Skip to main content

মেঘনাথবধ কাব্যের ষষ্ঠ স্বর্গের নামকরণের সার্থকতা আলোচনা করো।

মেঘনাথবধ কাব্যের ষষ্ঠ স্বর্গের নামকরণের সার্থকতা আলোচনা করো।(West Bengal State University, Political Science, Second Semester, Minor Course)


ভূমিকাঃ-আমরা জানি মেঘনাদবধ কাব্যের ষষ্ঠ সর্গের মূল পটভূমি হল 'রামানুজ কর্তৃক মেঘনাদবধ।' আর সেখানে কাব্যকার মধুসূদন দত্ত এই ষষ্ঠ স্বর্গের সমাপনীতে  লিখলেন-

        "ইতি মেঘনাদবধে কাব্যে বধো নাম

                   ষষ্ঠঃসর্গঃ।"

এখন আমাদের বিচার করতে হবে মেঘনাথবধ কাব্যের ষষ্ঠ স্বর্গের এই নামকরণ কতটা যথার্থ। সেই আলোচনায় আমরা প্রথমেই বলতে পারি--

              মেঘনাথ বধের ষষ্ঠ সর্গই সমস্ত কাব্যের মধ্যে একটি নিকৃষ্ট অন্যতম সর্গ। কারণ রক্ষ বংশের প্রতি কবির অত্যাধিক সহানুভূতি ছিল। শুধু তাই নয়, এখানে বাল্মিকীকে পরিত্যাগ করে কবি হোমারকে আদর্শরূপে গ্রহণ করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। আর তার প্রধান কারণ হলো, কবি মধুসূদন রক্ষবীরদের বীরত্বে এমনই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, তাদের প্রতিপক্ষকও যে বীর, সে কথা তিনি একেবারেই ভুলে গেছেন। তবে আমরা বলতে পারি,এটি তাঁর প্রবল ধর্মবিশ্বাস ও ভ্রমের অপর কারণ। তবে জাতীয় ধর্মের প্রতি বিশ্বাস বা আস্থা থাকলে কবি কখনোই এরূপ নিকৃষ্ট ঘটনা পাঠকের সামনে তুলে ধরতে পারতেন না। সেই প্রসঙ্গে না গিয়ে তাঁর ষষ্ঠ স্বর্গ অনুসারে আমরা বলতে পারি-


              রামানুজ লক্ষণ দৈবাস্ত্র বর লাভ করে রামের কাছে এই বর কিভাবে তিনি পেলেন তা বর্ণনা করেন। প্রসঙ্গত তিনি রামচন্দ্রকে আরোও জানান যে, লঙ্কার অধিষ্ঠাত্রী দেবী চণ্ডী বলেছেন দেবতারা সকলেই তাদের প্রতি সুপ্রসন্ন। স্বয়ং ইন্দ্র দৈবাস্ত্র পাঠিয়েছেন। যে অস্ত্রগুলি নিয়ে বিভীষণের সাথে লক্ষণ নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগৃহে প্রবেশ করে মেঘনাদকে বধ করবেন। দেবী চণ্ডী আরো বলেন, তাঁর কৃপায় তাঁরা অদৃশ্য ভাবে যজ্ঞশালায় প্রবেশ করতে পারবেন। কিন্তু-

         রামচন্দ্র বিচলিত হয়ে বলেন যে, ঠিক শত্রু ভয়ে দেব নর সকলেই ভীত। এরূপ অবস্থায় তিনি কিভাবে লক্ষণকে পাঠাবেন। পাশাপাশি তিনি আরও ভাবতে থাকেন সীতা উদ্ধারের জন্য বৃথা চেষ্টা করে আর লাভ নেই। তিনি রাজ্য পিতা মাতা আত্মীয়-স্বজন সকলকে হারিয়েছেন। সাথে ছিল সীতা, সেও আজ রাবণ কর্তৃক অপহৃত। এরূপ অবস্থায় লক্ষণকে যদি হারাতে হয় তাহলে যুদ্ধে আর কাজ নেই! তবে রামচন্দ্রের এই আক্ষেপ দুর্বল চিত্তের যে পরিচয় পাওয়া যায় সেটি স্বাভাবিক। তবুও লক্ষণ দাদাকে বলেন-

       "দেবতার যেখানে সহায় সেখানে এই খেদ

          অনুচিত।"

