বিজন ভট্টাচার্যের আগুন নাটকের প্রথম ও দ্বিতীয় দৃশ্যের আলোচনা,ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ(একাদশ শ্রেণী,দ্বিতীয় সেমিস্টার, পশ্চিমবঙ্গ উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ) করো।
বিজন ভট্টাচার্যের আগুন নাটকে আমরা প্রথম দৃশ্যে দেখতে পাই যে, ভোরবেলার অস্পষ্ট আলোয় দেখা যায় গ্রামের একটি দরিদ্র পরিবারে সংসারের টুকিটাকি জিনিসপত্র। সেই সাথে আরো দেখা যায় যে, ওই ঘরের মেঝেতে তিনজন অকাতরে ঘুমিয়ে আছে।
ঠিক এরূপ পরিবেশের মধ্যে ভোরবেলায় মোরগের ডাক শোনা যায় এবং তার সঙ্গে দূরের কোন এক গ্ৰাম থেকে আজানের শব্দ ভেসে আসে। আর এমন সময় পরিবারের কর্তা অর্থাৎ পুরুষ নেত্যর বাবা শুয়ে শুয়ে বিড়ি টানে এবং ভাবতে থাকে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে চাল কেনার লাইনে দাঁড়াতে হবে। কারণ -
•দেরি হয়ে গেলে চাল না পেয়ে আবার খালি হাতে ফিরে আসতে হবে বাড়িতে। আর সেই কারণে পাশে ঘুমন্ত স্ত্রীকে ঠেলা মেরে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করে নেত্যর বাবা। আবার কলমি শাক, দাঁতন কাঠি আর কলা বিক্রি করে তার স্ত্রীকে চালের লাইনে দাঁড়াতে হবে। তাই যত তাড়াতাড়ি লাইন দিতে পারবে চাল পাওয়ার সম্ভাবনা ততই প্রবল হবে। ইতিমধ্যে-
•স্ত্রীকে ঘুম থেকে উঠতে বলে গামছা কাঁধে নিয়ে খালি পেটে নেত্যর বাবা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। অতঃপর নেত্যর মা ঘুম থেকে উঠে নিতাইকে বা নেত্যকে জাগায়। এতে ছেলে ভীষণ বিরক্ত হয়ে বলে- এ এক কাজ হয়েছে,রোজ রোজ চালের জন্য লাইনে দাঁড়ানো। একটু ভালো করে ঘুমানোর উপায় নেই। তখন তার মা বোঝানোর চেষ্টা করে দুপুরে ঘুমাবি, এখন তাড়াতাড়ি ওঠ্ বাজারে যেতে হবে যে। তারপর-বিক্রির পসরা নিয়ে নেত্যর মা ও নেত্য বাড়ি থেকে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যায়।
•• দ্বিতীয় দৃশ্যে আমরা দেখি যে, মঞ্চের মধ্যে নীল আলোয় দেখা যায় একখানা চালা ঘর। আর সেই ঘরের সামনে এক ফালি একটি উঠানও।ঘরের চৌকাঠের কাছে দাঁড়িয়ে আছে একজন চাষী বউ কৃষাণী। আর ঠিক বাইরে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে আছে কৃষাণ চাষী। কৃষানের হাঁটু পর্যন্ত কাপড় উঠানো, মাথায় গামছার ফেটি।এই কিষাণ চাষী তার হাতের কাস্তে দিয়ে পিঠ চুলকাতে থাকে। এখানে কৃষাণ কৃষাণীকে বলে যে- "আর কটা দিন অপেক্ষা কর, চৈত্র ফসল ঘরে উঠলেই তাদের অভাব, অনটন কিছুদিনের জন্য মিটে যাবে।"
তবে এখানে কৃষানের এই কথা শুনে কৃষাণী তার স্বামীর দিকে তাকিয়ে থাকে। আর তার স্ত্রীর সেই তাকানো দেখে কৃষাণ অনুভব করে এক অনন্ত প্রেমের অনুভূতি। কারণ সে তার স্ত্রীর দৃষ্টিতে প্রেমের দৃষ্টিপাত দেখতে পায়। তবে-
