"বাংলা গদ্যের জনক বিদ্যাসাগরই"-আলোচনা করো।
•অথবা• বাংলা গদ্য সাহিত্যের প্রথম কৃতি শিল্পী বিদ্যাসাগর
•অথবা• বাংলা গদ্য সাহিত্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান আলোচনা করো। (বাংলা মেজর, তৃতীয় সেমিস্টার)
• ভূমিকাঃ বাংলা গদ্যের বিকাশে অন্যতম পুরোধা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনি উনিশ শতকের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। শুধু বাঙালি নন, সর্বশ্রেষ্ঠ গদ্য শিল্পী। রামমোহন রায়, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার বাংলা গদ্যের যে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর সেই উদ্যোগকে আরো রস সমৃদ্ধ করে তুললেন। তাই তিনি বাংলা গদ্য সাহিত্যে প্রথম কৃতি শিল্পী। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতে-
"বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ভাষা অতি সুমধুর ও
মনোহর। রামমোহনের হাতে বাংলা গদ্যের প্রাণ
প্রতিষ্ঠা হলেও বাংলা গদ্যের জনকত্বের দাবিদার
বিদ্যাসাগরই।"
আসলে অতি বালক বয়স থেকে বিদ্যাসাগরকে কঠোর দারিদ্রতার সাথে তীব্র লড়াই করে বড় হতে হয়। ১৮৪১ সালে তিনি 'বিদ্যাসাগর' উপাধি লাভ করেন এবং ওই বছরেই তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রধান পন্ডিত হিসেবে নিযুক্ত হন। দারিদ্রতা তাঁর নিত্য সাথী হলেও তিনি অসাধারণ পৌরুষত্বের অধিকারী ছিলেন, যা তাকে কঠোরভাবে তুলে ধরতে সাহায্য করেছে। এখানে তিনি কোন ক্ষমতা বা ঐশ্বর্যের কাছে মাথা নত করেননি। তিনি নিজেকে এমন ভাবে যুক্ত রেখেছিলেন যে, যা বাংলাদেশে তাঁর আবির্ভাব একটা ঐতিহাসিক ঘটনা বলে আমাদের মনে হতেই পারে।তবে-
মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের বাংলা গদ্য যেখানে শেষ হয়েছে, বিদ্যাসাগরের বাংলা গদ্য সেখান থেকে শুরু হয়েছে। আর এর মধ্যবর্তী সময়কালে যারা ছিলেন তারা উপকরণ সংগ্রহে সাহায্য করেছিলেন। অতঃপর বিদ্যাসাগরের হাতে বাংলা ভাষার নমনীয়তা পূর্ণতা পায়। আর এই কারণেই তিনি বাংলা গদ্য সাহিত্যে প্রথম অনবদ্য অমর শিল্পী। আর সেখানে-
•অনুবাদ রচনায়•
বিদ্যাসাগরের প্রথম গদ্য রচনা 'বাসুদেব চরিত' যা ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পাঠ্যপুস্তকের জন্য রচিত হয়। কিন্তু গ্রন্থটিতে হিন্দু মনোভাব ও মূর্তি পূজার কথা থাকায় কলেজ গ্রন্থটি মুদ্রণ করেননি। অতঃপর ১৮৪৭ সালে প্রকাশিত হয় 'বেতাল পঞ্চবিংশতি'। এই গ্রন্থটিতে তিনি ছেদচিহ্ন, কমা চিহ্নের ব্যবহার করলেন। অতঃপর তিনি বাল্মীকির রামায়ণ অবলম্বনে 'সীতার বনবাস' শেক্সপিয়ারের Comady of Errors অবলম্বনে 'ভ্রান্তিবিলাস' রচনা করেন।
•সাধু গদ্যরীতির ছাঁদ নির্মাণে•
