ছোটগল্প হিসেবে “কাবুলিওয়ালা” নামকরণ কতটা স্বার্থক তা আলোচনা করো।
আমরা জানি সাহিত্যের নামকরণের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। আসলে নামকরণ চুম্বকের দুই আকর্ষণ বিন্দুর মতো-একবিন্দু আকর্ষণ করে পাঠককে আর অন্য বিন্দু আকর্ষণ করে কাহিনী ঘটনা ও চরিত্রের ত্রিবেণী সঙ্গম কে। গল্পকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গল্পের শীর্ষ নাম কে কখনো গল্পের শিষ্য নামকে কখনো কাহিনী বা ঘটনা বা চরিত্রের ঘাত-প্রতিঘাতের অপুর নির্ভর করান, আবার কখনো গভীর ব্যঞ্জনাশ্রয়ী নামকরণ করে থাকেন। আর কাবুলিওয়ালা গল্পে আমরা দেখি-
রবীন্দ্রনাথ এই গল্পের রহমতের পিতৃত্বকে গুরুত্ব দিলেও গল্পের নাম রহমত রাখেন নি। আসলে রবীন্দ্রনাথ শুধু রহমতের পিতৃত্বকে নয়, সকলের পিতৃত্বকে গুরুত্ব দিতে বিশেষ নামকরণের পরিবর্তে নির্বিশেষে নামকরণের কথা চিন্তা করেছেন। সেক্ষেত্রে ব্যক্তির নাম গল্পের মূল বক্তব্যকে যথার্থভাবে প্রতিপন্ন করতে পারত না।তবে-
আলোচ্য কাবুলিওয়ালা গল্পে দেখা যায় মিনি, কাবুলিওয়ালা রহমত, মিনির বাবা, এই তিন প্রধান চরিত্র। গল্পের প্রথম স্তরে রহমত ও মিনির বন্ধুত্ব প্রাধান্য লাভ করেছে। গল্পের মধ্যস্থরে আমরা দেখি মিনির বাবার প্রতিবেশী একজনের কাছ থেকে রহমত চাদর বিক্রির টাকা পেতো। কিন্তু প্রতিবেশী কাবুলিওয়ালার সেই পাওনা টাকার কথা অস্বীকার করলে উভয়ের মধ্যে বচসা শুরু হয়। আর সেই বচসার চরমক্ষণে রহমত তাকে চুরি মারে। ছুরি মারার অপরাধের রহমতের ৮ বছরের জেল খাটতে হয়। অতঃপর -
গল্পের অন্তস্তরে আমরা দেখি, আট বছর পর জেল থেকে ছাড়া পেয়ে রহমত সোজা চলে আসে মিনির সঙ্গে দেখা করতে। আর সেদিন ছিল মিনির বিয়ে। এমন শুভদিনে মিনির সাথে খুনি রহমতের দেখা হোক, এটা মিনির বাবা চাননি। এই ঘটনার পর রহমত মিনির বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়। ঠিক এই সময়ে রহমত কিছু মনে করে পুনরায় ফিরে আসে। কিছু আঙুর, কিসমিস, বাদাম মিনির হাতে তুলে দেওয়ার জন্য। আর এখানে রহমতকে বলতে শুনে-
“খোঁকির জন্য আনিয়া ছিলাম,তাহাকে দিবেন।”
ঠিক এই সময়ে মিনির বাবা তার দাম দিতে গেলে রহমত তার হাত চেপে ধরে বলে- মিনির মত তারও ঘরে একটি মেয়ে আছে, তাই মিনিকে দেখে তার মেয়ের কথাই মনে আসে। তার সেই মেয়ের মুখের কথা চিন্তা করে রহমত মিনির জন্য এইসব সামগ্ৰী নিয়ে এসেছে। এই ঘটনার পর আমরা দেখি-
কাবুলিওয়ালার মিনির প্রতি আকর্ষণের আসল কারণ বুঝে ফেলেন মিনির বাবা। কাবুলিওয়ালা রহমত তখন তার বুকের কাছ থেকে একটা ময়লা হাতে ছাপ বের করে দেখালো। আসলে রহমত একজন কাবুলিওয়ালা আর মিনির বাবা এক সম্ভ্রান্ত বংশীয় বাঙালি তা ভুলে গিয়ে বুঝলেন উভয়ে এক সিঁড়ির উপর দাঁড়িয়ে আছে, উভয়ই হলেন কন্যার পিতা, উভয়ের অন্তরে আছে কন্যার জন্য বাৎসল্য প্রেম। মিনির বাবা সঙ্গে সঙ্গে ভেতর থেকে মিনিকে ডেকে পাঠালেন। রাঙা চেলি পরা, কপালের চন্দন আঁকা, বধু বেশিনী মিনি স্বলজ্জভাবে সামনে এসে দাঁড়ালো। কাবুলিওয়ালা রহমত অনেক পরে হেসে মিনির কাছে সেই পুরনো কথা জানতে চাইলো-
“খুকি তুমি শ্বশুর বাড়ি যাবিস।”
মিনি এখন শ্বশুর বাড়ি অর্থ বোঝে। সে এখন আগের মত উত্তর দিতে পারল না, লজ্জায় আরক্ত হয়ে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়ালো। মিনি চলে গেলে রহমত দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাটিতে বসে স্পষ্ট বুঝতে পারলো, তার মেয়েটিও ইতিমধ্যে এখন অনেক বড় হয়েছে, তাকেও সে আগের মত তেমনটি পাবে না। কলকাতার গলির ভিতরে বসে কাবুলিওয়ালা রহমতের মনে এল আফগানিস্তানের এক মরু পর্বতের দৃশ্য। আর মিনির বাবা বিয়ের খরচ কিছু কমিয়ে রহমতকে কিছু টাকা দিয়ে নিজ দেশে মেয়ের কাছে ফিরে যেতে বললেন। ইলেকট্রিক বাতি না জ্বললে, গড়ের বাদ্য না বাজলেও মঙ্গল আলোকে আজ বিবাহ উৎসব উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
কাহিনী, ঘটনা চরিত্রের কেন্দ্রবিন্দু রয়েছে রহমত। রহমত নামে এক কাবুলিওয়ালার পিতৃত্ব গুরুত্ব লাভ করেছে। ঠিক এরূপ আফগানিস্তান থেকে হাজার হাজার কাবুলিওয়ালা এদেশের ব্যবসা করতে আসে। তাদের প্রত্যেকের রহমতের মত জীবন সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। তাই “কাবুলিওয়ালা”নামকরণের মাধ্যমে এক রহমত নয়, হাজার হাজার রহমতের জীবন সমস্যার গুরুত্ব লাভ করেছে। আর আমরা বলতে পারি- আলোচ্য গল্পটি“কাবুলিওয়ালা” নামকরণ সার্থকতা লাভ করেছে।
Comments
Post a Comment