তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবি উপন্যাসের ঠাকুরঝি চরিত্রটি আলোচনা করো।
আলোচনার শুরুতেই আমরা বলে রাখি যে, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবি উপন্যাসে নিতাইয়ের জীবনের সাথে নিবিড়ভাবে, অন্তরঙ্গতার সাথে ওতপ্রোতভাবে যে নারী চরিত্রটি জড়িয়ে আছে তার মধ্যে অন্যতম ঠাকুরঝি চরিত্র। আর এই নারী চরিত্রটির সাথে নিতাইয়ের প্রথম আলাপ এবং প্রথম প্রেম। বলা যায় নিতাইয়ের জীবনে প্রথম নারী ঠাকুরঝি,যে তার সাথে গভীরভাবে থেকেছে। আসলে এই ঠাকুরঝি কবি গানের প্রেরণার শক্তি। প্রসঙ্গত আমরা বলে রাখি ঔপন্যাসিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর 'আমার সাহিত্য জীবন' গ্রন্থে বলেছেন-
“ঠাকুরঝি চরিত্রটি তাঁর চোখে দেখা বাস্তব চরিত্র।
ঠাকুরঝির অস্তিত্ব আছে। সে গ্ৰামান্তরের রুইদাস
বংশের মেয়ে। চোখে ভীরু চঞ্চল হরিণীর দৃষ্টি।”
আসলে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এই ঠাকুরঝির চরিত্রের উপর কল্পনার রং মিশিয়ে বাস্তবসম্মত চরিত্র হিসেবে উপন্যাসে তুলে ধরেছেন। কিন্তু অতি পরিতাপের বিষয় এই চরিত্রটি পূর্ণভাবে বিকশিত বা প্রস্ফুটিত হওয়ার আগেই উপন্যাস থেকে মাঝপথে সে হারিয়ে যায়। এই ষোড়শীর রূপ, লাবণ্য, সৌন্দর্য অপরূপভাবে লেখক উপন্যাসে তুলে ধরেছেন। বলা যায় অপরূপ তার শ্রী। আর সেখানে আমরা দেখি-
নিতাইয়ের সাথে ঠাকুরঝির প্রথম আলাপ হয় বন্ধু রাজনের বাড়িতে। আর আলাপের পরেই তাদের মধ্যে আসে ঘনিষ্ঠতা। শুধুমাত্র ঘনিষ্ঠতা নয়, তাদের মধ্যে জন্ম নেয় এক নতুন জীবনের। শুধু তাই নয়, কবিগানের আসরে নিতাইয়ের উপস্থিত জবাব, সুমধুর কণ্ঠস্বর, বাকভঙ্গি ঠাকুরঝিকে অস্থির করে তোলে। আর এখান থেকেই ঠাকুরঝির মনে জন্ম নেয় মুগ্ধতা তন্ময়তা। তাই এখানে ঔপন্যাসিককে বলতে শুনি-
“ঠাকুরঝির অবগুন্ঠন খসিয়া পড়িয়াছে
দেহের বেশবাস ও অসম্বৃত।”
বলা যায় এটি ঠাকুরঝির জীবনে প্রেমের প্রথম ধাপ। অতঃপর দুধ দেওয়ার সূত্রে প্রতিদিন নিতাইয়ের সাথে ঠাকুরঝির সাক্ষাৎ হতো। আর এই সাময়িক সাক্ষাতের মধ্যে দিয়ে তাদের প্রেম প্রতিনিয়ত সামনের দিকে এগিয়ে চলে। আর এখানে একটি ঘটনার মধ্যে দিয়ে আমরা দেখি একদিন রাজন তার শালিকাকে কালো আলকাতার মত রং বলে উপহাস করে। আর সেই কথা শুনে নিতাই অত্যন্ত বেদনার সুরে বলে-
“কালো যদি মন্দ তবে কেশ পাকলে কাঁন্দ কেন”
