মেঘনাদবধ কাব্যের তৃতীয় স্বর্গ অবলম্বনে প্রমীলার যে বীরঙ্গনা রূপ প্রকাশিত হয়েছে তা আলোচনা করো। (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, চতুর্থ সেমিস্টার, বাংলা অনার্স)।
ভূমিকাঃ আলোচনা শুরুতেই আমরা বলতে পারি যে,মেঘনাদবধ কাব্যখানির সাথে বাঙালি প্রাণের সম্পর্ক জড়িয়ে আছে অঙ্গাঙ্গিভাবে। আর সেই কাব্যখানি রচনা করতে গিয়ে কাব্যকার মধুসূদন দত্ত অন্য সব মহাকাব্য থেকে কাহিনী সংগ্রহ করলেও এবং সেই কাহিনীর পরিণতি একই রাখলেও কিছু স্বাতন্ত্রতা লক্ষ্য করা যায়। শুধু তাই নয়-
কাহিনীর বিষয়বস্তুর দিক থেকে এবং চরিত্রগত দিক থেকে বেশ কিছু যেমন পরিবর্তন করেছেন আবার তেমনি কিছু সংযোজনও করেছেন। আর সেই পরিবর্তন এবং সংযোজনে একাব্যে প্রমীলা চরিত্রটি হয়ে উঠেছে অনন্যা। তার প্রধান কারণ এই চরিত্রটি কাব্যকারের একান্তভাবেই মানস প্রতিমা। যেখানে মূল রামায়ণ গ্রন্থে প্রমীলা চরিত্রের কোন অস্তিত্ব বা উল্লেখ নেই। তবে-
প্রমীলা চরিত্রটি গঠনে মধুসূদন প্রাচ্য আদর্শ পাথেয় করে চরিত্রটি সৃষ্টি করেছেন। তবে মনে করা হয় এক্ষেত্রে বীরনারী রাণী লক্ষীবাঈ চরিত্র দ্বারা মধুসূদন বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত হতে পারেন। তবে এ কাব্যে প্রমীলা চরিত্রের মূল বৈশিষ্ট্য হলো তাঁর পতিব্রতা এবং সে প্রেমময়ী নারী। প্রসঙ্গত যোগীন্দ্রনাথ বসু বলেন--
'ইলিয়াডের রণসজ্জায় সজ্জিতা এথিনীর এবং
ঈনিডের অশ্বারোহণ নিপুনা সহসঙ্গিনী
কেমিলার চিত্র তাহার অস্পষ্ট কল্পনাকে
আরোও পরিস্ফুট করিয়াছিল ।"
(ঠিক এরূপ অসংখ্য বিষয়ভিত্তিক আলোচনা, সাজেশন, এবং ভিডিও পেতে ভিজিট করুন আমাদের SHESHER KOBITA SUNDORBON YOUTUBE CHANNEL)
প্রেম,পতিব্রতা প্রমীলার জীবনে একমাত্র কামনা বাসনা। আর সেই পতিব্রতা, সংস্কার প্রমীলার চরিত্রে যেভাবে প্রকাশিত হয়েছে তা হিন্দু বিবাহিতা নারীর কথা আমাদের মনে করিয়ে দেয়। তবে এ কাব্যে প্রমীলার আবির্ভাব কোনমতেই বীররসে জারিত নয়, বলা যায় করুণ রসে আবৃত, যা নিতান্তই পরম উপভোগ্য। আর এমন সুন্দর চরিত্রটি আমরা মেঘনাদবধ কাব্যে দেখতে পাই- প্রথম, তৃতীয়, পঞ্চম, সপ্তম এবং নবম সর্গে।তবে-
মেঘনাদবধ কাব্যে আমরা প্রথমে তৃতীয় স্বর্গে প্রমোদ উদ্যানে স্বামীর প্রতীক্ষায় দেখতে পাই প্রমীলাকে। আর সেখানে আমরা প্রমীলাকে দেখি অতি অস্থির মানসিকতা অবস্থায়। স্বামীর প্রত্যাবর্তনের বিলম্ব দেখে প্রমীলা ভীষণ অস্থির হয়ে উঠেছে। ঠিক এরকম অবস্থায় তার একমাত্র সাথী,সখী বাসন্তী। এই বাসন্তী প্রমীলাকে নানান ভাবে চেষ্টা করছে শান্ত করার, কিন্তু কিছুতেই প্রমীলা শান্ত হতে পারছে না। একটা অস্থিরতা উদ্বিগ্নতা প্রমিলাকে এই সময় আক্রান্ত করেছে। তাই সে আজ উদ্ভ্রান্ত। অন্যান্য দিনে ঠিক এমন সময়ে-
