আরবদের শাসন ব্যবস্থার প্রকৃতি ও গুরুত্ব আলোচনা করো (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, দ্বিতীয় সেমিস্টার, ইতিহাস, এনএপি সিলেবাস)।
ভূমিকাঃ আলোচনা শুরুতেই আমরা বলে রাখি যে,
কাশিম সিন্ধুদেশে প্রবেশ করে বেশ কয়েকটি
অঞ্চল দখল করে সেখানে আরবীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। অতঃপর আরবিয় শাসনকার্য প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে আরবীয় শাসক নিযুক্ত করেন। আর এই লক্ষ্যে তিনি শাসনকার্য পরিচালনা করার জন্য এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সৈন্য মোতায়েন করেন। তবে এই সময় প্রশাসনিক ব্যবস্থার প্রধান রীতিনীতি ছিল বিজিত জনসাধারণকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করা। কিন্তু এই কাজটি মোটেই সেই সময়ে সহজ ছিল না। অতঃপর আমরা দেখি-
•কাশিমের সমস্যা•
আমরা জানি যে,আরবরা দক্ষ যোদ্ধা ছিলেন,কিন্তু তাদের প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা মোটেই ভালো ছিল না। বলা যায় যে,ভারতের প্রশাসনিক কাঠামো, ভাষা, রাজস্ব ব্যবস্থা, আইন-কানুন ইত্যাদি সম্বন্ধে তাদের কোন ধ্যান-ধারণা ছিল না। শুধু তাই নয়-
ভারতীয়রা আরব মুসলমানদের প্রতি অত্যন্ত বিরূপ ছিল। কারণ তাদের চোখে মুসলমানরা ছিল ধর্মনাশকারী ও আক্রমণকারী। আর সেই কারণে তারা আরব প্রশাসনিক ব্যবস্থার সাথে কোন প্রকার সহযোগিতা ভারতীয়রা করত না।
•সামঞ্জস্য বিধানের নীতি•
ভারতীয়রা আরবদের সাথে অসহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলে কাশিম তাঁর অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কিছুটা নমনীয় ও বাস্তব নীতি গ্রহণ করেন। আর এই নীতির ফলেই হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ইহুদিরা নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকার পায়। শুধু তাই নয়, কাশিম জিজিয়া কর তুলে দেন। যার ফলে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা তাদের নিজস্ব ধর্মাচরণের স্বাধীনতা পায়। বলা যায় এই নীতি গ্রহণ করে কাশিম এক যুগান্তর ঘটিয়েছিলেন।। অতঃপর কাশিম ভারতীয়দের সহযোগিতা লাভে সক্ষম হন এবং হিন্দুদের সাহায্যে একটি কার্যকারী শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলেন।
•প্রশাসনিক ব্যবস্থা•
সিন্ধুর বিজিত অঞ্চলগুলিকে কয়েকটি ইকতা বা জেলায় ভাগ করা হয়। অতঃপর প্রতিটি জেলার শাসনভার একজন করে সামরিক আধিকারিকদের হাতে দেওয়া হয়। আর সেখানে জেলার নিম্ন স্তরের প্রশাসনিক দায়িত্ব হিন্দু কর্মচারীদের হাতে অর্পণ করা হয়েছিল। সেই সময়ই সৈনিকদের নগদ বেতনের পরিবর্তে জায়গীর দেওয়া প্রথা ছিল। পাশাপাশি মুসলমান সন্ত ও ইমামদের দান হিসেবে জমি দেওয়া হতো। আর এই ব্যবস্থা ফলে সিন্ধুর দেশে বেশ কয়েকটি আরবীয় উপনিবেশ গড়ে ওঠে।
•কর ব্যবস্থা•
আরবদের শাসনে সিন্ধুর কর ব্যবস্থা প্রায় অপরিবর্তিত ছিল। সরকারি আয়ের প্রধান উৎস ছিল ভূমি রাজস্ব আর জিজিয়া। সেখানে উৎপন্ন ফসলের দুই-পঞ্চামাংশ বা এক চতুর্থাংশ রাজস্ব হিসেবে আদায় করা হতো। এছাড়াও নিলামের মাধ্যমে কিছু কিছু এককালীন কর সংগৃহীত হতো। প্রত্যেকের আয়ের ভিত্তিতে জিজিয়ার পরিমাণ স্থির করা হতো। আর এই কাজের জন্য অ-মুসলমানদের তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। সেখানে ধনীদের মাথাপিছু জিজিয়ার হার ধার্য হয়েছিল ৪৮ দিরহাম। মধ্য আই ব্যক্তিদের দেওয়া ছিল মাথাপিছু ২৪ দিরহাম, আর নিম্ন আয়ের ব্যক্তিরা দিত ১২ দিরহাম। বৃদ্ধ-বৃদ্ধা শারীরিকভাবে অক্ষম ব্যক্তি, অন্ধ, কর্মহীন প্রমুখ জিজিয়া থেকে জিজিয়া থেকে রেহাই পেত।
•বিচার ব্যবস্থা•
আরবদের আমলের বিচার ব্যবস্থা ছিল বিশৃংখল ও অব্যবস্থায় ভরা। বিচারালয়ের কোন সুনির্দিষ্ট স্তরবিন্যাস ছিল না। জেলা আধিকারিক বা অভিযাত্রা নিজ নিজ এলাকায় বিচার কার্যসম্পন্ন করতেন। নির্দিষ্ট বা লিপিবদ্ধ কোন আইন ছিল না। বিচারকের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় ছিল আইন। আর সেই অনুযায়ী শাস্তি নির্ধারণ হতো। স্বভাবত:ই হিন্দুদের ওপর শাস্তির বোঝা বেশি ছিল। সেখানে সামান্য চুরির অপরাধে চরম নির্যাতন করা বা অপরাধী স্ত্রী পুত্রকে পুড়িয়ে মারা কোন ব্যতিক্রমী ঘটনা ছিল না। হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে বিরোধ ঘটলে কাজী কোরাণের নির্দেশ অনুযায়ী বিচার করতেন। অবশ্য হিন্দুদের অভ্যন্তরীণ বিরোধ স্থানীয় পঞ্চায়েতেই ফয়শালা করা হতো।
•আরব প্রশাসনের মূল্যায়ন•
আরবদের ধর্মীয় গোড়ামী খুব বেশি ছিল না। জিজিয়া কর প্রদানের বিনিময়ে হিন্দুরা যে ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করত অনেক ঐতিহাসিক এ কথা মানতে চান না, বর্তমানে কোন কোন গবেষক মনে করেন যে, আসলে এটি সামরিকবৃত্তি রেহাই কর। প্রতিটি মুসলমানকে রাষ্ট্রের স্বার্থে বাধ্যতামূলকভাবে সামরিক কর সেবা দিতে হতো। কিন্তু-
বাস্তবে দেখা যায় যে, যেসব হিন্দু সামরিক বাহিনীতে চাকরি করত তাদেরও জিজিয়া কর দিতে হতো। সমাজের নিচুতলার মানুষদের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থার উন্নতি করার জন্য আরবরা কোন চেষ্টা করেননি। তারা রাজা দাহিরের আমলে যে অভাব ও অমর্যাদার সঙ্গে বাস করত আরব আমলেও তার কোন ব্যতিক্রম ঘটে নি।
Comments
Post a Comment