নিতাইয়ের এই গান মুহুর্তের মধ্যে আমাদের মনের যাবতীয় মলিনতা মুছে দেয়। অতঃপর আমরা দেখি একটা সময় ঠাকুরঝি চায়ের দোকানে নিতাই এর সাথে কথা বলতে বলতে ঠাকুরঝির মাথার কাপড় খসে গেলে নিতাই তা দেখে উচ্ছসিত হয়ে পড়ে। কিন্তু ঠাকুরঝি মাথার কাপড়টি টেনে দিতে গেলে নিতাই তার হাত চেপে ধরে।আর নিতাইয়ের হাতের স্পর্শে ঠাকুরঝি ভীষণ লজ্জা পায়। তবে এখানে ঠাকুরঝি যত না বেশি লজ্জা পেয়েছে তার অধিক সে আনন্দ অনুভব করেছে। একটা সময অর্থের অভাবে নিতাই যোগান দুধ না নেওয়ার প্রস্তাব দিলে ঠাকুরঝি মন খারাপের সাথে চঞ্চল হয়ে ওঠে, সে নিতাইয়ের হাত দুটি চেপে ধরে বলে আমি বিনা পয়সার দুধ দিয়ে যাব। বলা যায়, এখানে নিতাই ও ঠাকুরঝির মধ্যে প্রেমের গভীর লক্ষণ বিকশিত হয়েছে। এই সময়ে ঠাকুরঝি নিতাইয়ের দেওয়া উপহার গলায় পরে জলের মধ্যে নিজের প্রতিবিম্ব লক্ষ্য করে। শুধু তাই নয়-
এই সকল ঘটনার মধ্যে অকসাৎ তাদের প্রেমের জীবনে নেমে আসে কালো অন্ধকারের ঘনঘটা। এই সময়ে নিতাই তার নিজের ঘরে বসন্তকে নিয়ে প্রেমালাপ, গান গাওয়া আরোও নানান কিছু ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। কিন্তু ঠাকুরঝি জানালা দিয়ে সেই সকল দৃশ্য দেখলে তার মনের ভেতরে একটা গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয়। আসলে-
ঠাকুরঝির জীবনে প্রেমের বাসার বেঁধেছিল বলেই এমন অন্ধকার দিন, এমন অভিশাপের দিন তার জীবনে নেমে আসে। অতঃপর ঠাকুরঝি সেই প্রেমের কাছে নতজানু হয়ে অকাল মৃত্যুবরণ করে। আর এই মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে ঠাকুরঝি তার প্রথম প্রেমের মূল্য দিয়ে থাকে।
পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, ঔপন্যাসিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ঠাকুরঝির চরিত্রের মধ্যে একটা মনোবিকর, মনোবিকলন মনস্তত্ত্বের চিত্র অঙ্কন করেছেন। যে মনোবিকার অতি বাস্তবসম্মত। তাই সমালোচকরা বলেন-
"ঠাকুরঝি যেহেতু পরকীয়া, স্বামীতে ও সংসারে
সুখী, সেহেতু নিতাইয়ের সঙ্গে তার সম্বন্ধ
সামাজিক সীমা লঙ্ঘন করতে পারে না।"
আর সামাজিক সীমার লঙ্ঘন করতে পারে না বলেই ঠাকুরঝির জীবনে নেমে এসেছিল কালো অন্ধকারের ছায়া।যার ফলে মৃত্যুর পথে যেতে ঠাকুরঝি বাধ্য হয়েছিল। আসলে এখানে ঔপন্যাসিক বিবাহোত্তর প্রেমের সম্পর্কে টিকিয়ে রাখতে চান নি বলেই ঠাকুরঝিকে মাঝপথে বিদায় নিতে হয়েছিল। আর এই মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে ঠাকুরঝি র চরিত্রটি অতি জীবন্ত হয়ে উঠেছে কবি উপন্যাসে।
ঠিক এরূপ অসংখ্য বিষয়ভিত্তিক আলোচনা সাজেশন এবং ভিডিও পেতে ভিজিট করুন আমাদের "SHESHER KOBITA SUNDORBON" YOUTUBE CHANNEL ।
Comments
Post a Comment