তাই আজ যদি তিনি দাদার অনুমতি পান, আদেশ পান তাহলে লঙ্কায় প্রবেশ করে মেঘনাদকে বধ করতে সমর্থ হবেন। শুধু তাই নয়, দেবতাদের ইচ্ছার বিরোধিতা ঠিক এই সময় করা ঠিক হবে না। পাশাপাশি বিভীষণ রামচন্দ্রকে বলেন যে, স্বপ্নে দেবী তাঁকে আদেশ দিয়েছেন মেঘনাদকে বধ করতে লক্ষণকে সাহায্য করার জন্য। তবু রামচন্দ্র আশ্বস্ত হতে পারছেন না। ঠিক এমন সময়ে রামচন্দ্র দৈববাণী শুনলেন-

        'দেবাদেশ অবহেলা করা অনুচিত।'

অতঃপর রামচন্দ্র আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলেন যে,সাপ আর ময়ূরের এক যুদ্ধ বেঁধেছে।যে যুদ্ধে ময়ূরের মৃত্যু হয়, তখন সাপ গর্জন করতে লাগলো। যার ব্যাখ্যা বিভীষণ দিলেন,সাপের কাছে সর্পভক্ষক ময়ূরের মৃত্যু হয়েছে, যার অর্থ হল লক্ষণের হাতে মেঘনাদের মৃত্যু হবেই। অতঃপর --

                রামচন্দ্র কিছুটা আস্বস্ত হলেন এবং লক্ষণকে দৈবাস্ত্রে তিনি নিজে হাতেই সাজিয়ে দিলেন। অতঃপর লক্ষণ বিভীষণের সাথে দ্রুত অদৃশ্যভাবে যাত্রা শুরু করেন। এখানে আশ্চর্যভাবে দেখা গেল যে, লক্ষণ লঙ্কায় প্রবেশ করতেই মায়াবলে লঙ্কার সিংহদ্বার খুলে যায়, কিন্তু কেউ শব্দ শুনতে পেল না। শুধু তাই নয়, কেউ তাদেরকে দেখতেও পেল না। অতঃপর তাঁরা নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে গিয়ে দেখলেন মেঘনাদ সেখানে ধ্যানে মগ্ন। আর এই সুযোগে লক্ষণ অস্ত্র বের করলে তার শব্দে মেঘনাদের ধ্যান ভঙ্গ হয়। মেঘনাথ মনে করলেন যে, লক্ষণের রূপ ধরেই অগ্নিদেবতা তাঁর কাছে এসেছেন। তবুও মেঘনাদ তার আবির্ভাবের কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। আর লক্ষণ তাঁর আত্মপরিচয় দিয়ে দেব অসি কোষমুক্ত করে মেঘনাদকে আক্রমণ করতে উদ্যত হন। ঠিক সেই সময় মেঘনাদ লক্ষণকে জানালেন-

  "যদি সত্যিই তাঁর যুদ্ধে সাধ জাগে তা পূর্ণ করবেন।

    কিন্তু নিরস্ত্রকে আক্রমণ করা বীরধর্ম নয়।"

     অতঃপর লক্ষণ মেঘনাদকে জানালেন, তিনি শত্রু বধ করার জন্যই এখানে এসেছেন। তাই রাক্ষসের সাথে ক্ষাত্রধর্ম পালন অর্থহীন। তখন লক্ষণের এহেনও কথা শুনে মেঘনাদ তীব্রভাবে নিন্দা প্রকাশ করার সাথে সাথেই পূজার কোষা দিয়ে লক্ষণকে আঘাত করলেন। সেই আঘাতে লক্ষণ  মুর্ছিত হয়ে পড়লেও তাঁর কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে নিতে পারলেন না। তখন মেঘনাদ ভাবলেন এসবই দেবতাদের ষড়যন্ত্র। অতঃপর মেঘনাদ দরজার পাশেই দেখলেন কাকা বিভীষণকে। আর তখনই মেঘনাথ বুঝতে পারলেন যে, লক্ষণ কিভাবে এই নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে প্রবেশ করেছে। মেঘনাদ সবকিছু জানতে পেরে বিভীষণের প্রতি নিন্দা প্রকাশ করে অস্ত্রাগারের পথ ছেড়ে দিতে বললেন। আর তিনি পারলে তবে লক্ষণের সাথে তিনি যুদ্ধ করতে পারবেন। কিন্তু বিভীষণ রামচন্দ্রের দাস হওয়ার কারণে এ কাজ করতে পারবেন না তা মেঘনাদকে জানিয়ে দিলেন। অতঃপর বিভীষণ বিভীষণ মেঘনাদকে জানালেন যে---

