Skip to main content

ছুটি গল্পের কাহিনী বিশ্লেষণ করে এই গল্পের নামকরণ কতটা যুক্তিযুক্ত তা আলোচনা করো।

ছুটি গল্পের কাহিনী বিশ্লেষণ করে এই গল্পের নামকরণ কতটা যুক্তিযুক্ত তা আলোচনা করো।


আমরা জানি যে প্রকৃতির সাথে মানব মনের মেলবন্ধন হলেই সেখানে মানুষ হয়ে ওঠে প্রকৃতির সন্তান। আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছুটি গল্পটি তেমনিই এক দৃষ্টান্ত।যে গল্পটি ১২৯৯ সালে সাধনা পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়। প্রসঙ্গত আমরা বলতে পারি যে,রবীন্দ্রনাথ সাজাদপুরের পদ্মার ঘাটে একটা নৌকোর মাস্তুলকে গড়িয়ে গড়িয়ে একদল ছেলেরা মজার খেলার যে বর্ণনা দিয়েছেন, সেটাই মনে হয় ছুটি গল্পের প্রধান ভিত্তিভূমি। যেখানে–

          আমরা ছুটি গল্পের শুরুতেই দেখি, নদীর ধারে বিশাল এক শালকাঠ মাস্তুল তৈরি করার জন্য পড়েছিল। আর সেখানে যেসকল ছেলেমেয়েরা খেলা করছিল। তাদের মধ্যে বিশেষ করে বালকদের মধ্যে সর্দার ফটিক চক্রবর্তী। সেদিন তারা সকলেই সেই কাঠের গুড়িটি নিয়ে গড়িয়ে খেলার জন্য তৈরি হয়। ফটিকের এই কথায় সকলেই রাজি হয়ে যায়। কিন্তু আমরা আশ্চর্যজনক ভাবে দেখলাম যে,ফটিকের ভাই মাখন সেই কাঠের গুড়ির ওপর চেপে বসে রইল। সে কোনমতেই সেখান থেকে নামতে রাজি নয়। অতঃপর আমরা দেখি ছেলেরা সকলে মিলে সেই কাঠের গুড়িটি ঠেলে এবং তার ফলে মাখন মাটিতে পড়ে যায়। অতঃপর আমরা দেখি, মাখন কোনমতে উঠে ফটিককে বেধড়ক মারতে থাকে। ঠিক এরুপ পরিবেশের মধ্যে সেদিনের জন্য তাদের খেলা শেষ হলো। খেলাশেষে ফটিক বেশ কতকগুলি কাশ ছিড়ে একটা আধডোবা নৌকোর গলিতে বসে সেগুলি চুপচাপ করে চিবোতে থাকে। ঠিক সেই সময়ে–

            একটি বিদেশি নৌকা সেই নদীর ঘাটের কাছে এসে থামে। সেই নৌকা থেকে একজন প্রবীণ ভদ্রলোক নেমে ফটিককে জিজ্ঞাসা করলেন চক্রবতীদের বাড়ি ঠিক কোনদিকে? তখন ফটিক সেই ভদ্রলোককে বলেন সে জানে চক্রবর্তীদের বাড়ি কোন দিকে। ভদ্রলোকটি কোন কথা না বলে চলে গেলেন। ঠিক এমন সময়ে বাঘা বাগদি এসে ফটিককে জানায় যে, তার মা ডাকছে। ফটিক বাড়িতে আসলে তার মা জিজ্ঞাসা করে সে মাখনকে মেরেছে কিনা। সাবলীল ভাবে নির্দ্বিধায় তা অস্বীকার করে।কিন্তু মাখন বলে ওঠে মা, দাদা আমাকে মেরেছে। ফটিক তো ভীষণ রেগে গেল এবং রেগে গিয়ে মিথ্যা কথা বলার জন্য মাখনকে বেশ কয়েকটি চড় মারে। কিন্তু ফটিকের মাখনকে মারলে সে তার মাকে ঠেলে দেয়। ঠিক এরূপ গন্ডগোলের মধ্যে সেই বিদেশী ভদ্রলোক তাদের বাড়িতে আসেন। আর সেই বিদেশি ভদ্রলোকটি হলেন বিশ্বম্ভর বাবু অর্থাৎ ফটিকের মায়ের দাদা। বিশ্বম্ভর বাবু বহুদিন কাজের তাগিদে বাইরে ছিলেন, তাই তাদের পরিবারের সাথে কোন সংযোগ ছিল না। তবে-

