মহম্মদ বিন তুঘলকের সংস্কারগুলি আলোচনা করো•অথবা• মহম্মদ বিন তুঘলকের নেওয়া নীতি গুলির পর্যালোচনা করো ( পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, তৃতীয় সেমিস্টার, মাইনর, ইতিহাস)।
ভূমিকাঃ আলোচনা শুরুতেই আমরা বলে রাখি যে, মহম্মদ-বিন-তুঘলকের শাসনকালের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল তাঁর সংস্কার। তবে এই সংস্কারগুলিকে একটা সময়ে তার খামখেয়ালীপনার উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা হতো। শুধু তাই নয়, তাঁকে উদ্মাদ রাজা এবং রক্তপিপাসু ইত্যাদি উপাধিতে ভূষিত করাও হয়েছিল। কিন্তু-
আধুনিককালে গবেষণার ফলে এ কথা প্রমাণ করা হয়েছে যে, মহম্মদ বিন তুঘলক তাঁর প্রতিটি সংস্কারের ক্ষেত্রে যুক্তি দ্বারা পরিচালিত হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর সংস্কার গুলি প্রবর্তন করতে গিয়ে তিনি যতখানি প্রগতিশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন, তার থেকে অনেক কম বাস্তব জ্ঞান অথবা ভারসাম্যের অভাবের পরিচয় দেন। আর সেই পরিচয়ে দেখি-
প্রথমতঃ •দোয়াব অঞ্চলে কর বৃদ্ধি•
বিখ্যাত ঐতিহাসিক বারানী দোয়াব অঞ্চলে কর বৃদ্ধির জন্য সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলকের কঠোর সমালোচনা করেছেন। তিনি এই অঞ্চলে কর বৃদ্ধি করেছিলেন তার কারণ- অঞ্চলটি ছিল সমৃদ্ধশালী এবং এখানকার জমির উৎপাদন ক্ষমতা ছিল অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় অনেক বেশী। তাছাড়াও-
দোয়াব অঞ্চলের শাসকেরা ছিলেন অবাধ্য এবং তাদের মধ্যে বিদ্রোহের প্রবণতা ছিল অনেকগুন বেশি। অধ্যাপক মেহেদী হুসেন বলেন- "খোরাসন কারাজল অভিযান, মুদ্রা প্রবর্তনের ব্যর্থতা সাম্রাজ্যের অর্থনীতিকে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল। ফলে দোয়াব অঞ্চলে কর বৃদ্ধি অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল।"
সুতরাং দোয়াব অঞ্চলে কর বৃদ্ধি মোটেই সুলতানের খামখেয়ালী মনোভাবের পরিচয় নয়। কিন্তু সুলতান যে সময়ে এই কর বৃদ্ধির জন্য স্থির করেছিলেন তা মোটেই অনুকূল সময় ছিল না। কারণ ওই সময়ে দোয়ায় অঞ্চলে খরা, দুর্ভিক্ষ, মহামারী চলছিল। পরে সুলতান এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ঐ অঞ্চলে ত্রাণ পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু তা অনেকটা দেরী হয়ে গিয়েছিল।
দ্বিতীয়তঃ •রাজধানী স্থানান্তর•
সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলকের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার হল দিল্লি থেকে দৌলতাবাদে রাজধানী স্থানান্তর করা। তবে এই সংস্কারও যুক্তিহীন ছিল না। দৌলতাবাদ দেশের মাঝখানে অবস্থিত ছিল। যেখানে মোঙ্গল আক্রমণ থেকে অনেক নিরাপদ ছিল। তাছাড়া দক্ষিণে মুসলমানদের সংখ্যা কম ছিল, সেখানে হিন্দুরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাই তিনি মুসলমান ও হিন্দু জনসংখ্যার মধ্যে ভারসাম্য আনতে চেয়েছিলেন।তবে-
সুলতান শুধুমাত্র সরকারি প্রশাসনযন্ত্র স্থানান্তর করে যদি সন্তুষ্ট থাকতেন তাহলে এই সংস্কার সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হতো। সুলতান প্রথমে দিল্লি থেকে সমস্ত জনগণকে দৌলতাবাদের চলে যেতে আদেশ দেন। আর সেখানে জনগণ চলে গেলে তাদের কষ্টের কোন সীমা ছিল না। তবে তিনি যখন বুঝতে পারলেন যে, তাঁর সংস্কার ব্যর্থ হয়েছে- তখন আবার তিনি তাদের দিল্লিতে প্রত্যাবর্তনের আদেশ দেন।এবারও তারা সকলেই অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগ করে। ফলে এ সংস্কারও ব্যর্থ পর্যবসিত হয়।
তৃতীয়তঃ •তামার নোটের প্রবর্তন•
মহম্মদ-বিন-তুঘলকের দ্বিতীয় অন্যতম সংস্কার ছিল তামার মুদ্রার প্রচলন। এই প্রতীক মুদ্রার প্রচলন তাঁর উল্লেখযোগ্য পরিকল্পনা। তিনি সোনা ও রুপার মুদ্রার পরিবর্তে তামা ও ব্রোঞ্জ ধাতুর মুদ্রা চালু করেন।এক্ষেত্রে তাঁর সংস্কার যুক্তিহীন ছিল না। তবে সেই সময়ে রুপার অভাব দেখা দেয় এবং বিশাল সামরিক বাহিনীর ব্যয় নির্বাহ করতে কষ্টসাধ্য হয়ে উঠলো।
তবে -
এই মুদ্রানীতির প্রবর্তন শেষ পর্যন্ত বিফল হয়েছিল। কারণ প্রতীক মুদ্রা প্রচলনের ব্যাপারে সুলতানের সার্বিক কর্তৃত্ব ছিল না।আর তার ফলস্বরূপ এই মুদ্রা ব্যাপক হারে জাল হতে শুরু করে। যার ফলে বিদেশী বণিকরা এই মুদ্রা নিতে অস্বীকার করে। তাছাড়াও এই মুদ্রা সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। অবশেষে সুলতান তাম্র ও ব্রোঞ্জ মুদ্রার বিনিময়ে স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা প্রচলনের ব্যবস্থা করেন।
চতুর্থতঃ। •খোরাসান প্রকল্প•
মহম্মদ-বিন-তুঘলক একটা সময় খোরাসান ও ইরাক জয়ের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। কারণ ঐ সকল অঞ্চলে দিল্লির আধিপত্য বিস্তার করা খুব কঠিন কাজ ছিল না। আর সেই উদ্দেশ্যে তিনি চার লক্ষের এক বিরাট সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন এবং তাদের এক বছর ধরে ভরণ পোষণের ব্যবস্থা করেন। যার ফলে-
সাম্রাজ্যে রাজকোষের উপর প্রচন্ড চাপ পড়ে। অবশেষে পর্বতসংকুল পথের কারণে এই আক্রমণ করা সম্ভব নয় বলে তিনি তাঁর পরিকল্পনা বাতিল করে দেন।
পঞ্চমতঃ। •কারাজল অভিযান•
মহম্মদ বিন তুঘলক পার্বত্য উপাজাতিদের দমনের জন্য নগরকোট ও কারাজলে অভিযান প্রেরণ করেন। এক্ষেত্রে তিনি প্রাথমিকভাবে সফল হন এবং পার্বত্য জাতিগুলি তাঁর বশ্যতা স্বীকারও করেন। কিন্তু তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। মহম্মদ বিন তুঘলকের বিভিন্ন পরিকল্পনার উপর্যুপরি ব্যর্থতা ও শাসনযন্ত্রের দুর্বলতার সুযোগে দেশে একাধিক বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। পরবর্তীতে একাধিক স্বাধীন রাজ্যের উদ্ভব ঘটে।
•পরিশেষে বলা যায় যে, মহম্মদ বিন তুঘলকের সংস্কারগুলি ভিত্তিহীন ছিল না। প্রত্যেকটি সংস্কারের পিছনে উপযুক্ত কারণ ছিল। সুলতান ব্যর্থ হয়েছিলেন তার কারণ তিনি তাঁর সংস্কার প্রবর্তনের জন্য যথাযথ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। তাছাড়া তাঁর অব্যবস্থিত চিত্ত কিছুটা ব্যর্থতার জন্য দায়ী ছিল। সেই সাথে অভাব ছিল তার বাস্তব জ্ঞানের। পাশাপাশি জনগণ তাঁর সংস্কার গুলি গ্রহণ করতে মানসিক দিক থেকে প্রস্তুত ছিল না।আর এদিক থেকে বিচার করলে সুলতান ছিলেন তাঁর সময়ের থেকে অনেক বেশি প্রগতিশীল।সে কারণে তাঁকে কোনমতেই খামখেয়ালি অথবা উন্মাদ বলা যায় না।
এরূপ অসংখ্য বিষয়ভিত্তিক আলোচনা, সাজেশন এবং ভিডিও পেতে ভিজিট করুন আমাদের "SHESHER KOBITA SUNDORBON" YOUTUBE CHANNEL ।
Comments
Post a Comment