চৈতন্যভাগবত গ্রন্থে চৈতন্যদেবের বাল্যলীলার পরিচয় দাও। (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা মেজর, দ্বিতীয় সেমিস্টার এন ই পি)।
ভূমিকাঃ আমরা জানি যে,বৃন্দাবন দাস এর চৈতন্যভাগবত গ্রন্থে আদিখণ্ডের চতুর্থ-পঞ্চম-ষষ্ঠ অধ্যায়ে চৈতন্যদেবের বাল্যজীবন ও বাল্যলীলার পরিচয় লিপিবদ্ধ আছে। আর চৈতন্যদেবের এই বাল্যজীবন এবং লীলা বৃন্দাবন দাস গ্রন্থটিতে এমনভাবে তুলে ধরেছেন যা অন্যত্রে ভীষণ দুর্লভ বলা যেতেই পারে। আর এই দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা বলতে পারি চৈতন্যদেবের বাল্যলীলা থেকেই চৈতন্যদেবের যুগাবতার হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে তার অসাধারণ আমরা বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত দেখেই জানতে পারি। তবে-
ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমায় চন্দ্রগ্রহণের দিনে চৈতন্যদেবের জন্ম হয়। আর জন্মের পর তাঁর নাম রাখা হয় নিমাই অর্থাৎ তাঁর বাল্যনাম নিমাই। তবে অনেকে মনে করেন যে, নিম গাছের নিচে তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন বলেই তার নাম রাখা হয় নিমাই। তবে এ কথা সার্বিক সত্য নয়। কারণ চৈতন্যভাগবতে বলা হয়-
নাম দুইবার সবে করেন বিচার।
স্ত্রীগণ বোলায়ে এক,অন্যে বোলে আর।।
আসলে নিমাইয়ের ভালো নাম ছিল বিশ্বম্ভর। তবে ছোটবেলায় নিমাই দেখতে অতি সুন্দর ও গৌরবর্ণ ছিল বলে তাঁর নাম হয় গৌরঙ্গ। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় যে, নিমাইয়ের অন্নপ্রাশনের সময় একটি থালায় অনেক উপকরণ সাজানো ছিল। আর তার মধ্যে অন্যতম ছিল ভাগবত গ্রন্থখানি। এমন দিনে নিমাই অনেক অনেক উপকরণের মধ্যে ভাগবত গ্রন্থখানি তিনি স্পর্শ করেছিলেন। আর এই ঘটনার পর সেদিন সকলেই মনে করেছিলেন যে, এই শিশু বড় হলে পন্ডিত হবে। শুধু তাই নয় , তাঁর মধ্যে মহাপুরুষের লক্ষণ আছে। তবে -
আমরা জানি নিমাই এর বাল্য জীবন কেটেছিল খুব বড় আদরের মধ্যে দিন। তবে এই নিমাই যেমন দুরন্ত ছিলেন, ঠিক ততোধিক ছিলেন প্রবল মেধাবী। আর এই মেধাবীর কারণে সেদিন থেকে নবদ্বীপবাসীরা নিমাই এর সমস্ত রকম দুরন্তপনা মনপ্রাণে মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু-
চৈতন্যভাগ গ্রন্থ থেকে আমরা আরও জানতে পারি যে বাল্যকাল থেকেই নিমাই অসাধারণ গুণের অধিকারী। তার রূপের প্রতি সকলেই আকৃষ্ট ছিলেন। সেই সাথে তাঁর ছিল অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা। আমরা আগেই বলেছি যে, নিমাই ছিলেন চঞ্চল ও দুরন্তপনা। আর এখানে বৃন্দাবন দাস তার বাল্য জীবনের পরিচয় দিতে গিয়ে কৃষ্ণলীলার সাথে সামঞ্জস্য খুজেছেন। চৈতালির বাল্য জীবনে কিছু অলৌকিক লীলার প্রসঙ্গ এসে গেছে। আর সেখানে দেখা যায়-
