Skip to main content

একরাত্রি গল্পটি লিরিকধর্মী গল্প বলা যায় কিনা আলোচনা করো।

একরাত্রি গল্পটি লিরিকধর্মী গল্প বলা যায় কিনা আলোচনা করো।


          • আলোচনার শুরুতেই আমরা বলে রাখি যে,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আগে গীতিকবি এবং পরে ছোটগল্পকার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আর গীতিকবি হওয়ার কারণে তাঁর ছোটগল্পে গীতিপ্রবণতা বা লিরিক প্রবনতা স্বাভাবিকভাবে অনুপ্রবিষ্ট হয়েছে। তবে এখানে বলে রাখা ভালো যে, রবীন্দ্রনাথের প্রথম পর্বের বেশিরভাগ ছোটগল্পেই গীতিরস বা লিরিক রসের অনুপ্রবেশ লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু এই গীতিরস ছোট গল্পকে কতখানি স্বধর্মচ্যুত করেছে সেটা বিচার্য বিষয়। আর সেই বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ আক্ষেপ করে বলেছেন-

     "অসংখ্য ছোট ছোট লিরিক লিখেছি, বোধহয় 

      পৃথিবীর অন্য কোন কবিও এত লেখেন নি। কিন্তু 

       অবাক লাগে তোমরা যখন বল যে আমার 

      'গল্পগুচ্ছ' গীতিধর্মী। যা কিছু লিখেছি নিজে 

       দেখেছি, সে আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা।" 


             • বাস্তব ও কল্পনার সমন্বয়ে যথার্থ ছোটগল্প যেভাবে সৃষ্টি হয়, সেভাবে সৃষ্টি হয়েছে 'একরাত্রি' গল্পটি। সুখ-দুঃখ, বিরহ, আশা-আকাঙ্ক্ষা এই গল্পের শুধু নায়কের জীবনে নয়, প্রায় প্রত্যেকটা বাস্তব মানুষের জীবনে লক্ষ্য করা যায়। গীতিকবিতার যেমন এই ধর্ম লক্ষ্য করা যায়, ছোটগল্পেও তেমন সেই একই ধর্ম লক্ষ্য করা যায়। একরাত্রি গল্পটি 'মানসী','সোনারতরী' পর্বে লেখা। মানসীর নিষ্ফল কামনা কবিতায় কবি বলেছেন- 

             'খুঁজিতেছি কোথা তুমি

                    কোথা তুমি 

       যে অমৃত লুকানো তোমায় 

                   সে কোথায়!'


            • রবীন্দ্রনাথ মানসী, সোনারতরী পর্বে বিরহ-সৌন্দর্য উপলব্ধির প্রকাশ ঘটেছে একরাত্রি গল্পে। বিরহ-সৌন্দর্যের হাহাকার এখানে বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। আনিসুর রহমান বলেছেন-


         "মিলনে যা একসূত্রে বাধা পড়ে,বিরহে তাই বিশ্বাত্মবোধে উত্তীর্ণ হয়।এমন রোমান্টিক ভাবনাময় এক গীতিকবির পরিচয় আমরা একরাত্রি গল্পে পাই। আসলে পুরো গল্পটি যেন একটি আস্ত কবিতা। যেখানে ঘটনার বাহুল্যতা, চরিত্রসৃষ্টি, মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব বিশ্লেষণ এই গল্পে গৌণ হয়ে হয়ে কবিত্বময় উচ্ছ্বাস মুখ্য হয়ে উঠেছে।" আর সেখানে- 


   'একরাত্রি' গল্পের নায়ক বিরহে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে। তবে এই বিরহ তার প্রাপ্য ছিল না।সুরবলাকে ইচ্ছা করলেই সে নিজের মতো করে পেতে পারতো। কিন্তু তাকে উপেক্ষা করে পরশ পাথরের খোঁজে ছুটেছে এবং অবশেষে ব্যর্থ হয়েছে। বাস্তব জীবনকে অবহেলা করে আদর্শ লোককে খুঁজতে গিয়ে গল্পের নায়কের এই ব্যর্থতা। ব্যর্থতার শেষে বাস্তবের পথে সেই নারীকে পাওয়ার জন্য নায়ক হাহাকার করেছে। তখন সুরবালাকে ছোঁয়ার সাধ্য তার নেই। আসলে- 

    •  মানুষের জীবনের চিরকালীন ট্রাজেডি হলো- 

       'যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই।

        যাহা পাই তাহা চাই না।'


 অপ্রাপ্য বস্তুর সাধনায় জীবনের সুখ ও আনন্দকে বিসর্জন দিলে জীবনে ব্যর্থ হবার সম্ভাবনাই বেশি দেখা যায়। আর এখানে গল্পের নায়ক শেষ পর্যন্ত ক্লান্ত হয়েছে,হতাশ হয়েছে। জীবনকে অতিক্রম করে অনির্দেশ্য সৌন্দর্যের পিছনে ছুটে ইহজীবনের প্রাত্যহিক সুখকে অবহেলা করা কোনো অর্থ হয় না। যথাসময়ে যথা কাজ না করতে পারলে সৌন্দর্যকে আর ফিরে পাওয়া যায় না। আর ঠিক তখনই- 


       • একমাত্র কল্পনাকে সেখানে পাঠিয়ে ভাবের শান্তির পথ খুঁজতে হয়। গল্পের নায়কের জীবনেও সেভাবে একটি অন্ধকার রাত্রির মধ্যে অনন্ত রাত্রির উদয় হয়েছে। সেই দুর্যোগের রাত্রিই নায়ককে ভাবের জগতে হতাশা থেকে মুক্তির ঠিকানা দিয়েছে। কাঙ্ক্ষিত ধনকে পাওয়ার সেই রোমান্টিক আকুলতা ও তৃপ্তি তো বৈষ্ণব পদাবলীর ভাব সম্মিলনই দেখা যায়। তবে-


      •গল্পের শেষে নায়কের ভাবনাকে সামনে রেখে বলা যায় -

   "আমি নাজিরও হই নাই, সেরেস্তাদারও হই নাই,গারিবল্ডিও হই নাই, আমি এক ভাঙ্গা স্কুলে সেকেন্ড মাস্টার, আমার সমস্ত ইহজীবনে কেবল ক্ষণকালের জন্য একটি অনন্ত রাত্রির উদয় হইয়াছিল।" 

          আসলে আমার পরমায়ু সমস্ত দিনরাত্রির মধ্যে সেই একটি মাত্র রাত্রিই আমার তুচ্ছ জীবনের একমাত্র চরম সার্থকতা তুচ্ছ জীবনের স্বার্থকতা। তুচ্ছ জীবনের কথা চিন্তা করতে করতে নায়ক সহজে ভাবের জগত থেকে বাস্তবের জগতে ফিরে আসতে পেরেছে। আর সেই বাস্তব জগতে ফিরে আসতে তার মধ্যে যে বিরহ আকুলতা বা রোমান্টিক সুর মূর্চ্ছনায় প্রকৃতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছে। এসেছে ঝড়-বৃষ্টি, বন্যা দুর্যোগময় রাত্রি। রাত্রির ওই পটভূমিকায় গীতিময় ভাবোচ্ছ্বাসে গল্পটি করে তুলেছে ইঙ্গিতমুখী, লিরিকধর্মী।তবে-

         • গল্পে প্রেমের সিদ্ধি  ঘটেছে  এক অসাধারণ সাঙ্গীতিক মূর্চ্ছনায়।সঙ্গীতে সংগত করেছে স্বয়ং প্রকৃতি। রামলোচনের ঘরে বাল্যসখী সুরবালাকে দেখে নায়কের কর্মজীবনের সমস্ত বিস্তার অকস্মাৎ থমকে দাঁড়াল। প্রেমের এক উন্মত্ত আবেগ হৃদয়ের অর্কেস্ট্রায় ধ্বনিত হতে লাগলো। অবশেষে তা তার কানে গিয়ে পৌঁছালো। এখানেই গল্পের নায়ক আনন্দের স্বাদ পেল। আর পাঠকের মন আপ্লুত হয়ে থাকলো সংগীতের এই রেশটুকু টেনে নিয়ে।

Comments

Popular posts from this blog

দর্শন প্রথম সেমিস্টার সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তর।

দর্শন প্রথম সেমিস্টার সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, মাইনর সিলেবাস)  ১)চার্বাক মতে ভূত কয়টি ও কি কি? উত্তরঃচার্বাক মতে ভূত চারটি- ক্ষিতি, অপ্ , তেজ ও মরুৎ ২) স্বভাববাদ কী? উত্তরঃ চার্বাক জড়বাদের ভিত্তি হল স্বভাববাদ। যে মতবাদ অনুসারে স্বভাব থেকেই ভূত সৃষ্টি, আবার স্বভাব থেকেই বিচ্ছেদ। যার জন্য ঈশ্বরকে স্বীকার করা প্রয়োজন নেই। ৩) অব্যাপ্যদেশ কথাটির অর্থ লেখো। উত্তরঃ অব্যাপ্যদেশ বলতে বোঝায়- অশাব্দ অর্থাৎ যাকে শব্দের দ্বারা প্রকাশ করা যায় না। ৫) জ্ঞান লক্ষণ প্রত্যক্ষ কাকে বলে?  কোন একটি ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে তার নিজের বিষয়ীভূত গুণ ছাড়াও যদি অপর একটি ইন্দ্রিয়ের বিষয়ীভূত গুণকে প্রত্যক্ষ করার হয়, তাহলে সেই প্রত্যক্ষকে জ্ঞানলক্ষণ প্রত্যক্ষ বলা হয়। ৬) ন্যায় মতে প্রমাণের প্রকার  উত্তরঃ ন্যায় মতে প্রমাণ চার প্রকার। প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান এবং শাব্দ। ৭) সন্নিকর্ষ কাকে বলে? উত্তরঃ ন্যায় মতে ইন্দ্রিয় ও কোন বাস্তব পদার্থের মধ্যে একপ্রকার বিশেষ সম্পর্ক ঘটলে তবেই আমাদের একটি বস্তুর প্রত্যক্ষজ্ঞান ।আর ঐ বিশেষ বিশেষ সম্পর্কের পারিভাষিক নাম হলো সন...

ব্রিটিশ(3rd.Sem) পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব

ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব(পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় তৃতীয় সেমিস্টার রাষ্ট্রবিজ্ঞান মাইনর সিলেবাস)। ব্রিটেনের সংবিধান অলিখিত বলে বিভিন্ন ঐতিহাসিক দলিল, শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতি, পার্লামেন্ট প্রণীত আইন প্রভৃতির মাধ্যমে পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব অর্জিত হয়েছে। ব্রিটেনের পার্লামেন্ট আইনানুগ সার্বভৌমত্ব অর্জন করেছে, রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব নয়। আর সেখানে আইনানুগ সার্বভৌমত্ব বলা হয়, কারণ-       যেকোনো বিষয়ে পার্লামেন্ট আইন প্রণনয়নের অধিকারী। এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র হওয়ায় পার্লামেন্টে কোন আইন প্রণয়নের সময় প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় না। কমন্সসভা তথা নিম্নকক্ষের সার্বভৌমত্বকেই বলা হয় পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব।     ••ব্রিটিশ পার্লামেন্টকে সার্বভৌমত্ব বলার কারণ- ১) পার্লামেন্টের ওপর আইনগত কোনরূপ বাধানিষেধ আরোপ করা যায় না। ২) পার্লামেন্ট প্রণীত আইনের বৈধতার ব্যাপারে আদালত কোন প্রশ্ন তুলতে পারেনা। ব্রিটেনের আদালত পার্লামেন্ট প্রণীত আইনের ওপর বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার দ্বারা সীমিত করতে পারে না। ৩) ব্রিটিশ পার্লামেন্টের আইন প্রণয়ন ক্ষমতার উপর শাসনবিভাগ অনুরূপ ন...

ইতিহাস (3rd Semester) সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর।

 তৃতীয় সেমিস্টার ইতিহাস মাইনর সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, তৃতীয় সেমিস্টার ইতিহাস মাইনর)। ১)বন্দেগান-ই-চাহালগানি বলতে কী বোঝায়? •উত্তরঃবন্দেগান-ই-চাহালগান বলতে চল্লিশ জন তুর্কি ও অ-তুর্কি দাসদের সমন্বয়ে গঠিত একটি বাহিনীকে বোঝায়। এই বাহিনীকে ডাল চালিশা বা তুরকান-ই- চাহালগানি নামে ডাকা হতো। ২)আমির খসরু কে ছিলেন? •উত্তরঃ আমির খসরু ছিলেন প্রখ্যাত সুফি সাধক বা আরেফ নিজামউদ্দিন আওলিয়ার ছাত্র এবং অন্যতম প্রধান খলিফা। যাঁকে 'ভারতের তোতা' উপাধি দেওয়া হয়েছিল। ৩) মহরানা প্রতাপ কে ছিলেন?  •উত্তরঃ মেবারের শিশোদিয়া রাজবংশের একজন হিন্দু রাজপুত রাজা ছিলেন মহারানা প্রতাপ সিং। যিনি রাজপুতদের বীরত্ব ও দৃঢ় সংকল্পের প্রতীক। বহু বছর ধরে তিনি মুঘল সম্রাট আকবরের সঙ্গে লড়াই করেন। ৪) জায়গীরদারী সংকট কী? •উত্তরঃ জায়গিরদারী সংকট ছিল মোগল সাম্রাজ্যের একটি অর্থনৈতিক সংকট। এই সংকটে জমি বা জায়গিরের অভাব দেখা দিয়েছিল। যার ফলে প্রশাসনিক খরচ মেটানো এবং যুদ্ধের খরচ বহন করা সম্ভব হতো না। ৫) দাক্ষিণাত্য ক্ষত কী? •উত্তরঃ দাক্ষিণাত্য ক্ষত বলতে ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীত...