বেন্থামের উপযোগবাদ ব্যাখ্যা করো।
ভূমিকাঃ আলোচনার শুরুতেই আমরা বলে রাখি যে, বেন্থাম একজন পরসুখবাদী দার্শনিক। আর তাঁর মতে সর্বাধিক সংখ্যক লোকের সর্বাধিক সুখ উৎপাদনই নৈতিক বিচারের মানদন্ড। বিভিন্ন সুখের মধ্যে কোন গুণগত পার্থক্য নেই। সব সুখই একই রকমের। তবে সুখের মধ্যে পরিমানগত পার্থক্য আছে। দৈহিক সুখ আর মানসিক সুখ গুণের দিক থেকে এক হলেও পরিমাণগত দিক থেকে তাদের মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে। দৈনিক সুখের পরিমাণ মানসিক সুখের থেকে অনেক বেশি। আসলে তাঁর মতে-
"যে কাজ অধিকাংশ লোকের দৈহিক সুখ
উৎপাদন করতে পারবে, সে কাজ ভালো,
আর যে কাজ তা পারবে না তা মন্দ।"
আসলে বেন্থাম দৈহিক সুখের উপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন বলে, তার মতবাদকে অসংযত বা স্থূল পরসুখবাদ বলা হয়। আর সে কারণে-
বেন্থাম সুখের পরিমাণ নির্ধারণ করতে গিয়ে ৭টি মানের কথা বলেছেন। আর সেই ৭টি মান নিম্ন সূত্রাকারে আলোচনা করা হলো -
•১) তীব্রতাঃ বেন্থামের মতে দুটি সুখের মধ্যে যে সুখের তীব্রতা বেশি সেই সুখই আমাদের কাম্য। দৈহিক সুখের তীব্রতা মানসিক সুখের তুলনায় অনেক বেশি। কাজেই দৈহিক সুখই সকলের কামনা করা উচিত
•২) স্তিতিকালঃ সমস্ত সুখের স্থিতিকাল বা স্থায়িত্ব এক নয়। কোন সুখ ক্ষণস্থায়ী আবার কোন সুখ দীর্ঘস্থায়ী। যেমন এক মিনিট ধরে রসগোল্লা খাওয়ার সুখ এবং এক ঘন্টা ধরে একটি ভোজ খাওয়ার সুখের স্থিতিকাল এক নয়। এখানে প্রথমটির তুলনায় দ্বিতীয়টির স্থিতিকাল অনেক বেশি। কাজেই দুটি সুখের মধ্যে যে সুখ দীর্ঘকাল স্থায়ী, সেই সুখই আমাদের কাম্য।
•৩) বিস্তৃতিঃ সুখের বিস্তৃতি বলতে আমরা বুঝে থাকি যে, যা অধিকাংশ লোকে ভোগ করতে পারে। দুটি সুখের মধ্যে যে সুখটি অধিক সংখ্যক লোকে ভোগ করতে পারে তাই সকলেরই কাম্য। সুতরাং যে সুখ সব থেকে বেশি লোক ভোগ করতে পারে, সেই সুখের বিস্তৃতি আছে বুঝতে হবে।
•৪) নৈকট্যঃ দুটি সুখের মধ্যে যে সুখটি কাছের বা নিকটের সেই সুখটিকে কামনা করা আমাদের উচিত। ভবিষ্যতের সুখের আশায় বর্তমানে সুখে কোন মতেই হাতছাড়া করা উচিত নয়।
•৫) বিশুদ্ধিঃ বিশুদ্ধ সুখ হল অবিমিশ্র সুখ অর্থাৎ যার মধ্যে কোন দুঃখের মিশ্রণ নেই। কাজেই দুঃখ বিহীন সুখই সকলের কাম্য হওয়া উচিত।
•৬)উর্বরতাঃ উর্বর সুখ হল সেই সুখ যা অন্যান্য সুখকে সঙ্গে নিয়ে আসে। তবে যে সুখ অন্য সুখ উৎপন্ন করে না সে সুখ অনুর্বর। কাজেই দুটি সুখের মধ্যে যে সুখের উর্বরতা বেশি সকলের কামনা করা উচিত।
•৭)নিশ্চয়তাঃ দুটি সুখের মধ্যে যে সুখটি নিশ্চিত সেই সুখই আমাদের কাম্য। নিশ্চিত সুখকে ত্যাগ করে অনিশ্চিত সুখের আশায় আমাদের কোনমতেই ছোটা উচিত নয়।
আসলে বেন্থাম মনে করেন যে, মানুষ সভাবতঃ স্বার্থপর। কারণ সে সবসময় কেবলমাত্র নিজের সুখ কামনা করে। মনোবিজ্ঞানসম্মত সুখবাদের উপর ভিত্তি করে বেন্থামের এই মতবাদ গড়ে উঠেছে। তাই বেন্থাম বলেন যে, চারটি বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণের জন্য স্বার্থপরতা ত্যাগ করে ব্যক্তি পরার্থপর হয়ে ওঠে অর্থাৎ অন্যের সুখ কামনা করে। আর এই চারটি বাইরের নিয়ন্ত্রণ হলো-
১) প্রাকৃতিক নিয়ন্ত্রণ ২) সামাজিক নিয়ন্ত্রণ
৩) রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ। ৪) ধর্মীয় নিয়ন্ত্রণ।
∆১) প্রাকৃতিক নিয়ন্ত্রণঃ প্রাকৃতিক নিয়ম যথাযথ অনুসরণ না করলে বা ভঙ্গ করলে আমাদের দুঃখ ভোগ করতে হয়। তাই প্রকৃতির নিয়ম মেনে চলতে আমরা সকলেই বাধ্য। প্রকৃতিই আমাদের শিখিয়েছে অন্যের ভাবনা ভাবতে, সমষ্টির কথা চিন্তা করতে।
∆২) সামাজিক নিয়ন্ত্রণঃ সমাজের নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যক্তি অন্য ব্যক্তিদের সুখ কামনা করতে বাধ্য হয়। সমাজের নিন্দা ও শাস্তির ভয়ে ব্যক্তি সামাজিক নিয়ন্ত্রণ মেনে চলতে বাধ্য হয়। সমস্ত ব্যক্তির সুখেই সুখী সমাজ গড়ে ওঠে। তাই ব্যক্তি অন্যের সুখের ভাবনায় ভাবিত হয়।
∆৩) রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণঃ রাষ্ট্রের কতগুলো নির্দিষ্ট নিয়ম আছে এই নিয়ম লঙ্ঘন বা অমান্য করলে অনিবার্যভাবে শাস্তি পেতে হয় রাষ্ট্রের শাস্তির ভয়ে ব্যক্তির তাই অন্যের সুখের কথা চিন্তা করে। ব্যক্তির জীবনের সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রভাব ও অস্বীকার করা যায় না। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের কল্যাণ কামনার মধ্যে দিয়েই অন্যের কল্যাণ কামনা করা যায়।
∆৪) ধর্মীয় নিয়ন্ত্রণঃ ধর্মবোধ মানুষকে একসূত্রে গ্রথিত করে। একই ধর্মের অনুকামীরা একে অন্যের ভাবনা ভাবে। অন্যের সুখ শান্তি কামনা করি করে কাজী ধর্মীয় নিয়ন্ত্রণ আমাদের সমাজের অন্য মানুষের কথা ভাবতে বাধ্য করে বিদ্যাতিক বিষয় এই ভাবনার অন্তর্গত। তাই পাপ পুণ্যের ধারণা সকলের মধ্যে উপস্থিত আছে।
পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, বেন্থাম সুখের পরিমাণগত দিকের ওপর গুরুত্ব দিতে গিয়ে দৈহিক বা ইন্দ্রিয়সুখের উপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।তাই তাঁর মতবাদ অসংযত বা স্থূল পরসুখবাদ নামে পরিচিত। মনোবিদ্যাসম্মত সুখবাদের ভিত্তিতে গড়ে ওঠার কারণে এই সুখবাদের মধ্যে যেসব ত্রুটি বর্তমান, বেন্থামের এই অসংযত সুখবাদের মধ্যেও সেইসব ত্রুটি আছে।
Comments
Post a Comment