এক তৈর্থিক ব্রাহ্মণের অতিথি রূপে জগন্নাথ মিশ্রের গৃহে অবস্থানকালে বালক দরজা বন্ধ থাকা সত্ত্বেও ঠাকুরের নৈবেদ্য উচ্ছিষ্ট করে দেন। এভাবে ভক্তের ডাকে ভগবানের সাড়া মেলার মধ্যে অলৌকিকতার সন্ধান পাওয়া যায় বলে মনে করা হয়।তবে-
বাল্যকালে নিমাই চঞ্চল ও দুরন্তপনা ছিলেন তার তার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় কতগুলি ঘটনার মধ্যে দিয়ে। আর সেখানে আমরা দেখি-
গঙ্গায় স্নানার্থদের গায়ে জল ছিটিয়ে দেওয়া, স্নানরত কারোর বস্ত্র টেনে নিয়ে যাওয়া, কারোর পা ধরে জলে টেনে নিয়ে যাওয়া এরূপ নানান ঘটনা। শুধু তাই নয় এছাড়াও ছোটছোট বালকদের কানে জল ঢুকিয়ে মজা উপভোগ করতেন নিমাই। পাশাপাশি গঙ্গার তীরে নারী পুরুষের পোশাক পাল্টাপাল্টি করার দিকে নিমাইয়ের ভীষণ ঝোঁক ছিল। শুধু তাই নয়, স্নানের সময় একে অপরের সাথে ঝগড়া বাঁধিয়ে দেওয়ার দিকে তাঁর ভীষণ প্রবণতা ছিল। আসলে এই সকল দুরন্ত কোন কাজের মধ্যে দিয়ে নিমাই ভীষণ আনন্দ উপভোগ করতেন। তাঁর এই আনন্দ উপভোগের আরেকটা দৃষ্টান্ত আমরা পাই, মাঝেমাঝে বালিকাদের বিয়ে করার প্রস্তাব নিমাই নিজে দিতেন। আর তার ফলে-
নিমাই পন্ডিতের বাবা মায়ের কাছে এই সময়কালে নানান অভিযোগ ও নালিশ চলে যেত। কিন্তু মা শচীদেবী হাসিমুখে সেই সকল অভিযোগকারীদের নানান উপায়ে সন্তুষ্ট করতেন। আর এখানে মা শচীদেবীকে বলতে শুনি-
এই বুঝি মানুষ নহে শ্রীবিশ্বম্ভর।
মায়ারূপে কৃষ্ণ বা জন্মিল মোর ঘর।।
চৈতন্যভাগবত গ্রন্থ থেকে আমরা বালক নিমাইয়ের অসাধারণ মেধার পরিচয় পাই। এই গ্রন্থ থেকে আমরা আরও জানতে পারি যে কোন এক শুভদিনে নিমাইয়ের হাতেখড়ি হয়। হাতে খড়ি হওয়ার পরপরই নিমায়ের মনে পড়াশোনা এবং পাঠ্যপুস্তক এর প্রতি এক অসাধারণ ভক্তি শ্রদ্ধা আসে।আর ঠিক এই অল্প দিনের মধ্যে আমরা নিমাই এর মন মানসিকতার মধ্যে দেখতে পাই-
' দৃষ্টিমাত্র সকল অক্ষর লিখে যায়।'
পাশাপাশি কৈশোর কালে নিমাই এর মধ্যে পাণ্ডিত্য ভাব এক অসাধারণ পর্যায়ে চলে যায়। বাল্যকালে বিশ্বম্বরের গৃহসঙ্গী ছিলেন দাদা বিশ্বরূপ। আর এই বিশ্বরূপকে নিমাই খুব মান্যতা দিতেন। দাদাকে মান্যতা দিলেও বাবা ও মাকে কিন্তু বিন্দুমাত্র ভয়ে করতেন না। আর এখানে চৈতন্যভাগবত থেকে আমরা জানতে পারি-
'পিতা মাতা কাহারে না করে প্রভু ভয়।
বিশ্বরূপ অগ্রজ দেখলে নম্র হয়।।'
পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, নিমাই পন্ডিতের বাল্যকাল কেটেছে যেমন দুরন্তপনায়, ঠিক তেমনি শিক্ষায় দীক্ষায় তাঁকে নিয়ে গেছে এক বিশ্ময়কর পর্যায়ে। বলা যায় তার আচরণের মধ্যে এই বিস্ময়কর বিষয়টি অতি প্রকটিত ছিল। আসলে এখানে কবি বৃন্দাবন দাস ভক্তিরসের সাথে জীবনরসের প্লাবন সংমিশ্রণ করে চৈতন্যের ভাবমূর্তি সৃষ্টি করেছেন। আর তার ফলেই তাঁর চরিত্রের মধ্যে যেমন দুরন্তপনার চঞ্চলতা প্রকাশ পেয়েছে, ঠিক তেমনি অ-প্রকৃত ঘটনারও প্রকাশ পেয়েছে। সেই প্রকাশভঙ্গি কবি বৃন্দাবন দাস নিমাইকে এক অসাধারণ পর্যায়ে অবতীর্ণ করেছেন।
Comments
Post a Comment