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সাথে এক সময় যুক্ত ছিলেন। যার ফলে তিনি এই আন্দোলনকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। এই আন্দোলনের দেশবাসীকে সঠিক পথের দিশা দিতে পারিনি। তাই রবীন্দ্রনাথ সেই সুযোগে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের যাবতীয় দুর্বলতা সমালোচনা করেন। তিনি আরো বলেন দেশপ্রেম যে ফ্যাশনে পরিণত হবে এটি তিনি দেখতে চাননি। তবে তিনি বিশ্বাস করতেন শুধুমাত্র বিদেশি জিনিস বয়কট শ্রেষ্ঠ পথ কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট তাঁর সন্দেহ ছিল। তৎকালীন সময়ে আরো দেখা যায় দেশবাসী দেশীয় কলকারখানা উৎপন্ন জিনিস কিনতে পাচ্ছেন না, আবার বিদেশি সস্তা জিনিস কিনতে গরিবদের বাধা দেওয়া হচ্ছে। এই বিষয়টি তিনি মনে প্রাণে মেনে নিতে পারেননি। আসলে ঘরে বাইরে উপন্যাসে স্বদেশী আন্দোলনের যথার্থতা তুলে ধরার কোন ইচ্ছাই রবীন্দ্রনাথের ছিল না। কিন্তু
রবীন্দ্রনাথ কখনোই রক্তাক্ত বিপ্লব পছন্দ করেননি। আবার ভন্ড দেশনেতার জন্য পুরনারীর শ্রদ্ধা দেখানোর মধ্যে রবীন্দ্রনাথের ব্যঙ্গবাণ দেখা গেছে। তবে সেদিনের যে আত্মত্যাগী মানুষগুলি বন্দেমাতরম মন্ত্র উচ্চারণ করে হাসির মঞ্চের দিকে অগ্রসর হয়েছিলেন তাদের তিনি শ্রদ্ধা জানাতে বিন্দুমাত্র কম্পিত হননি।
আমরা পূর্বেই বলেছি, রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সাথে গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন। তাই তিনি সেই আন্দোলনের অসঙ্গতি তুলে ধরতে দ্বিধা করেননি। তবে ধর্মকে বিক্রি করে দেশকে বড় করে তোলার যে পাশ্চাত্য শিক্ষা তা তিনি সমালোচনা করেছেন। তাই চন্দ্রনাথবাবুর মুখে আমরা শুনি-
"বিদেশ থেকে এ কী পাপের মহামারী
আমাদের দেশে প্রবেশ করলে।"
আসলে রাজনীতির কোন কথা এখানে এলে তা অতি প্রাসঙ্গিক। তবে তা কখনোই কাহিনী অঙ্গীভূত নয়।আর প্রেম সম্পর্কে নিখিলেশের একটি বিশ্বাস এবং তাকে কেন্দ্র করে পরীক্ষা প্রায়শই ঘরে বাইরে উপন্যাস স্থান পেয়েছে। নিখিল স্ত্রীকে ঘরে বন্দী করে রাখতে চায় না। বাইরে জগতে তাকে মুক্তি দিয়ে তাকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দেয় এবং তখন যদি স্ত্রী স্বামীকে ভালবাসে তবে তার পাওনা স্বার্থক বলে মনে আরে নিখিলেশ।
পরিশেষে আমরা বলতে পারি, নিখিলেশের বিপক্ষে সন্দীপকে উপন্যাসের দাঁড় করানো হয়েছে। বিমলা স্বামীর প্রতিপক্ষ হিসেবে যাকে দেখেছি বা পাচ্ছে সে আসলে ভন্ড, প্রতারক, অর্থলোভী, নারীমাংসলোলুপ আরও অনেক কিছু। তবে বিমলা যদি নিখিলেশের মতো সৎ এবং উদার অন্য পুরুষের মুখোমুখি হত তখন বিমলাকে নিয়ে নিখিলেশের পরীক্ষার ফলশ্রুতি মূল্যবান হতো বলেই মনে হয়। তাই আমরা বলতে পারি ঘরে বাইরে উপন্যাসটিতে যেমন আছে সামাজিক স্পর্শ তেমনি আছে রাজনৈতিক স্পর্শ।
ঠিক এরূপ আরো নোটসের আলোচনা ভিডিও, বিষয়ভিত্তিক সাজেশন পেতে ভিজিট করুন আমাদের "SHESHER KOBITA SUNDORBON" YOUTUBE CHANNEL এ।
Comments
Post a Comment