তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবি উপন্যাসে নিতাই চরিত্রটির অবতারণার সার্থকতা কোথায় আলোচনা করো।
আলোচনা শুরুতেই আমরা বলে রাখি যে,তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবি উপন্যাসের একটি অন্যতম চরিত্র কবি নিতাই চরণ। এই নিতাই চরণ অতি নিম্ন বংশজাত এবং স্বল্প শিক্ষিত একজন কবি। তবুও এই চরিত্রটি গোটা উপন্যাসে তারই জীবনের কাহিনী এবং পরিনতি তুলে ধরা হয়েছে। বলা যায় এই নিতাই চরিত্রটি লেখক বাস্তব মাটি থেকে তুলে এনেছেন। আসলে নিজের চরিত্রটি একটি মানুষের ছায়া দিয়ে তৈরি। আর সেখানে আমরা দেখি-
নিতাই চরিত্রটি আমাদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় একটি চরিত্র। আর এই চরিত্রটিকে লেখক পঙ্কিল ও ঘৃণ্য জীবন থেকে একটি শান্ত শিষ্ট ভদ্র জীবনে উত্তরণের চেষ্টা করেছেন। তবে উপন্যাসে আমরা দেখি এই নিতাই এর পিতৃকুল মাতৃকুল উভয়ই ডাকাতি পেশার সাথে যুক্ত। আর তার জন্য তাদের অনেকেই জেল খেটেছে আবার কেউবা জেলের মধ্যে মরেছে। তবে নিতাই এই পেশার সাথে যুক্ত হওয়ার কোন চেষ্টা করেনি। বরং বলা যায় এই পেশা সে পরিহার করার চেষ্টা করেছে। এখানে সে বিদ্যালয়ে গিয়ে কিছু শিক্ষা গ্রহণ করে কবি প্রতিভা অর্জনের চেষ্টা করে। বলা যায় এই সামান্য শিক্ষা তাকে তার কবিত্বের পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য আলোর দিশা দেখায়। বলা যায়। শুধু তাই নয়-
নিতাইয়ের কয়েক বছরের শিক্ষা তার কবি প্রতিভা তার উত্তরণের পক্ষে অনেকটা সহজ দেয়। চৌর্যবৃত্তিকে নিতাই ভিন্ন চোখে দেখত বলেই একটা সময় ঘনশ্যাম গোঁসাই এর বাড়ির কাজ ছেড়ে দেয়। কারণ এই ঘনশ্যাম গোঁসাই জীবনের অন্তরালে ধান চুরির মত হীন কার্যে যুক্ত ছিল। অতঃপর সে জীবনের পেশা হিসেবে গ্রহণ করে কুলিগিরি। অবসর সময়ে এই নিতাই চরণ গান রচনা করে। আসলে কবিয়াল হিসেবে নিজেকে তুলে ধরার জন্য নিতাই চরণ অপ্রাণ চেষ্টা করে। কারণ তার জীবনে স্বপ্ন ছিল ঠিক তারিণী মন্ডলের মত কবিয়াল হয়ে ওঠা।আর এই সময়কালে-
ঠাকুরঝির সাথে তার প্রথম পরিচয় হয়। আর সেই পরিচয় ধীরে ধীরে প্রণয়ণের দিকে এগিয়ে যায়। আর এই সময়কালে গ্রামের চন্ডীমঙ্গলকে গান গেয়ে কবিয়াল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার গল্প এবং ঠাকুরঝির সাথে প্রেমের সম্পর্ক তাকে স্বপ্নরাজ্যে টেনে নিয়ে যায়। আর সেই স্বপ্নরাজ্যে নিতাই ভাবে ঠাকুরঝি আসলে পর-স্ত্রী। সে কি তার ঘর ভেঙে দেবে? এই প্রশ্ন নিতাইকে ভীষণভাবে বেদনা সঞ্চার করে। অতঃপর-
একদিন রাতে ঝুমুরের নায়িকা অসুস্থ বসন্তকে নিজের বাসায় সেবা করে এবং নিভৃত আলাপের মত্ত হয়। আর এরূপ দৃশ্য ঠাকুরঝি জানালা দিয়ে দেখলে তার জীবনের চরম বিপর্যয় সৃষ্টি করে। অবশেষে এক বুক ব্যথা নিয়ে নিতাই গ্রাম ত্যাগ করে এবং সেই ঝুমুর দলে যোগ দেয়। আর এখান থেকেই বসন্তকে ঘিরে তার নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখা শুরু হয়। কিন্তু-
