Skip to main content

গুপ্ত যুগের প্রশাসন/ শাসন ব্যবস্থার প্রকৃতি আলোচনা করো।

গুপ্ত যুগের প্রশাসন / শাসন ব্যবস্থার প্রকৃতি আলোচনা করো। (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, ইতিহাস মাইনর, দ্বিতীয় সেমিস্টার।)


ভূমিকাঃ কুষাণোত্তর পর্বে তথা চতুর্থ শতকের একেবারে প্রারম্ভে প্রধানত উত্তর ভারতকে কেন্দ্র করে যে গুপ্ত সাম্রাজ্য  প্রতিষ্ঠা হয়েছিল তা কালক্রমে বিস্তার লাভ করেছিল। তবে সাম্রাজ্যের বিস্তৃতির পশ্চাতে একটি দৃঢ় প্রশাসনিক কাঠামো যে ছিল সে বিষয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। গুপ্ত যুগের সমসাময়িক শিলারেখ তথা দামোদরপুর তাম্রশাসন,জুনাগড়লিপি ও ফা-হিয়েনের বিবরণ  ইত্যাদি বহু বিচিত্র প্রমাণ গুপ্ত শাসন ব্যবস্থার প্রকৃতি বিশ্লেষণের সাহায্য করে। পূর্ববর্তী শাসকদের মতো এ যুগেও শাসন ব্যবস্থার শীর্ষে ছিলেন সম্রাট। তবে রাজার মতামতই চূড়ান্ত। যদিও তিনি ইচ্ছে করলে পরামর্শ নিতে পারতেন। আসলে সম্রাট ছিলেন বিবিধ ক্ষমতার অধিকারী। তবে -

         মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের প্রায় ৫০০ বছর পর গুপ্ত রাজাগণ মগধে এক শক্তিশালী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। আর এখানে গুপ্ত শাসনব্যবস্থা সংক্রান্ত তথ্য আহরণের জন্য আমাদের প্রধানত লেখমালা, মুদ্রা ও সিলমোহরের মতো প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের উপর নির্ভর করতে হয়। তাছাড়া মনুস্মৃতি, যাজ্ঞবল্ক স্মৃতি, ফা-হিয়েনেরর বিবরণ স্মৃতিশাস্ত্রগুলিও গুপ্ত যুগের শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে ইতিহাসে বেশ আলোকপাত করে। আর সেখানে গুপ্ত যুগের শাসন ব্যবস্থায় আমরা  দেখি-

 ১) রাজাগণের উপাধিঃ

                আমরা জানি গুপ্ত সম্রাজ্যের প্রশাসনের শীর্ষে ছিলেন রাজা।সেযুগে গুপ্তরাজাগণ রাজা ও মহারাজা উপাধি ব্যবহার করেছিলেন। এছাড়াও মহারাজাধিরাজ অভিধাটি ব্যবহৃত হতো পরবর্তীকালে সম্রাটকে বোঝাতে। রাষ্ট্রপ্রধান কে বোঝাবার জন্য ব্যবহৃত হয় ভট্টরক ও পরমভট্টারক উপাধি।

২) উত্তরাধিকারঃ 

               গুপ্তযুগে সাধারণত নিয়ম মেনে জ্যেষ্ঠ পুত্রই সিংহাসন লাভ করতেন। তবে নিয়ম যাই হোক না কেন, বাস্তবে অনেক সময় অনুসৃত হতো-  

                "জোর যার মুলুক তার" 

এই নীতি। ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ক্ষমতাবান রাজপুত্র জ্যৈষ্ঠ না হয়েও অনেক সময় সিংহাসন অধিকার করতেন। এলাহাবাদ প্রশস্তি থেকে জানা যায়, সমুদ্রগুপ্ত জোষ্ঠপুত্র না হওয়া সত্ত্বেও পিতা প্রথম চন্দ্রগুপ্ত যোগ্যতার বিচারে তাকেই উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন।

৩) প্রধান পদাধিকারীগণঃ

                গুপ্তযুগে শাসন ব্যবস্থার শীর্ষে ছিলেন মন্ত্রী। আর অন্যান্য রাজকীয় পদাধিকারীদের মধ্যে ছিলেন মহাবলাধিকৃত(প্রধান সেনাপতি), মহদন্ডনায়ক (সামরিক প্রশাসক) এবং মহাপ্রতিহার (রক্ষা আধিকারিক)। সেখানে মহাবলাধিকৃতের অধীনে ছিলেন মহাসবপতি (অশ্বারোহী বাহিনীর প্রধান), ভটাস্বপতি (অশ্বারোহী বাহিনীর তত্ত্বাবধায়ক), মহাপীলুপতি (হস্তিবাহিনীর অধ্যক্ষ), সেনাপতি, বলাধিকৃত প্রভৃতি রাজপুরুষগণ নিযুক্ত থাকতেন। আর দন্ডনায়কদের উপরে যিনি প্রভুত্ব করতেন তাকে বলা হতো মহাদন্ডনায়ক। ঠিক তেমনি পতিহার বা রক্ষকদের কর্তাকে বলা হতো মহাপ্রতিহার।

৪) প্রাদেশিক শাসকঃ 

              গুপ্ত যুগে প্রদেশগুলি ভুক্তি নামে পরিচিত ছিল। আর সেখানে প্রদেশ শাসককে বলা হতো উপরিক।তবে রাজবংশের কেউ উপরিকের দায়িত্ব গ্রহণ করলে তাকে বলা হতো মহারাজপুত্র দেবভট্টারক। প্রদেশ বা ভুক্তিগুলি ছিল জেলা বা বিষয়ে বিভক্ত। জেলা বা বিষয়ে শাসন করতেন কুমারমাতা, আযুক্তক এবং বিষয়পতি। 

৫) বিচার ও রাজস্ব ব্যবস্থাঃ 

               গুপ্ত যুগে দেওয়ানী ও ফৌজদারি বিচার পৃথকভাবে সম্পন্ন করা হতো।তবে সে যুগে বিচার বিভাগে রাজাই ছিলেন সর্বেসর্বা।আর এ কাজে রাজাকে সাহায্য করতেন অন্যান্য বিচারক, মন্ত্রী ও ব্রাহ্মণরা। গ্রামে বিচার নিষ্পত্তি করা হতো গ্রামসভা গুলির মাধ্যমে। আর- 

     গুপ্তযুগে  রাজা রাজস্ব কর ও রাজস্ব আদায় করতেন। গুপ্ত যুগে রাজস্বের প্রধান উৎস ছিল ভূমি। শুধু তাই নয়,কর্মচারীদের বেতনের উপর কর ধার্য করা হতো। এছাড়াও বন্দর, ফেরিঘাট এবং সুরক্ষিত নগরের উপর বিশেষ কর ধার্য করা হতো।

৬) মন্ত্রিপরিষদঃ 

           মন্ত্রী সচিব কিংবা আমাত্যদের সহায়তায় রাজা বা সম্রাট শাসন পরিচালনা করতেন।আর সে যুগে সচিব আমাত্যদের মধ্য থেকে মন্ত্রীদের নির্বাচিত করার রীতি প্রচলিত ছিল । তবে গুপ্ত যুগে মন্ত্রীদের প্রধান কাজ ছিল রাজাকে পরামর্শ দেওয়া। শুধু তাই নয়,নানা জটিল সমস্যার সমাধান ও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করাই ছিল তাদের প্রধান কাজ ও কর্তব্য।

         পরিশেষে বলা যায় যে, গুপ্ত যুগের শাসন ব্যবস্থায় শীর্ষাসনে ছিলেন গুপ্ত সম্রাট। কিন্তু তিনি সাম্রাজ্যের কর্মচারীদের সঙ্গে তথা কেন্দ্রীয় প্রশাসনের সঙ্গে কোন মতেই নিবিড় যোগসূত্র স্থাপন করেননি। সেযুগে গুপ্তচর ব্যবস্থার প্রচলন দেখা যায় না, তবে ফা-হিয়েনের ব্যাখানুযায়ী কিছু পৌর প্রশাসনের অস্তিত্ব ছিল। কমছিল বিধি-বিধানের জন্য শাসকদের স্বৈরাচারী মনোভাব। তবে গুপ্ত শাসকেরা জেলা, গ্রাম ও নগর শাসনের ক্ষেত্রে বিকেন্দ্রীকরণ ঘটিয়ে পূর্বতন ব্যবস্থায় নতুনত্ব এনেছিলেন।। আর যার সূত্র ধরে আছে সাম্রাজ্যের শান্তি শৃঙ্খলা, যা এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থায় দেখা যায় না।


ঠিক এরূপ বিষয় ভিত্তিক আলোচনা সাজেশন এবং ভিডিও পেতে ভিজিট করুন আমাদের "SHESHER KOBITA SUNDORBON" YOUTUBE CHANNEL এ। ধন্যবাদ 🙏।