কৃষাণের অনেক পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু কোন কিছুই সে বাস্তবে রূপ দিতে পারিনি। তাই সে স্ত্রীকে আরেকটু অপেক্ষা করতে বলে, একটু কষ্ট করতে বলে এবং একটু ধৈর্য ধরতে বলে। অতঃপর কৃষাণ যাওয়ার সময় সে একটু পিছনে তাকায়। এই সময়-
কৃষাণ তার স্ত্রীকে বলে কেষ্টোর মার সাথে গিয়ে সবার প্রথমে চালের লাইনের দাঁড়াতে। দেরি হলে খালি হাতে ফিরে আসতে হবে। কাজ মিটিয়ে তাকে তাড়াতাড়ি বাড়ি আসতে জানায়। কারণ মাঠের কাজ থেকে ফিরলে তার যে খুব খিদে পায়। শুধু তাই নয়-
দেরিতে রান্না করলে তার খুব কষ্ট হয় খিদের যন্ত্রণায়। ঠিক সেই সময় তাদের পোষা গরুটি ডেকে ওঠে। কৃষকের মনে হয় গরুটি মাঠে যাওয়ার জন্য ডাকছে। মাঠে যাওয়ার আগে স্ত্রীকে আরেকবার জানায় যে, চালের লাইনে সে যেন সবার প্রথমে দাঁড়ায়।
(ঠিক এরূপ অসংখ্য বিষয়ভিত্তিক আলোচনা সের সাজেশন ভিডিও পেতে ভিজিট করুন আমাদের "SHESHER KOBITA SUNDORBON" YOUTUBE CHANNEL)
•• তৃতীয় দৃশ্যে আমরা দেখতে পাই যে,-কাকভোরে কারখানার শ্রমিক সতীশ ঘরের বারান্দায় বসে আছে। আর দূর থেকে ভেসে আসে কারখানার সাইরেন বাজার আওয়াজ।ঐ ঘরের মধ্যে ভোরেও সতীশের বউ,মেয়ে অকাতরে ঘুমাচ্ছে।সতীশ বিড়ি টানা শেষ করে তার মেয়ে ফুলকিকে ডাকে। অতঃপর এই সময়ে সতীশকে বলতে শুনি-
“মা মেয়ে যেন কুম্ভকর্ণ। সেই সন্ধ্যেবেলায় শুয়েছে এখনো ঘুম ভাঙেনি।”
এদিকে সতীশের সহকর্মী জুড়োন সতীশকে জানায় যে , সে আজ কারখানায় কাজে যাবে কিনা। তার উত্তরে সতীশ জানায়-কারখানায় নাগিয়ে তার কোন উপায় নেই। কারণ তার পক্ষে দৈনিক চাল,ডাল জোগাড় করা খুব কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তাই বাধ্য হয়েই তাকে কারখানার কাজে যেতেই হবে। আবার লাইনে দাঁড়ালে যে চাল পাওয়া যাবে তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। যেমন গতকাল ফুলকি এবং তার মা সারাদিন লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে খালি হাতে ফিরে এসেছে। তাই বাধ্য হয়ে মিস্ত্রির কাছ থেকে রাতে দেড় পোয়া চাল কর্জ করে এনে কোন মতে সেই দিনটি কাটিয়ে দেয়।
এদিকে প্রায় তিন মাস হয়ে গেল কোম্পানি কোন চাল,ডাল কিছুই দিচ্ছে না। তাই আজ সতীশ কোম্পানির বা দোকানের উপর সে ভরসা করতে পারেনা। পরিস্থিতি এমন যে পয়সা দিয়েও চাল ডাল পাওয়া যায়। এমনতর অবস্থায়-
সতীশ বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠে ফুলকিকে ঘুম থেকে ডেকে তোলো। ঘরে যদি সামান্য কিছু খাবার থাকে সেই খাবার খেয়ে সে কাজে বেরিয়ে যেতে চায়। কিন্তু তার স্ত্রী ক্ষিরি তার স্বামীর উপর রেগে ওঠে এবং স্বামীকে বলে-
“এই সকালবেলা সে কোথা থেকে। খাবার জোগাড় করবে?”
শুধু তাই নয়, সে আরও জানায় যে তার পরনের কাপড় নেই, পেটে ভাত নেই এ কেমন পুরুষ? যে খাবারটুকু জোগাড় করতে পারেনা! কিন্তু কেলোর বাবা কেলোর মাকে কত সুখে রেখেছে।কথাটি শুনে সতীশের মাথায় রাগ চড়ে গেলে ক্ষিরির উপর বেশ কয়েকটি লাথি মারে।এই ঘটনার আবর্তে মা ও মেয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করতে থাকে। অবস্থার বেগতিক দেখে সতীশ সেখান থেকে তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে পড়ে। অতঃপর-
•• চতুর্থ দৃশ্যে আমরা দেখতে পাই যে, এক মধ্যবিত্ত পরিবারের কথা। যারা সুস্থ,স্বাভাবিক পরিবেশের মধ্যে অবস্থান করে। আর এখানে আমরা দেখি কেরানী হরেকৃষ্ণ বাবু এবং তার স্ত্রী মনোরমাকে। যাদের পরিবারে চা,চিনি, চাল নেই- আছে একটা উনুন, কিন্তু জ্বালাবার কয়লা টুকুও নেই! তাই মনোরমা তার স্বামীকে একটু কষ্ট করে চাল আনতে বলে। কিন্তু তার অফিস আছে, আর চালের লাইনের দাঁড়ালেও যে চাল পাওয়া যাবে এমন কোন নিশ্চয়তা নেই। তবে মনোরমা অফিস থেকে যে চাল,ডাল দেওয়ার কথা ছিল তার খবরও জানতে চায়। আর তখন হরেকৃষ্ণ জানায় যে,তাদের নাম করে সরকারের থেকে চাল,ডাল কম দামে কিনে কর্তারা চড়া দামে বাইরে বিক্রি করে দেয়।আর একাজে ম্যানেজার ও সাহেবরা যুক্ত থেকে কালোবাজারি করছে। অতঃপর-
•• পঞ্চম দৃশ্যে আমরা দেখতে পাই যে,হরেকৃষ্ণ বাবু লাইনে দাঁড়িয়ে দেখে এক উড়িয়া লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে জিজ্ঞাসা করে চালের এমন সমস্যা কেন? কিন্তু সে কিছু বলতে পারে না।তবে সে জানায় চাল পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ উড়িষ্যা থেকে টনটন চাল আসছে। কিন্তু সেই চাল যাচ্ছে কোথায়? এমন সময় দোকান খুললে হরেকৃষ্ণ বাবু সিভিকের কাছে জানতে চায় আজ ক'সের চাল দেবে?কিন্তু তার উত্তর সে দিতে পারল না! শুধু জানতে পারল খুচরো পয়সা কাছে রাখতে।
এমন সময় প্রথম পুরুষ জানায় তার কাছে টাকা আছে, খুচরো পয়সা নেই। এই খুচরো পয়সা নিয়ে দুজনের মধ্যে বাকবিতণ্ডা চলতে থাকে।এমন সময় বাইরে থেকে এক ব্যক্তি লাইনে ঢুকে পড়লে সিভিক সেদিকে ছুটে যায় দ্বিতীয় পুরুষের দিকে। আর এখানে তৃতীয় পুরুষ তাকে মদত দেয়। এরই মধ্যে সিভিক অন্যদিকে চলে গিয়ে এক ব্যক্তিকে চড় মারে। কারণ সে নাকি একাধিকবার লাইনে ঢুকিয়ে চাল নিচ্ছে। কিন্তু-
এমন সময় চতুর্থ পুরুষ সিভিককে জানায় সে ঘন্টাখানেক আগে থেকে এই লাইনে দাঁড়িয়ে আছে এবং তৃতীয় পুরুষ তাকে চড় মারার জন্য প্রতিবাদ করতে থাকে। পাশাপাশি লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা এক মুসলমান ব্যক্তিও এই ঘটনার প্রতিবাদ জানায়। চতুর্থ পুরুষটি সিভিক এর কাছে আবেদন জানায় লাইনে দাঁড়ানোর জন্য। সে জানায়-
“সে আগে চাল নেয়নি, সে চোর নয়, পয়সা দিয়ে চাল নেবে-তাই সে কুকুরের মতো অপমান সহ্য করবে না।”
এই বিষয়টি নিয়ে সিভিক গার্ড ও চতুর্থ পুরুষের মধ্যে মারামারি শুরু হলে এক যুবক ‘আগুন’ বলে চিৎকার করতে থাকে। যুবকদের এই কথা শুনে সকলের জানতে চাই কোথায় আগুন লেগেছে আর তখন যুবকটি জানায়-
“আগুন লেগেছে সব মন্বন্তর পীড়িত নিরন্ন মানুষের পেটে।”
অবশেষে সকল মন্বন্তর পীড়িত মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়। প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় চতুর্থ পুরুষ সবাই চাল পায়। হরেকৃষ্ণ বাবু চতুর্থ পুরুষের কাছে নিজের ভুলের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে এবং তখন তৃতীয় পুরুষ জানায়-
“বাঁচতে হলে সবাইকে মিলেমিশেথাকতে হবে।”
অতঃপর আমরা দেখি সকলেই একে একে চাল নিয়ে সবাই নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায়। চালের লাইনটি ধীরে ধীরে ছোট হয়ে যাচ্ছে।
Comments
Post a Comment