বাংলা গদ্য সাহিত্যে প্যারীচাঁদ মিত্র র অবদান আলোচনা করো (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, তৃতীয় সেমিস্টার, বাংলা, মেজর )।
ভূমিকাঃ আলোচনা শুরুতেই আমরা বলে রাখি যে, ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে হিন্দু কলেজের অন্যতম ছাত্র এবং ইয়ংবেঙ্গল দলের অন্যতম নেতা প্যারীচাঁদ মিত্র বাংলা গদ্যে বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় রেখে গেছেন। বঙ্কিমচন্দ্রের পূর্বে বাংলা গদ্যে যে পালাবদল হয়েছে তার পশ্চাতে ছিল বাংলা ভাষা ও সাহিত্যির দীপ্ত ব্যক্তিত্ব। আর- সেই সকল দীপ্ত ব্যক্তিত্বের মধ্যে অন্যতম ছিলেন প্যারীচাঁদ মিত্র, যিনি টেকচাঁদ ঠাকুর ছদ্মনামের বেশি প্রসিদ্ধ ছিলেন। আসলে প্যারীচাঁদ জনকল্যাণের জন্যই কলম ধরেছিলেন স্ত্রীসমাজের সর্বাঙ্গীণ উন্নতি ছিল তাঁর একমাত্র আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং প্রয়াস। তবে তাঁর গ্রন্থ গুলিতে সাহিত্যবোধের কোন অভাব ঘটেনি, তাই তিনি জ্ঞান সাধনার পথিকৃৎ। আর সেখানে তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাগুলি হলো-
•কথোপকথন ও গদ্যমূলকরচনা• রামারঞ্জিকা(১৮৬০) অভেদী(১৮৭১) বামাতোষিনী(১৮৮১) ইত্যাদি।
•ব্যঙ্গাত্মক রচনা•। আলালের ঘরের দুলাল(১৮৫৮), মদ খাওয়া বড় দায় জাত থাকার কি উপায়(১৮৫৯)। তবে প্যারীচাঁদের খ্যাতি মূলত আলালের ঘরের দুলাল- এর জন্য। যেখানে - প্যারীচাঁদ মিত্রের 'আলালের ঘরের দুলাল' নামক ব্যঙ্গ আখ্যান তাঁকে সমকালে ও পরবর্তী যুগে বিখ্যাত করেছে। গ্রন্থটিকে বাংলা সাহিত্যে প্রথম উপন্যাস বলা হলেও এটি আসলে বাংলা সাহিত্যের একটি সার্থক সামাজিক নকশা। আর সেই সামাজিক নকশায় আমরা দেখতে পাই- অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে নগরজীবনের উশৃঙ্খলতা ও অধঃপতিত সমাজের চিত্র। আর সেই চিত্রে উঠে আসে-
বৈদ্যবাটীর জমিদার রামরাম বাবুর পুত্র মতিলাল কিভাবে অতিরিক্ত আদরে ও কুসঙ্গে মিশে অধঃপাতে যায় লেখক গ্রন্থটিতে তা তুলে ধরেছেন। সেই দুঃখ দুর্দশার মধ্যে দিয়ে কিভাবে মতিলালের স্বভাবের পরিবর্তন হয় সেটাও লেখক এখানে চিত্রণ করেছেন। এরই পাশাপাশি নীতিকথা প্রচার করতে তিনি বরদাবাবু, রামলাল, বেণীমাধব প্রভৃতি প্রতীকী চরিত্রগুলি অবতারণা করেছেন। তবে গ্রন্থটির ঠকচাচা লেখকের সৃষ্টি একটি অন্যতম উজ্জ্বল চরিত্র। আসলে এই ঠকচাচা ভাড়ুদত্ত বা মুরারিশীলের উত্তরসূরী। তবে গ্রন্থটি মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণের অভাবে উপন্যাস পদবাচ্য হয়ে উঠতে পারিনি।তবে- প্যারীচাঁদ মিত্র তৎকালীন কলকাতার নগর জীবনের ব্যাভিচার ও শিক্ষাদীক্ষার সজীব চিত্র গ্রন্থটিতে অতি নৈপুণ্যের সাথে বর্ণনা করেছেন। পরিচয় দিয়েছেন কলকাতার সমকালীন শিক্ষা বিভ্রাটের। আর সেই পরিচয় আমরা দেখি-
"প্রত্যেক ক্লাসের প্রত্যেক বালকের প্রতি সমান। তদারক হইত না-বুঝুক বা না বুঝুক জানা আবশ্যক বোধ হইতো না এবং কি কি শিক্ষা করাইলে উত্তরকালে কর্ম্মে লাগিতে পারিবে, তাহারও বিচার হইতো না।"
আসলে প্যারীচাঁদ মিত্র সমকালীন সমাজ জীবনের বাস্তবচিত্র রূপায়িত করতে গিয়ে গুরুগম্ভীর সংস্কৃতবহুল ভাষার পরিবর্তে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করেছেন। আর এই ভাষা ব্যবহারের কারণে তিনি চরিত্রগুলিকে বাস্তবানুগ করে তুলেছেন। তাই বলা যায় যে,বাংলা গদ্যের প্রথম যুগে আলালের ঘরের দুলাল এর ভাষা একটি বিশিষ্ট ঐতিহ্য সৃষ্টির পথ প্রস্তুত করেছিল। সেখানে ভাষার ক্ষেত্রে দেখি- "ঠকচাচা চৌকির উপর থেকে হুমড়ি খেয়ে পড়িয়া বলিলেন- মোর ওপর এত না টিটকারী দিয়া বাত হচ্ছে কেন?... আসলে আদমির কাছে বহু শরমের বাত...।"। •প্যারীচাঁদের গদ্য রীতি• বাংলা সাহিত্যে প্যারীচাঁদের গদ্যকে 'আলালী' গদ্য বলা হয়ে থাকে। তবে মধুসূদন এই ভাষাকে জেলেদের ভাষা বলেছেন। আর বঙ্কিমচন্দ্র এই ভাষার উচ্ছসিত প্রশংসা করে বলেছেন- "তিনিই প্রথম দেখাইলেন যে, সাহিত্যের প্রকৃত উপাদান আমাদের ঘরেই আছে। তাহার জন্য ইংরেজি বা সংস্কৃতের কাছে ভিক্ষা করিতে। হয় না।"
আসলে প্যারীচাঁদ মিত্র ছোট ছোট সরল বাক্য দিয়ে ভাব প্রকাশ করার পক্ষপাতী ছিলেন। তাঁর ভাষার মূল কাঠামোটি ছিল সাধুরীতির। ক্রিয়াপদ ও সর্বনাম পদের ব্যবহারেই তার পরিচয় মেলে।
•প্যারীচাঁদ ও বিদ্যাসাগর•
প্যারীচাঁদ ও বিদ্যাসাগরের গদ্য রীতি ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত ধর্মী। সেখানে গদ্যের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর 'পন্ডিতী' রীতি গ্রহণ করেছিলেন। আর প্যারীচাঁদ মিত্র 'চলতিবুলি'কে গদ্যে রূপ দিয়েছেন। আসলে তিনি ভাষার মধ্যে ঘরোয়া রূপ আনতে চেয়েছিলেন। তবে বিদ্যাসাগরের গদ্যের মধ্যে যে বৈচিত্র্য তা প্যারীচাঁদের গদ্যে নেই। আসলে বিদ্যাসাগরী গদ্যের যেটি ত্রুটি, সেটি প্যারীচাঁদ উপলব্ধি করে তাঁর গদ্যরীতিকে সমৃদ্ধ করেছিলেন।
•প্রাবন্ধিক প্যারিচাঁদের কৃতিত্ব•
ক) বাংলা সাহিত্যে সর্বপ্রথম চলিত অর্থাৎ কথ্যভাষা প্রবর্তন করেন।
খ) গুরুগম্ভীর সাধু ভাষাকে তিনি নমনীয় রূপে সাহিত্যে প্রকাশ করলেন।
গ) যদি কথ্যরীতিতে গ্রন্থ লেখা প্যারীচাঁদের দ্বারা প্রবর্তিত না হতো, তাহলে বাংলা গদ্যের নতুন সম্ভাবনার পথ আর তাড়াতাড়ি তৈরি হত না।
ঘ) আলালের ঘরের দুলাল বাংলা সাহিত্যের সার্থক সামাজিক নকশা।
পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, যে ভাষায় সকলে কথোপকথন করে, তিনি সেই ভাষায় আলালের ঘরের দুলাল রচনা করলেন। আর সেই দিন থেকে বাংলা ভাষা শ্রীবৃদ্ধি শুরু হয়। আসলে তিনি বিষবৃক্ষের মূলে কুঠারাঘাত করেন। সামগ্রিকভাবে তাঁর সাহিত্যকর্ম স্মরণীয় হয়ে উঠেছে- "for it's significance in the history of ideas."
ঠিক এরূপ অসংখ্য বিষয়ভিত্তিক আলোচনা সাজেশন এবং ভিডিও পেতে ভিজিট করুন আমাদের SHESHER KOBITA SUNDORBON YOUTUBE CHANNEL.
Comments
Post a Comment