       "রাবণের পাপের জন্য লঙ্কা আজ ধ্বংস হতে চলেছে।"


      অতঃপর আমরা আশ্চর্যভাবে লক্ষ্য করলাম যে, দৈব মায়ার কারণে লক্ষণ চেতনা ফিরে পেলেন এবং লক্ষণ মেঘনাদকে তীক্ষ্ণ শরে বিদ্ধ করতে লাগলেন। শর বিদ্ধ মেঘনাদ মাটিতে লুটিয়ে পড়েন এবং এক অস্থিরময় বেদনার মধ্যে তিনি একের পর এক পূজা পাত্র লক্ষণের দিকে নিক্ষেপ করলে তা মায়ার প্রভাবে লক্ষণের শরীরে আঘাত করতে পারে না। তবুও মেঘনাদ লক্ষণের দিকে এগিয়ে যেতে লক্ষ্য করলেন যে, দেবতারা তাকে আড়াল করে রাখছে। এমন দৃশ্য দেখে মেঘনাদ হতাশার মধ্যে ডুবে গেলেন। ঠিক এমন সুযোগে লক্ষণ দৈব অসি দিয়ে মেঘনাদকে বধ করলে তিনি মাটিতে পড়ে যান এবং অতঃপর মেঘনাদের মৃত্যু হয়! আর তখনই কাব্যকার মধুসূদন দত্ত জানান--

       "লঙ্কার পঙ্কজ রবি গেলা অস্তাচলে।"

আর এখানেই মেঘনাদবধ কাব্যের ষষ্ঠ সর্গের নামকরণের সার্থকতা- "ইতি শ্রীমেঘনাদ বধে কাব্যে বধো নাম ষষ্ঠঃ সর্গঃ।

Comments

Popular posts from this blog

জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে বুদ্ধিবাদ বা প্রজ্ঞাবাদ(Rationalism)আলোচনা করো। (For BA. Second Semester & Higher Secondary Course)

 জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে বুদ্ধিবাদ বা প্রজ্ঞাবাদ(Rationalism)আলোচনা করো। (For BA. Second Semester & Higher Secondary Course) ভুমিকাঃ আমরা জানি জ্ঞানের উৎপত্তি বা উৎস নিয়ে পাশ্চাত্য দর্শনে দুটি উল্লেখযোগ্য পরস্পর বিরোধী মতবাদ দেখা যায়। আর এই দুটি পরস্পর বিরোধী মতবাদের মধ্যে একটি অন্যতম মতবাদ হলো বুদ্ধিবাদ বা প্রজ্ঞাবাদ। আর সেই বুদ্ধিবাদ অনুসারে-        আমরা জানি পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসে বুদ্ধিবাদের প্রধান প্রবক্তা হলেন দার্শনিক ডেকার্ট। আর এই দার্শনিক ডেকার্টকে আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শনের জনক বলা হয়। তবে তার পরবর্তী বুদ্ধিবাদী দার্শনিক হিসেবে স্পিনোজা, লাইবনিজ এবং কান্ট বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। সেখানে জ্ঞান উৎপত্তিতে-- ডেকার্ট এর অভিমতঃ            দার্শনিক ডেকার্ট এর মতে দর্শনচিন্তার প্রথম সূত্র হলো সংশয় বা সন্দেহ। আর এই সংশয় নিয়েই দর্শন আলোচনা শুরু হয় এবং সুশৃংখল সংশয়-পদ্ধতির মাধ্যমে সংসায়াতীত, স্বতঃপ্রমাণিত ও সার্বিক মূল সত্যে পৌঁছানো যাবে। এই মূল সত্য থেকে গাণিতিক অবরোহ পদ্ধতিতে সিদ্ধান্ত পাওয়া যাবে এবং তা অবশ্যই নির্মূল ও নির্ভরযোগ্য হবে। আর গণিতের অভ্রান্ততা এবং নিশ্চয়তাকে

ব্যাপ্তি কাকে বলে? ব্যাপ্তি কয় প্রকার ও কি কি? ব্যাপ্তিজ্ঞান লাভের উপায়/ব্যাপ্তিগ্রহের উপায় গুলি আলোচনা

 ব্যাপ্তি কাকে বলে? ব্যাপ্তি কয় প্রকার ও কি কি? ব্যাপ্তিজ্ঞান লাভের উপায়/ব্যাপ্তিগ্রহের উপায় গুলি আলোচনা করো। ব্যাপ্তি:- ন্যায় দর্শনমতে ব্যাপ্তি জ্ঞান হলো অনুমিতির অপরিহার্য শর্ত। ব্যাপ্তিজ্ঞান ব্যতীত অনুমিতির জ্ঞান লাভ সম্ভব নয়। সুতরাং আমরা বলতে পারি, যেখানেই ধূম সেখানেই বহ্নি। এই সাহচর্য নিয়ম হলো ব্যাপ্তি।                 এখানে সাহচর্য কথাটির অর্থ হলো সমনাধিকরণ। অর্থাৎ যেখানে যেখানে ধূম থাকবে সেখানে সেখানে বহ্নি থাকবে। আর নিয়ম কথাটির অর্থ হলো নিয়ত বা ব্যতিক্রমহীনতা। সুতরাং সাহচর্য নিয়ম কথাটির মানে হল ব্যতিক্রমহীন সাহচর্য। আর সেখানে ধুম ও বহ্নির অর্থাৎ হেতু ও সাধ্যের সাহচর্য নিয়মই হল ব্যাপ্তি।    ব্যাপ্তি দুই প্রকার।         ১) সমব্যাপ্তি           ২) বিষমব্যাপ্তি। ১। সমব্যাপ্তিঃ               সমব্যাপক দুটি পদের ব্যাপ্তিকে সমব্যাপ্তি বলা হয়। এখানে ব্যাপক ও ব্যাপ্য-র বিস্তৃতি সমান হয়। যেমন, যার উৎপত্তি আছে, তার বিনাশ আছে। উৎপত্তি হওয়া বস্তু ও বিনাশ হওয়া বস্তুর বিস্তৃতি সমান। উৎপত্তিশীল ও বিনাশশীল সমব্যাপ্তি বিশিষ্ট। ২। বিষমব্যাপ্তি/অসমব্যাপ্তি :-             অসমব্যাপক দুটির প

তৃতীয় সেমিস্টার ইতিহাস ছোট প্রশ্নোত্তর।

 ১) কুতুবউদ্দিন আইবক কে ছিলেন? উত্তর-কুতুবউদ্দিন আইবক গজনীর সুলতান মহম্মদ ঘুরির দাস ও সেনাপতি ছিলেন। তিনি দিল্লীর প্রথম তুর্কি সুলতান ছিলেন। তাঁর শাসনের শুরুর সাথে ভারতের এক নতুন যুগের সূচনা হয়। ২) নব্য মুসলমান কারা ছিলেন? কে তাদের দমন করেছিলেন? উত্তর - জালাল উদ্দিন ফিরোজ খিলজির আমলে হলান্ড বা আব্দুল্লা খানের নেতৃত্বে মোঘল আক্রমণ সংঘটিত হয় । তার আক্রমণ জালাল উদ্দিন কর্তৃক প্রতিহত হয় । সেই সময় কিছু বন্দি মঙ্গল জালাল উদ্দিনের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে । ধর্মান্তরিত হতে হবে এই শর্তে জালাল উদ্দিন তাদের আবেদনের সাড়া দেন। তারা এতে সম্মত হয় ।এই ধর্মান্তরিত মোঙ্গলেরা নব্য মুসলমান নামে পরিচিত। নব্য মুসলমানরা আলাউদ্দিনকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করলে সেই আলাউদ্দিন এর আদেশে একদিনে ৩০ হাজার নব্য মুসলমানকে হত্যা করে অর্থাৎ আলাউদ্দিন নব্য মুসলমানদের দমন করে। ৩) মালিক কাফুর দ্বারা বিজিত দাক্ষিণাত্যের দুটি রাজ্যের নাম করো। উত্তর - মালিক কাফুর ছিলেন সুলতান আলাউদ্দিনের একজন দক্ষ সেনাপতি । তাঁর দ্বারা দক্ষিণ ভারতের বিজিত রাজ্য দুটি হল দেবগিরি এবং বরঙ্গল। ৪) পাইবস ও সিজদা কি? উত্তর - পাইবস হল সম্রাটের প