ফুল তুলে স্বামীর জন্য মালা তৈরি করে রাখতো প্রমীলা। স্বামীর আসার অপেক্ষায় ঠিক এইভাবে প্রমীলা সময় অতিবাহিত করত। আজও প্রমীলা তার স্বামীর জন্য মালা তৈরি করেছে। কিন্তু অন্যান্য দিনের মতো সময় যেন কিছুতেই আর যেতে চায়না, অপেক্ষার আর শেষ হয় না! এমন অস্থিরতা মন নিয়ে প্রমীলা বাসন্তীকে জানায়- সে কেন কোন মতে আর নিশ্চিত থাকতে পারছে না? তার মন আর আজ কিছুতেই বাগ মানতে চাইছে না। তাই প্রমীলা এই মুহূর্তে লঙ্কায় যেতে চায় শুধুমাত্র স্বামী মেঘনাদের সাথে মিলিত হওয়ার অভিলাষে। কিন্তু-
বাসন্তী বারেবারে প্রমীলাকে শান্ত হওয়ার আহ্বান জানায়। কিন্তু কোনমতেই প্রমীলা শান্ত হতে চায়না। তাই প্রমীলা আজ বাসন্তীর কোন কথা শুনতে চায় না। অবশেষে প্রমীলা সিদ্ধান্ত নেয় যে,রণসাজে সজ্জিত হয়ে সে লঙ্কায় প্রবেশ করবে। আর সেখানে আমরা দেখি প্রমীলাকে-
"হৈমময় কোষে
লোভে খরশান অসি, দীর্ঘমূল করে;
ঝলমলি ঝুলে অঙ্গে নানা আবরণ!-"
প্রমিলা লঙ্কার উদ্দেশ্যে রণ সজ্জায় সজ্জিত হয়ে যাত্রা শুরু করেন, পরনে তার চেড়ী পরিবৃত। আর এখানে প্রমীলার নিজের কথার মধ্যেই তার নিজের সম্পূর্ণ পরিচয় আবাসিত হয়েছে। আর সেখানে আমরা দেখি-
"অধরে ধরিল মধু, গরল লোচনে
আমরা; নাহি কি বল এ ভূজ মৃণালে।"
প্রমীলার রণসজ্জা তার সখীদের উদ্বুদ্ধ করেছিল। প্রমীলা এবং তার সখীদের যুদ্ধবেশ দেখে রামচন্দ্র এই সময়ে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েন। তবুও রামচন্দ্র তাদেরকে সসম্মানে লঙ্কাপুরীতে যাওয়ার অনুমোদন দেন। অবশেষে প্রমীলা স্বামীর সাথে মিলিত হয়। কিন্তু এখানে আমরা আশ্চর্যভাবে লক্ষ্য করলাম যে,স্বামীর সাথে মিলিত হওয়ার পরপরই তার রণসজ্জার আবরণ সম্পূর্ণভাবে অন্তর্ধান ঘটে। অবশেষে প্রমীলা পুনরায় গৃহলক্ষ্মীর পোশাকে স্বামীর সামনে আসে এবং অতঃপর সকলেই আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠে।
আমরা আলোচনার শুরুতেই আমরা বলেছিলাম যে, মেঘনাদবধ কাব্যে আমরা প্রমীলাকে দেখি পতিব্রতা নারী হিসাবে, প্রেমময়ী নারী হিসেবে।এই পতিব্রতা প্রমীলার চরিত্রের একটি অন্যতম বিশিষ্ট গুণ। এখানে স্বামীর সাথে মিলিত হওয়ার পর আমরা দেখি, স্বামীর সাথে মিলিত হওয়ার আগে প্রমীলার মনে যে সাহসিকতা, যে উদ্দামতা ছিল তা সম্পূর্ণভাবে অবসান হয়। প্রমীলা হয়ে যায় ঠিক আগের মত গৃহলক্ষী, পতিব্রতা এবং প্রেমময়ী প্রমিলাতে। আসলে প্রমীলার অসাধারণত্বের পশ্চাতে আছে তার অপরিসীম সাহস, বীরত্ব, জয় করার মানসিকতা। আর এর সব কিছুর সামনে আছে তার পতিব্রত্য। আছে লঙ্কার সংস্কার, রীতি-নীতি। আসলে প্রমীলা গৃহলক্ষী। আর সেই গৃহলক্ষী কখনো অদম্য সাহসিকতার অধিকারী আবার কখনো রণসজ্জায় সজ্জিতা দেবী দুর্গা, আবার বীরাঙ্গনা এবং প্রেমময়ী নারী হিসেবে নিজেই নিজের জায়গা দখল করে নিয়েছে।
Comments
Post a Comment