           এখানে বিশ্বম্ভর বাবু বেশ কয়েকদিন ছিলেন। তারপর একদিন চলে যাওয়ার সময়ে তিনি জানালেন ফটিক অত্যন্ত দুর্দান্ত কিন্তু পড়াশোনা তার হচ্ছে না। তাই পড়াশোনা করার জন্য তার মামা কোলকাতায় নিজের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেন।আর শহর কোলকাতায় যাওয়ার আনন্দে ফটিক আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়।

           কলকাতায় মামার বাড়িতে এসে মামির সাথে আলাপ হল ফটিকের। মামার সংসারে তিনটি ছেলে নিয়ে নিজের নিয়ম শৃঙ্খলার মধ্যে মামি বেশ ভালো ছিলেন। আর এরূপ সময়ের মধ্যে অশিক্ষিত গেঁয়ো ফটিক আসাতে মামি ভীষণ বিরক্ত বোধ করেন। মামির ভালোবাসা হীনতায় ফটিক নিজেকে তাচ্ছিল্য মনে করে। তাই যে গ্রাম সে ফেলে এসেছিল, সেই গ্রামে তার মা, ছোট ভাই, সকলের জন্য তার মনটি আজ কেঁদে ওঠে।। আর সেই কারণে ফটিক তার নিজের বাড়িতে চলে যাবে বলে মামাকে জানায়। এরূপ অবস্থার মধ্যে- 

        ফটিক কোনদিন স্কুলে পড়াশোনা তৈরি করে যেত না। শুধু তাই নয়, ইতিমধ্যে স্কুলে ফটিক বইপত্র হারিয়ে ফেলে। মাস্টারমশাই প্রতিদিন তাকে প্রহার করেন। একদিন ফটিক তার মামিকে বই হারানোর কথা জানায়। মামি বিরক্ত হয়ে বললেন তিনি মাসের মধ্যে পাঁচবার বই কিনে দিতে পারবেন না। অতঃপর একদিন স্কুল থেকে ফিরে আসার পর ফটিকের জ্বর এলো। এই জ্বর অবস্থায় সঠিকভাবে একমাত্র মা ছাড়া অন্য কারোর কাছ থেকে সেবা যত্ন পাওয়া সম্ভব নয়। আর এই ভাবনা থেকে ফটিক তার মামার বাড়ি ত্যাগ করে শ্রাবণের বাদল ধারায় কোন এক রাতে। অতঃপর আমরা দেখি -

          বিশ্বম্ভর বাবু ঘুম থেকে উঠে দেখেন ফটিক নেই। চারিদিকে খোঁজ খবর পড়ে যায়। অবশেষে বিশ্বম্ভর বাবু নিরুপায় হয়ে পুলিশকে খবর দিলেন। আর সেদিনই সন্ধ্যার সময় অসুস্থ ফটিককে নিয়ে পুলিশ গাড়ি বিশ্বম্ভর বাবুর বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। এই সময় ফটিকের জ্বর অনেকটা বেড়ে যায়। সারারাত সে ভুল বকতে থাকে। বিশ্বম্ভর বাবু কোন উপায় না দেখে ডাক্তার ডাকলেন। এই সময়ে ফটিক তার রক্তবর্ণ চোখ খুলে মামাকে বলে--

          "মামা, আমার ছুটি হয়েছে কী?" 

বিশ্বম্ভর বাবু ফটিকের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে জানায়, সে তার মাকে আনতে লোক পাঠিয়েছে। 

       এদিকে খবর পেয়ে ফটিকের মা ঝড়ের বেগে চলে আসে।ফটিককে দেখে সে নিজেকে আর সামলে রাখতে পারেনি। তখন ফটিকের মা বলে ওঠে 

            "ওরে ফটিক,বাপধন রে।"

ফটিক তার মাকে জানায়- 'মা, এখন আমার ছুটি হয়েছে মা, এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি।, 

