ভারতীয় সাংবিধানিক ব্যবস্থায় লোকসভার অধ্যক্ষ বা স্পিকারের ক্ষমতা ও কার্যাবলী আলোচনা করো।
ভূমিকাঃ ভারতের সংবিধান প্রণেতারা ব্রিটেনের সংসদীয় শাসনব্যবস্থার অনুকরণ ভারতের সংসদীয় শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন করেছেন। আর সেই সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় একজন গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী ব্যক্তিত্ব হলেন লোকসভার অধ্যক্ষ বা স্পিকার। এখানে সংসদের নিম্নকক্ষ অর্থাৎ লোকসভার সভাপতিকে স্পিকার বা অধ্যক্ষ বলে অভিহিত করা হয়। এই স্পিকার হলেন লোকসভার মূল পরিচালক। আর সেই পরিচালকের নিয়োগ, ক্ষমতা ও কার্যাবলী সংবিধানে বিভিন্ন ধারায় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে-
নিয়োগের ক্ষেত্রে স্পিকারকে অবশ্যই লোকসভার সদস্য হতে হয়। আর সেখানে নবগঠিত এবং নবনির্বাচিত লোকসভার সদস্যরা প্রথম অধিবেশনে নিজেদের মধ্যে থেকে একজনকে অধ্যক্ষ পদে এবং অন্য একজনকে উপাধ্যক্ষ পদে নির্বাচন করে থাকেন। লোকসভার স্পিকারের কার্যকালের মেয়াদ পাঁচ বছর। তবে তিনি পদত্যাগ করলে,পদচ্যুত করা হলে, লোকসভার সদস্যপদ বাতিল হলে কিংবা কার্যকাল শেষের আগে অধ্যক্ষের মৃত্যু হলে অধ্যক্ষ পদ শূন্য হয়ে যায়। আর সেখানে সংবিধানের ৯৫/১ ধারানুসারে রাষ্ট্রপতি লোকসভার কোন সদস্যকে সাময়িকভাবে অধ্যক্ষের কাজ চালানোর জন্য নিযুক্ত করতে পারেন।
•অধ্যক্ষের ক্ষমতা ও কার্যাবলী•
•প্রশাসনিক ক্ষমতাঃ সংবিধান অনুসারে লোকসভার স্পিকারের কাজ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। লোকসভায় কখন কোন প্রস্তাব উত্থাপন করা হবে, কোন কোন বিষয়ে আলোচনা করা হবে, আলোচনায় কোন সদস্য অংশগ্রহণ করবেন এবং কতজন সেই আলোচনা অংশগ্রহণ করবেন, কি ধরনের প্রশ্ন উত্থাপিত হবে তা স্থির করবেন স্পিকার। তবে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ক্রমেই স্পিকার লোকসভার কার্যক্রম স্থির করে থাকেন। বলা যায়, তিনি লোকসভায় আলোচনা ও বিতর্ক নিয়ন্ত্রণ করেন এবং লোকসভার মধ্যে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকেন।
•অর্থবিল সংক্রান্ত ক্ষমতাঃ
লোকসভায় কোন বিল অর্থ বিল কিনা সে বিষয়ে সদস্যদের মধ্যে কোন প্রশ্ন দেখা দিলে সেক্ষেত্রে স্পিকারের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য করা হয়। আর এক্ষেত্রে অর্থবিল লোকসভায় গৃহীত হবার পর যখন রাজ্যসভায় সেই বিল পাঠানো হয় তখন ওই বিলটি যে অর্থবিল সে সম্পর্কে স্পিকারকে একটি সার্টিফিকেট প্রদান করতে হয়।
•সদস্যদের অধিকার সংরক্ষণঃ
লোকসভার স্পিকারের আরেকটি অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল লোকসভার সদস্যদের বিশেষ অধিকারগুলোকে রক্ষা করা। আর এখানে লোকসভার সদস্যরা যাতে বিশেষ অধিকার গুলি যথাযথভাবে ভোগ করতে পারেন সেদিকে তিনি সদা সর্বদা নজর রাখেন। তবে কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যদি লোকসভাকে অবমাননা করে বা সদস্যদের অধিকারে হস্তক্ষেপ করে, তাহলে স্পিকার লোকসভার পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট সেই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে শাস্তি দিতে পারেন।
•রাষ্ট্রপতির সাথে যোগসূত্র স্থাপনঃ
ভারতের সংসদীয় রীতি অনুযায়ী লোকসভার স্পিকার বা অধ্যক্ষ রাষ্ট্রপতি ও সংসদের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করে চলেন। আর সেই যোগসূত্রে রাষ্ট্রপতির বাণী, বার্তা, বক্তব্য প্রভৃতি বিষয়গুলি স্পিকারের মাধ্যমে সংসদে পেশ হয়। আসলে স্পিকারের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি ও সংসদ একে অপরকে বিভিন্ন বিষয়ে অবহিত করে।
•যৌথ অধিবেশনে সভাপতিত্বঃ
কোনবিল নিয়ে পার্লামেন্ট অর্থাৎ লোকসভা ও রাজ্যসভার মধ্যে বিরোধ সংঘটিত হলে সেখানে বিরোধের মীমাংসার জন্য রাষ্ট্রপতি উভয় কক্ষের যৌথ অধিবেশন আহ্বান করেন। আর এখানে সংবিধানে ১১৮/৪ ধারা অনুসারে স্পিকার যৌথ অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন।
•কমিটি সম্পর্কিত ক্ষমতাঃ
লোকসভার নির্বাচনের পর কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রতিবছরের শুরুতেই কতগুলি কমিটি গঠিত হয়। আর সেখানে লোকসভার স্পিকার সেই কমিটিগুলির সভাপতি নির্বাচিত হন। অতঃপর স্পিকারের নির্দেশে ও নিয়ন্ত্রণে থেকে কমিটিগুলি নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে থাকেন। বলা যায়, স্পিকারের নিয়ন্ত্রণাধীনেই কমিটিগুলি তাদের কার্যকরী সম্পাদন করে থাকে। আবার নিয়ম সম্পর্কিত কমিটি এবং কার্য পরিচালনা সম্পর্কিত কমিটি এর মতো গুরুত্বপূর্ণ কমিটিগুলির ক্ষেত্রে স্পিকার নিজেই সভাপতিত্ব করেন।
উপরিক্ত ক্ষমতা গুলি ছাড়াও ভারতের লোকসভার অধ্যক্ষের আরো কিছু ক্ষমতা আছে। আর সেই ক্ষমতা গুলি হল-লোকসভার স্পিকার হলেন সচিবালয়ের প্রধান, লোকসভার কোন সদস্যদের পদত্যাগ পত্রের বিচার তিনি করে থাকেন,এছাড়াও তিনি যৌথ অধিবেশনের সভাপতিত্ব এবং সংখ্যালঘু সদস্যদের স্বার্থরক্ষার ব্যাপারে তিনি সতর্ক থাকেন।
পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, উপরিক্ত আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে স্পিকারকে একজন সুদক্ষ ব্যক্তি হতে হবে এবং তাকে সকল রাজনীতির ঊর্ধ্বে থেকে সংসদের মধ্যে কাজ করতে হবে। কিন্তু বাস্তবে স্পিকারের পক্ষে রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করা সম্ভব নয়। কারণ বিভিন্ন সময় বিরোধী দলগুলি স্পিকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে পারেন এবং জানান। শুধু তাই নয়, তারা প্রতিবাদস্বরূপ সভাকক্ষ ত্যাগ করেন। পাশাপাশি তারা স্পিকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করতে দ্বিধা করেন না। তবে আমরা বলতে পারি এই ধরনের কাজ বা ঘটনা ভারতের গণতন্ত্র ও স্পিকারের পদমর্যাদার পক্ষে শুভদায়ক নয়।
ঠিক এরূপ অসংখ্য বিষয়ভিত্তিক আলোচনা সাজেশন এবং ভিডিও পেতে ভিজিট করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল SHESHER KOBITA SUNDORBON YOUTUBE CHANNEL
Comments
Post a Comment