•নিতাই ঝুমুর দলে যোগদান করল বটে কিন্তু তার মনের মধ্যে বসন্তকে নিয়ে দ্বিধা দ্বন্দ্বের শেষ থাকে না! অতঃপর ঝুমুর দলের প্রথম দিনেই আসরে বসন্ত নিতাইকে চড় মারে। এদিনই নিতাই বসন্তের মধ্যে একটি অন্য শক্তি অনুভব করে। নিতাইয়ের মাথায় দল ছেড়ে দেওয়ার চিন্তা আছে তার মনের মধ্যে আবারো দ্বিধা দ্বন্দ্ব শুরু হয় বসন্তকে নিয়ে।কারণ বসন্তের মধ্যে সে নারীসত্তার জাগরণ দেখে। এখানে তার মনের মধ্যে দুঃসহ চিন্তা এবং গভীর মমত্ববোধ সেই সাথে তার মানবতাবোধ এবং জীবনবোধ জাগ্রত হয়। কিন্তু ইতিমধ্যে বসন্তের মৃত্যু হলে নিতাই উদাসীন হয়ে পড়ে এবং কিছুদিনের জন্য সে কাশি গিয়ে বিশ্বনাথ দর্শন করে। তবুও তার মন শান্ত হয় না অবশেষে সে এক বিধবার কাছে গিয়ে কিছুটা সান্তনা পায়। আর সেই বিধবা নিতাইকে বাড়ি ফেরানোর চেষ্টা করে। তবে আমরা বলতে পারি-
•নিতাইয়ের মধ্যে যেহেতু রুচিবোধ, মানবতাবোধ থাকায় সে কখনো অশ্লীল গান আসরে গাইতে পারেনি। যার ফলে সে দলের মধ্যে জনপ্রিয়তা হারায় এবং সাধারণ দর্শক তার গান থেকে ই মুখ ফিরিয়ে নেয়। আসলে নিতাই একটি সত্যবাদী ন্যায়নিষ্ঠ চরিত্র হিসাবে লেখক উপন্যাসে তুলে ধরেছেন। তবে দর্শকরা তাকে ভাঁড়ামি ভরা গান গাইতে বললে সে কথা নিতাই কানে নেয় না। বলা যায় এখানে সেই পরাজয় মেনে নেয়। কিন্তু বসন্ত তার এই পরাজয় মেনে নিতে না পারায় রাগের মাথায় নিতাই কি চড় মারে। আর এখান থেকেই নিজের জীবন সম্পূর্ণভাবে ভিন্ন পথে মোড় নেয়। অবশেষে নিতাই মদ খাওয়া শুরু করে। এই জীবন গ্রহণ করে নিতাই অশ্লীল, ভাঁড়ামিভরা গান আসরে গিয়ে দর্শকের মনোরঞ্জন করে। বলা যায় এখানে তার চরিত্রের নৈতিক অধঃপতন শুরু হয়। তবে-
•নিতাইয়ের চরিত্রের মধ্যে আসে এক নতুন জীবনের দিশা যেখানে সে তার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করে। শুধু তাই নয় সে নিজেকে কবিয়াল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার আপ্রাণ চেষ্টা করে। আর এই চেষ্টার মধ্যে আমরা দেখতে পাই তার দৃঢ় মানসিকতা, মনুষত্ববোধ, মানবতাবোধ ও আত্মমর্যাদাবোধ। আর সেই বোধের মধ্যে একদিকে বসন্তের মৃত্যু অপরদিকে ঠাকুরঝির মৃত্যু তাকে উদাসী করে তোলে। এই উদাসী নিতাই কে দেখে আমরা নিঃসন্দেহে বলতে পারি তার মনের মধ্যে ছিল গভীর প্রেমিক সত্তা। তাই মোহিতলাল মজুমদার এই চরিত্রটি সম্পর্কে যথার্থই বলেছেন--
"নীলকন্ঠের মত সকল বিষ কণ্ঠে ধারণ
করিয়াও ওষ্ঠে করুণার সুধা হাস্য
কখনো হারায় না। ঝড়কে বক্ষ কপাট
উন্মুক্ত করিয়া দেয়।"
Comments
Post a Comment