             আসলে অতি শৈশব থেকে এই সমাজ সংসার থেকে ফটিক ছুটি চাইছিল। কারণ পড়াশোনা, কোন কাজকর্ম কিছু তার ভালো লাগতো না। সারাদিন হৈচৈ, খেলাধুলা করতে সে ভালবাসে। সে যেন বনের উন্মুক্ত পাখি। তাই বনের গান গাওয়াতেই ছিল তার প্রাণের আনন্দ। তাই সে খাঁচায় বন্দী হয়ে থাকতে চায়না। আর মামীর অনাদর, মাস্টারমশায়ের অত্যাচার এ সবই তার ছুটি চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা।এই শহর, এই সুন্দর প্রকৃতি থেকে সেই বন্দীজীবন থেকেই মুক্তি পেতে চায়। 

             পরিশেষে আমরা বলতে পারি, ফটিকের ছুটি হয়েছিল, ছুটি মিলেছিল। কিন্তু এই ছুটি তার স্কুল জীবনের ছুটি নয়। চিরতরে এই শহর কলকাতা, সমাজ, প্রকৃতি থেকে ফটিক জীবনের শেষ ছুটি নিয়েছিল। আর সেই ছুটি নিয়ে ফটিক প্রকৃতির অনাবিল আনন্দধামে চলে গেল! আর এই দিক থেকে আমরা বলতে পারি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর গল্পের নাম রেখেছিলেন ছুটি। আর সেই নামটি অবশ্যই সার্থকতায় পর্যবসিত হয়েছে এ কথা আমরা বলতেই পারি।


ঠিক এরূপ অসংখ্য বিষয়ভিত্তিক আলোচনা সাজেশন এবং ভিডিও পেতে ভিজিট করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল "SHESHER KOBITA SUNDORBON"

Comments

Popular posts from this blog

জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে বুদ্ধিবাদ বা প্রজ্ঞাবাদ(Rationalism)আলোচনা করো। (For BA. Second Semester & Higher Secondary Course)

 জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে বুদ্ধিবাদ বা প্রজ্ঞাবাদ(Rationalism)আলোচনা করো। (For BA. Second Semester & Higher Secondary Course) ভুমিকাঃ আমরা জানি জ্ঞানের উৎপত্তি বা উৎস নিয়ে পাশ্চাত্য দর্শনে দুটি উল্লেখযোগ্য পরস্পর বিরোধী মতবাদ দেখা যায়। আর এই দুটি পরস্পর বিরোধী মতবাদের মধ্যে একটি অন্যতম মতবাদ হলো বুদ্ধিবাদ বা প্রজ্ঞাবাদ। আর সেই বুদ্ধিবাদ অনুসারে-        আমরা জানি পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসে বুদ্ধিবাদের প্রধান প্রবক্তা হলেন দার্শনিক ডেকার্ট। আর এই দার্শনিক ডেকার্টকে আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শনের জনক বলা হয়। তবে তার পরবর্তী বুদ্ধিবাদী দার্শনিক হিসেবে স্পিনোজা, লাইবনিজ এবং কান্ট বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। সেখানে জ্ঞান উৎপত্তিতে-- ডেকার্ট এর অভিমতঃ            দার্শনিক ডেকার্ট এর মতে দর্শনচিন্তার প্রথম সূত্র হলো সংশয় বা সন্দেহ। আর এই সংশয় নিয়েই দর্শন আলোচনা শুরু হয় এবং সুশৃংখল সংশয়-পদ্ধতির মাধ্যমে সংসায়াতীত, স্বতঃপ্রমাণিত ও সার্বিক মূল সত্যে পৌঁছানো যাবে। এই মূল সত্য থেকে গাণিতিক অবরোহ পদ্ধতিতে সিদ্ধান্ত পাওয়া যাবে এবং তা অবশ্যই নির্মূল ও নির্ভরযোগ্য হবে। আর গণিতের অভ্রান্ততা এবং নিশ্চয়তাকে

ব্যাপ্তি কাকে বলে? ব্যাপ্তি কয় প্রকার ও কি কি? ব্যাপ্তিজ্ঞান লাভের উপায়/ব্যাপ্তিগ্রহের উপায় গুলি আলোচনা

 ব্যাপ্তি কাকে বলে? ব্যাপ্তি কয় প্রকার ও কি কি? ব্যাপ্তিজ্ঞান লাভের উপায়/ব্যাপ্তিগ্রহের উপায় গুলি আলোচনা করো। ব্যাপ্তি:- ন্যায় দর্শনমতে ব্যাপ্তি জ্ঞান হলো অনুমিতির অপরিহার্য শর্ত। ব্যাপ্তিজ্ঞান ব্যতীত অনুমিতির জ্ঞান লাভ সম্ভব নয়। সুতরাং আমরা বলতে পারি, যেখানেই ধূম সেখানেই বহ্নি। এই সাহচর্য নিয়ম হলো ব্যাপ্তি।                 এখানে সাহচর্য কথাটির অর্থ হলো সমনাধিকরণ। অর্থাৎ যেখানে যেখানে ধূম থাকবে সেখানে সেখানে বহ্নি থাকবে। আর নিয়ম কথাটির অর্থ হলো নিয়ত বা ব্যতিক্রমহীনতা। সুতরাং সাহচর্য নিয়ম কথাটির মানে হল ব্যতিক্রমহীন সাহচর্য। আর সেখানে ধুম ও বহ্নির অর্থাৎ হেতু ও সাধ্যের সাহচর্য নিয়মই হল ব্যাপ্তি।    ব্যাপ্তি দুই প্রকার।         ১) সমব্যাপ্তি           ২) বিষমব্যাপ্তি। ১। সমব্যাপ্তিঃ               সমব্যাপক দুটি পদের ব্যাপ্তিকে সমব্যাপ্তি বলা হয়। এখানে ব্যাপক ও ব্যাপ্য-র বিস্তৃতি সমান হয়। যেমন, যার উৎপত্তি আছে, তার বিনাশ আছে। উৎপত্তি হওয়া বস্তু ও বিনাশ হওয়া বস্তুর বিস্তৃতি সমান। উৎপত্তিশীল ও বিনাশশীল সমব্যাপ্তি বিশিষ্ট। ২। বিষমব্যাপ্তি/অসমব্যাপ্তি :-             অসমব্যাপক দুটির প

তৃতীয় সেমিস্টার ইতিহাস ছোট প্রশ্নোত্তর।

 ১) কুতুবউদ্দিন আইবক কে ছিলেন? উত্তর-কুতুবউদ্দিন আইবক গজনীর সুলতান মহম্মদ ঘুরির দাস ও সেনাপতি ছিলেন। তিনি দিল্লীর প্রথম তুর্কি সুলতান ছিলেন। তাঁর শাসনের শুরুর সাথে ভারতের এক নতুন যুগের সূচনা হয়। ২) নব্য মুসলমান কারা ছিলেন? কে তাদের দমন করেছিলেন? উত্তর - জালাল উদ্দিন ফিরোজ খিলজির আমলে হলান্ড বা আব্দুল্লা খানের নেতৃত্বে মোঘল আক্রমণ সংঘটিত হয় । তার আক্রমণ জালাল উদ্দিন কর্তৃক প্রতিহত হয় । সেই সময় কিছু বন্দি মঙ্গল জালাল উদ্দিনের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে । ধর্মান্তরিত হতে হবে এই শর্তে জালাল উদ্দিন তাদের আবেদনের সাড়া দেন। তারা এতে সম্মত হয় ।এই ধর্মান্তরিত মোঙ্গলেরা নব্য মুসলমান নামে পরিচিত। নব্য মুসলমানরা আলাউদ্দিনকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করলে সেই আলাউদ্দিন এর আদেশে একদিনে ৩০ হাজার নব্য মুসলমানকে হত্যা করে অর্থাৎ আলাউদ্দিন নব্য মুসলমানদের দমন করে। ৩) মালিক কাফুর দ্বারা বিজিত দাক্ষিণাত্যের দুটি রাজ্যের নাম করো। উত্তর - মালিক কাফুর ছিলেন সুলতান আলাউদ্দিনের একজন দক্ষ সেনাপতি । তাঁর দ্বারা দক্ষিণ ভারতের বিজিত রাজ্য দুটি হল দেবগিরি এবং বরঙ্গল। ৪) পাইবস ও সিজদা কি? উত্তর - পাইবস হল সম্রাটের প