বিদ্যাসাগরই বাংলায় সাধু গদ্যরীতির ছাঁদটি বেঁধে দিয়েছেন। আর সেই কারণেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর এই কাজের প্রশংসায় মুখরিত হয়ে বলেন-
"বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্য ভাষার উৎশৃংখল
জনতাকে সুবিভক্ত, সুবিন্যস্ত, সুপরিচ্ছন্ন
এবং সুসংযত করিয়াছেন।"
তাঁর এই ভাব ভঙ্গিমা নিয়ে অনেক লেখকই যশময় হয়েছেন। কিন্তু এই যশময়ের সেনাপতি বিদ্যাসাগরই, আর কেউ নয়।
•বাংলা গদ্যের প্রাণপুরুষ•
রামমোহন রায় বাংলা গদ্যের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করলেও বাংলা গদ্যের জনকত্বের দাবিদার বিদ্যাসাগর। তিনি সর্বপ্রথম দেখালেন বাংলা গদ্যের মধ্যে একটা সুমধুর ছন্দ আছে,আছে তাল এবং প্রাণ। আর বাংলা গদ্যে সেই প্রাণ প্রতিষ্ঠা করলেন বিদ্যাসাগর। তাই রবীন্দ্রনাথ বলেন-
"বাংলা গদ্যের প্রথম যথার্থ শিল্পী বিদ্যাসাগর।"
•আসলে রামমোহনের সূচনা পর্ব থেকে রবীন্দ্রনাথের পরিণত রচনা সম্ভার দেখার সুযোগ বিদ্যাসাগরের হয়েছিল। আর এখানে দেখা যায় সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক বিদ্যাসাগর ভাষা নির্বাচনে মোটেই প্রাচীনপন্থী ছিলেন না। তার প্রমাণ পাওয়া যায় শকুন্তলা, সীতার বনবাস, প্রভাবতী সম্ভাষণ রচনায়। তবে আদি সাধু ভাষার যথার্থ প্রমাণ মেলে 'বেতাল পঞ্চবিংশতি' গ্রন্থ থেকে। তবে শকুন্তলা গ্রন্থে ভাষার মধ্যে ক্রিয়াপদের প্রয়োগ আমরা দেখতে পাই। আর সেখানে দেখি-
"হ্যাঁ পিসি! আজ বড় অসুখ হয়েছিল,
এখন অনেক ভালো আছি।"
•বিদ্যাসাগরের গদ্যরীতির বৈশিষ্ট্য•
১) বিদ্যাসাগরের গদ্য সাবলীল সাধুর রীতির
২)গদ্যে ছেদ চিহ্নের ব্যবহার ও বাক্য বিন্যাস ছন্দময়।
৩) আদ্য অক্ষরে স্বরাঘাত প্রয়োগ।
৪) তাঁর গদ্য ভাষা আমাদের ভাবের জগতে রসের সাগরে ডুবিয়ে দেয়। শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে-
"তাঁহার হাতেই গদ্যভাষা কৈশোরের অনিশ্চয়তা
ও অস্থির গতি ছাড়িয়া পূর্ণ সাহিত্যিক রূপের
স্থিরতায় প্রতিষ্ঠিত হইল।"
•পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে-বিদ্যাসাগরের অন্যতম সাহিত্যকর্ম 'শকুন্তলা' অনুবাদ। তবে তাঁর কোন অনুবাদই হুবহু পরানুসরণ নয়। আর এখানে তিনি শকুন্তলা গ্রন্থ অনুবাদের মাধ্যমে সংস্কৃত সাহিত্যের রস পরিবেশন করতে যেমন চেয়েছিলেন, ঠিক তেমনি বাংলা গদ্য ভাষাকে গতি সঞ্চার করতে চেয়েছিলেন। তাই তাঁর রচনার সর্বত্রই ব্যক্তিত্ব, জীবনবোধ, শিল্পধর্ম, রসবোধ, ভাষার সাবলীলতা,সরলতা, গতি লক্ষণীয়। আর এই সকল বিষয় নিয়ে প্রথমে বঙ্কিমচন্দ্র, অতঃপর রবীন্দ্রনাথ বাংলার সাহিত্যের আঙিনায় স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। আর সেই কারণেই রবীন্দ্রনাথ বলেন-
"বিদ্যাসাগরই বাংলা গদ্যের প্রথম শিল্পী।"
Comments
Post a Comment