বাংলা গদ্যের বিকাশে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ও পন্ডিত/লেখকদের অবদান আলোচনা করো। (বাংলা, মেজর,তৃতীয় সেমিস্টার, পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় NEP)
• ভূমিকাঃ আলোচনার শুরুতেই আমরা বলে রাখি যে, বাংলা সাহিত্যের ধারাবাহিক গদ্য রচনার সূত্রপাত ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের লেখকদের হাত ধরে হয়। তবে বাংলা ভাষায় গদ্য ব্যবহারের আধুনিক প্রবণতার প্রথম সার্থক পথিকৃৎ উনিশ শতকের নবপ্রবুদ্ধ শিক্ষা পদ্ধতি ও শিক্ষালয়। বাংলা ভাষায় গদ্য রচনার যে প্রাচীন নিদর্শন প্রাথমিক পর্যায়ে লক্ষ্য করা যায়, তাতে আদর্শ লেখ্য ভাষার উপযোগী শৃঙ্খলার অভাব ছিল স্পষ্ট। এই সময়কালে পর্তুগিজদের রচিত বাংলা ব্যাকরণ ছিল তাদের স্বজাতীয় বাংলা। যে বাংলা ছিল তাদের রূপ-রীতি সম্পর্কে এক সাধারণ জ্ঞান পরিবেশনের চেষ্টা মাত্র। পরবর্তীতে-
• ইংরেজ বৈয়াকরণদের প্রয়াস ছিল ঠিক ওই একই রকম। যার ফলে বাংলার গদ্যের জগৎ, রূপ-রীতির শৃঙ্খলাহীন বৈচিত্র্যে পুঞ্জীভূত হয়ে উঠেছিল। এই বিচ্ছিন্ন বিচিত্র রচনাধারার বিশৃঙ্খল জগতে রূপরীতির শৃঙ্খলাবদ্ধ সামঞ্জস্য বিধানে পরোক্ষভাবে হলেও প্রথম গৌরব ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের।আর-
১৮০০ খ্রিস্টাব্দের ৪ঠা মে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় (পক্ষান্তরে ১৮ই আগষ্ট ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ওই কলেজে সেই দিনই নিয়মাবলী গৃহীত হয়)। ঠিক ওই সময়ে লর্ড ওয়েলেসলি টিপু সুলতানকে পরাজিত করে সবে ফিরে এসেছেন। আর এই গৌরবের স্মৃতিকে ধরে রাখতে যদিও ১৮ই আগস্ট কলেজ প্রতিষ্ঠা দিবস পক্ষান্তরে ধরা হয়। তবুও বলা যায় টিপু সুলতানের পরাজয়ের তারিখ ৪ঠা মে ১৭৯৯ কে কলেজের প্রতিষ্ঠা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। অতঃপর-
ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ প্রোভোষ্ট নিযুক্ত হয়েছিলেন রেভারেন্ড ডেভিড ব্রাউন। অতঃপর ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে বিভাগীয় প্রধান হন রেভারেন্ড উইলিয়াম কেরি এবং তিনি ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। বাংলা ও সংস্কৃত বিষয়ের প্রধান পন্ডিত হিসাবে ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে নিযুক্ত হন মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার। এছাড়াও পন্ডিতের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন রামরাম বসু, রাজীব লোচন মুখোপাধ্যায়,চণ্ডীচরণ মুন্সি প্রমূখ। তবে -
তৎকালীন গভর্নর জেনারেল এর নির্দেশ থেকে জানা যায়-ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল যে, স্বদেশ থেকে আগত সিভিলিয়ানদের এদেশের ভাষা ও সাহিত্যে শিক্ষিত করা। কারণ বিদেশী শাসকদের এদেশীয় ভাষা, ইতিহাস ও আচার আচরণাদির জ্ঞানার্জন করা বাধ্যতামূলক ছিল। আর সেই কারণে এই কলেজের শিক্ষণ ব্যবস্থাকে উপলক্ষ্য করে বাংলা গদ্যভাষা গতিশীলতা লাভ করেছিল। আর এটি সম্ভব হয়েছিল সংস্কৃত ভাষার অধ্যক্ষ উইলিয়াম কেরির ক্লান্তিহীন মৌলিক প্রচেষ্টা। শুধু তাই নয়, তিনি নিজে পন্ডিত ও মুন্সীদের নিয়ে গদ্য রচনায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। আর সেখানে আমরা দেখি-
•উইলিয়াম কেরীঃ
উইলিয়াম কেরি একজন বিচক্ষণ ভাষাভিজ্ঞ পন্ডিত এবং তিনি ভালো বাংলা বলতে ও লিখতে পারতেন। শুধু তাই নয়, তিনি একজন দারিদ্র পীড়িত পরিবারের সন্তান। কিন্তু দারিদ্রতার মধ্যেও তিনি লাতিন ও গ্রীক ভাষা শিখে নেন। অতঃপর তিনি সংসার জীবন লাভ করে ফরাসি, ইতালিয়ান, ডাচ প্রভৃতি ভাষা শিখেছিলেন। আর এ থেকে অনুমান করা হয় ভাষা শিক্ষার প্রতি উইলিয়াম কেরির একটা স্বাভাবিক আকর্ষণ ছিল। আর এ সকল সম্ভব হয়েছে তার প্রবল নিষ্ঠা ও পরিশ্রম জনিত কারণে। তবে বাংলা গদ্যের পথ নির্মাণে তাঁর অবদান আজও স্মরণীয় হয়ে আছে। আর এই সূত্র ধরে ইংরেজি ভাষায় বাংলা ব্যাকরণ রচনা ছাড়াও গদ্য রচনা হলো কথোপকথন (১৮০১) ও ইতিহাসমালা (১৮১২) অন্যতম।
• কথোপকথনঃ
কথোপকথন বাংলা ভাষার কথাবার্তার মধ্য দিয়ে ইংরেজ কর্মচারীদের বাংলা ভাষা ও বাঙালি সমাজের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য রচিত হয়। গ্রন্থটি ৩১ টি অধ্যায়ের রচিত, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- চাকর ভাড়াকরণ, ঘাতক মহাজনি, হাটের বিষয়, স্ত্রীলোকের কথোপকথন প্রভৃতি। গ্রন্থটির বিষয়বস্তুর সম্পর্কে অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন-
"কথোপকথনে বাঙালির সমাজের বিভিন্ন
শ্রেণীর যে পরিচয় পাওয়া যায়, সমাজ,অর্থনীতি,
ব্যবসা-বাণিজ্য,বিবাহাদি, স্ত্রী সমাজের পরিচয়...
অর্থ স্থাপিত পরের বাংলা রচনা ততটা বাস্তব
নিষ্ঠুর জীবন্ত বর্ণনা পাওয়া যায় না।"
•ভাষারীতির বৈশিষ্ট্যঃ
১) কথোপকথন গ্রন্থটির ভাষা আলাপী ভাষা না পন্ডিতী ভাষা হবে- বিষয়টি নিয়ে কেরি সাহেব ভীষণ চিন্তিত ছিলেন।
২) এর ভাষা ঠিক চলিত ভাষা নয়। তবে অনেক ক্ষেত্রেই চলিত ও সাধু ক্রিয়ার সংমিশ্রণ দেখা যায়।
৩) গ্রন্থটিতে বহু প্রবাদ প্রবচন ব্যবহৃত হয়েছে।
•তাৎপর্যঃ
১) বাঙালি সমাজ ও পরিবারের অনেক তথ্য এই প্রথম গদ্যে দেখা গেল।
২) বিষয়ক নির্বাচনের দিক থেকে গ্রন্থটির গুরুত্ব অপরিসীম।
৩) সমকালীন সমাজের প্রতিফলনে আলোচ্য গ্রন্থটির একটি সামাজিক তাৎপর্য আছে।
৪) গ্রন্থটির ভাষা পরবর্তীকালে প্যারীচাঁদ মিত্র ও কালীপ্রসন্ন সিংহকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল।
•আসলে উইলিয়াম কেরি একজন বিদেশী হয়েও এক অনাবিল পরিশ্রম ও অনুরাগে বাংলা গদ্যচর্চায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। আর সেই প্রয়াসের সাক্ষ্য কথোপকথন ও ইতিহাসমালা। তবে এই দুটি গ্রন্থ বাস্তবে রূপদান করার জন্য তার ধৈর্য, শ্রম, ও সর্বোপরি নিষ্ঠা এবং সাংগঠনিক শক্তির প্রশংসা আমাদের করতেই হয়।
• ইতিহাসমালাঃ আলোচনা শুরুতেই আমরা বলে রাখি যে,ইতিহাসমালা বাংলা সাহিত্যের প্রথম গল্প সংকলন, তবে সেসব গল্প মৌলিক সৃষ্টি নয়। আর সেই সংকলনে আছে মানুষের ত্যাগ তিতিক্ষার কথা, আছে কাম, ক্রোধ, লোভ, কোন গল্পে স্ত্রীলোকের বিশ্বাসঘাতকতা, কোথাও নারীর নির্লজ্জ কামাচার, মানুষের নীচতা,খুন, জখম, ডাকাতি প্রভৃতির প্রসঙ্গ। এছাড়াও এই গল্প সংকলনে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য নানান গল্প এখানে স্থান পেয়েছে। তাই সংকলনের আখ্যানপত্রে লেখা হয়েছে-
"A collection of stories in the
Bengali language collected from
various sources."
•ভাষারীতিও তাৎপর্যঃ
ইতিহাসমালা ভাষা মোটামুটি সহজ, সরল, পরিচ্ছন্ন ও স্বাভাবিক ভাষায় রচিত। তবে অনেক ক্ষেত্রে এর ভাষা সংস্কৃত-গন্ধী পরিলক্ষিত হয়। তবে এই গ্রন্থে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে বাংলা গদ্যের অন্বয় রীতি ধরা পড়েছে। তবে-
ইতিহাসমালার গল্পগুলিতে আছে ছোটগল্পের আমেজ।আর রচনাভঙ্গিমার পেছনে আছে বাঙালি লেখকদের যথেষ্ট অবদান।তবে গল্পের সংগ্রাহক হিসেবে কেরী সাহেবের অবদান অতি গুরুত্বপূর্ণ। তাই প্রথম বাংলা আখ্যান গ্রন্থ হিসেবে এর গুরুত্ব সমধিক। এরই পাশাপাশি ১১ বছরে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের গদ্য সৃষ্টি যে কতটা অগ্রসর হতে পেরেছিল 'ইতিহাসমালা' তার একটি শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। আর সে কারণে বলা হয়-
" প্রতিভার একটি সংজ্ঞা নাকি পরিশ্রম করবার
অশেষ শক্তি। তাহ'লে উইলিয়াম কেরি নিশ্চয়ই
প্রতিভাবান পুরুষ।"
(বাংলা সাহিত্যের রূপরেখা পৃঃ৮৮)
Comments
Post a Comment