Comments

Popular posts from this blog

দর্শন প্রথম সেমিস্টার সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তর।

দর্শন প্রথম সেমিস্টার সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, মাইনর সিলেবাস)  ১)চার্বাক মতে ভূত কয়টি ও কি কি? উত্তরঃচার্বাক মতে ভূত চারটি- ক্ষিতি, অপ্ , তেজ ও মরুৎ ২) স্বভাববাদ কী? উত্তরঃ চার্বাক জড়বাদের ভিত্তি হল স্বভাববাদ। যে মতবাদ অনুসারে স্বভাব থেকেই ভূত সৃষ্টি, আবার স্বভাব থেকেই বিচ্ছেদ। যার জন্য ঈশ্বরকে স্বীকার করা প্রয়োজন নেই। ৩) অব্যাপ্যদেশ কথাটির অর্থ লেখো। উত্তরঃ অব্যাপ্যদেশ বলতে বোঝায়- অশাব্দ অর্থাৎ যাকে শব্দের দ্বারা প্রকাশ করা যায় না। ৫) জ্ঞান লক্ষণ প্রত্যক্ষ কাকে বলে?  কোন একটি ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে তার নিজের বিষয়ীভূত গুণ ছাড়াও যদি অপর একটি ইন্দ্রিয়ের বিষয়ীভূত গুণকে প্রত্যক্ষ করার হয়, তাহলে সেই প্রত্যক্ষকে জ্ঞানলক্ষণ প্রত্যক্ষ বলা হয়। ৬) ন্যায় মতে প্রমাণের প্রকার  উত্তরঃ ন্যায় মতে প্রমাণ চার প্রকার। প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান এবং শাব্দ। ৭) সন্নিকর্ষ কাকে বলে? উত্তরঃ ন্যায় মতে ইন্দ্রিয় ও কোন বাস্তব পদার্থের মধ্যে একপ্রকার বিশেষ সম্পর্ক ঘটলে তবেই আমাদের একটি বস্তুর প্রত্যক্ষজ্ঞান ।আর ঐ বিশেষ বিশেষ সম্পর্কের পারিভাষিক নাম হলো সন...

ব্রিটিশ(3rd.Sem) পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব

ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব(পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় তৃতীয় সেমিস্টার রাষ্ট্রবিজ্ঞান মাইনর সিলেবাস)। ব্রিটেনের সংবিধান অলিখিত বলে বিভিন্ন ঐতিহাসিক দলিল, শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতি, পার্লামেন্ট প্রণীত আইন প্রভৃতির মাধ্যমে পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব অর্জিত হয়েছে। ব্রিটেনের পার্লামেন্ট আইনানুগ সার্বভৌমত্ব অর্জন করেছে, রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব নয়। আর সেখানে আইনানুগ সার্বভৌমত্ব বলা হয়, কারণ-       যেকোনো বিষয়ে পার্লামেন্ট আইন প্রণনয়নের অধিকারী। এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র হওয়ায় পার্লামেন্টে কোন আইন প্রণয়নের সময় প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় না। কমন্সসভা তথা নিম্নকক্ষের সার্বভৌমত্বকেই বলা হয় পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব।     ••ব্রিটিশ পার্লামেন্টকে সার্বভৌমত্ব বলার কারণ- ১) পার্লামেন্টের ওপর আইনগত কোনরূপ বাধানিষেধ আরোপ করা যায় না। ২) পার্লামেন্ট প্রণীত আইনের বৈধতার ব্যাপারে আদালত কোন প্রশ্ন তুলতে পারেনা। ব্রিটেনের আদালত পার্লামেন্ট প্রণীত আইনের ওপর বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার দ্বারা সীমিত করতে পারে না। ৩) ব্রিটিশ পার্লামেন্টের আইন প্রণয়ন ক্ষমতার উপর শাসনবিভাগ অনুরূপ ন...

ইতিহাস (3rd Semester) সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর।

 তৃতীয় সেমিস্টার ইতিহাস মাইনর সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, তৃতীয় সেমিস্টার ইতিহাস মাইনর)। ১)বন্দেগান-ই-চাহালগানি বলতে কী বোঝায়? •উত্তরঃবন্দেগান-ই-চাহালগান বলতে চল্লিশ জন তুর্কি ও অ-তুর্কি দাসদের সমন্বয়ে গঠিত একটি বাহিনীকে বোঝায়। এই বাহিনীকে ডাল চালিশা বা তুরকান-ই- চাহালগানি নামে ডাকা হতো। ২)আমির খসরু কে ছিলেন? •উত্তরঃ আমির খসরু ছিলেন প্রখ্যাত সুফি সাধক বা আরেফ নিজামউদ্দিন আওলিয়ার ছাত্র এবং অন্যতম প্রধান খলিফা। যাঁকে 'ভারতের তোতা' উপাধি দেওয়া হয়েছিল। ৩) মহরানা প্রতাপ কে ছিলেন?  •উত্তরঃ মেবারের শিশোদিয়া রাজবংশের একজন হিন্দু রাজপুত রাজা ছিলেন মহারানা প্রতাপ সিং। যিনি রাজপুতদের বীরত্ব ও দৃঢ় সংকল্পের প্রতীক। বহু বছর ধরে তিনি মুঘল সম্রাট আকবরের সঙ্গে লড়াই করেন। ৪) জায়গীরদারী সংকট কী? •উত্তরঃ জায়গিরদারী সংকট ছিল মোগল সাম্রাজ্যের একটি অর্থনৈতিক সংকট। এই সংকটে জমি বা জায়গিরের অভাব দেখা দিয়েছিল। যার ফলে প্রশাসনিক খরচ মেটানো এবং যুদ্ধের খরচ বহন করা সম্ভব হতো না। ৫) দাক্ষিণাত্য ক্ষত কী? •উত্তরঃ দাক্ষিণাত্য ক্ষত বলতে ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীত...