বাংলা নাট্য সাহিত্যে রামনারায়ণ তর্করত্ন র অবদান আলোচনা করো (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্র বিশ্ববিদ্যালয়, তৃতীয় সেমিস্টার, বাংলা মেজর)
আলোচনা শুরুতেই আমরা বলে রাখি যে, মধুসূদনের পূর্বে বাংলা নাটকের প্রস্তুতিপর্বে নাটক রচনায় যার খ্যাতি তিনি হলেন 'নাটুকে রামনারায়ণ'। রামনারায়ণ তর্করত্ন বাস্তব ও সরস নাটক রচনার জন্য 'নাটুকে রামনারায়ণ' নামে জনপ্রিয়তার লাভ করেছিলেন। রাম নারায়ণ মূলত সামাজিক সমস্যা মূলক নাটক রচনা করলেও পৌরাণিক ও প্রহসন রচনায় তাঁর খ্যাতি যথেষ্ট। তাঁর নাটকের প্রধান সম্পদ হলো হাস্যরসের উপস্থাপনা। আসলে-
রামনারায়ণ সমাজ সচেতন নাট্যকার ছিলেন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রভাবে আমাদের সমাজে যে সংস্কারবাদ বনাম প্রগতিবাদের সংকট দেখা দেয় সে বিষয়ে যাঁরা সক্রিয় ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন রামনারায়ণ। তিনি প্রাচীনপন্থী ব্রাহ্মণ পণ্ডিত সমাজে জন্মগ্রহণ করলেও মানসিকতায় ছিলেন প্রগতিবাদী। কৌলিন্য প্রথা, বিধবা বিবাহ ও সতীদাহ প্রথা প্রভৃতি সম্পর্কে রামনারায়ণের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সমকালীন নবজাগ্রত জীবন চেতনার অনুসারী।আর-
জীবন চেতনাকে সামনে রেখে তিনি লিখলেন সামাজিক নাটক, পৌরাণিক নাটক, অনুবাদ মূলক নাটক এবং রোমান্টিক নাটক।
•১) সামাজিক নাটক রচনায় রামনারায়ণ তর্করত্নঃ
'কুলীনকুলসর্বস্ব'রামনারায়ণ তর্করত্নের একটি উল্লেখযোগ্য এবং প্রথম সামাজিক নাটক। যে নাটকে তিনি কৌলীন্যপ্রথার দোষ ও অসঙ্গতিকে উপস্থাপিত করেছেন। নাটকের কাহিনী হলো- এক কন্যাদায়গ্রস্থ ভদ্রলোক চার কন্যার যথেষ্ট বয়স হওয়া সত্বেও তাদের বিবাহ দিতে সক্ষম হননি। অবশেষে এক কুরূপ বৃদ্ধের সাথে কন্যাদের বিবাহ দিতে বাধ্য হন। নাটকের চরিত্র গুলির নাম বেশ কৌতুকময়-অনৃতাচার্য, অধর্মরুচি, বিবাহবণিক, উদরপরায়ণ, বিবাহবাতুল ইত্যাদি।তবে-
নাটকের কাহিনীর মধ্যে পরম্পরা কম থাকায় কাহিনিরস সৃষ্টি হতে পারেনি। কিন্তু পুরুষ চরিত্রের থেকে নারী চরিত্রের সংলাপ সহজ ও স্বাভাবিক হওয়ায় চরিত্রগুলি জীবন্ত হয়ে উঠেছে। শুধু তাই নয়, কুলপালক কন্যা তিনটির সংলাপ রচনায় লেখকের দক্ষতা প্রশংসনীয়। আর সেখানে আমরা দেখি দ্বিতীয় কন্যা কৌলিন্য প্রথার বিষময় ফল সম্পর্কে মাকে বলে- "বিয়ের খবর বল্লাল যেন টের না পায়, - কারণ টের পেলে সে টের পাওয়াবে।"
আসলে কৌলিন্য প্রথার ক্ষতিকারক দিক সম্বন্ধে রামনারায়ণ সচেতন ছিলেন বলেই 'কুলীনকুলসর্বস্ব' নাটকের মাধ্যমে সমাজের সমস্যা সংকুল বিষয়টি তুলে ধরতে প্রয়াসী হয়েছিলেন।
•২) পৌরাণিক নাটক রচনা রামনারায়ণ তর্করত্নঃ
পুরাণকে আশ্রয় করে রামনারায়ণ তর্করত্ন বেশ কতকগুলি নাটক রচনা করেছেন। আর তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাটক হলো রুক্মিণী হরণ, কংসবধ। এখানে রুক্মিণী হরণ নাটকের কাহিনী নাট্যকার পুরাণ গ্রন্থ থেকে গ্রহণ করেছেন বটে, তবে তা হুবহু অনুবাদ মূলক নাটক নয়। নাট্যকার নতুন চরিত্র সৃষ্টি করে পৌরাণিক ঘটনাকে নাট্যরসোত্তীর্ণ করে তুলেছেন। শুধু তাই নয়,পৌরাণিক চরিত্রের মধ্যে লৌকিক গুণের সমাবেশ ঘটিয়ে বাস্তব রসে তাদেরকে উজ্জ্বল করে তুলেছেন। তাদের সংলাপ আমাদের সমাজে অতি পরিচিত মানুষের মতই। আর ধনদাস চরিত্রের লোভ লালসা বেশ জীবন্ত রূপে চিত্রিত করেছেন।
•৩)রোমান্টিক নাটক রচনায় রামনারায়ন তর্করত্নঃ 'স্বপ্নধন' রামনারায়ণ তর্করত্নের একটি উল্লেখযোগ্য রোমান্টিক নাটক। আর সেই নাটকটিতে আলাদা দুই দেশের রাজপুত্র এবং রাজকন্যা স্বপ্নে পরস্পরকে দেখে পরস্পরের প্রতি প্রেমাভসক্ত হয়ে পড়েন। অবশেষে তাদের বাস্তব মিলন সংঘটিত হয়। রূপকথার কাহিনীই নাটকটির উৎসভূমি। এই নাটকে দীনবন্ধুর রোমান্টিক নাটকের প্রভাব লক্ষণীয়।
•নাট্য সাহিত্যে রামনারায়ণের গুরুত্ব•
•প্রথমতঃ রামনারায়ণের সামাজিক নাটক সেকালের জনমানসে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। আর সেখানে নাট্যকার পুরান ও পুরাণুকরণ ছেড়ে সর্বপ্রথম বাস্তব সামাজিক জীবনে এক দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন।
•দ্বিতীয়তঃ রামনারায়ণের নাটকগুলি রঙ্গমঞ্চে দীর্ঘদিন ধরে অভিনয় হওয়ার সুবাদে অনেক তরুণ নাট্যকার নতুন নাটক রচনায় অনুপ্রাণিত হয়।
•তৃতীয়তঃ মধুসূদনের আগে সামাজিক,পৌরাণিক, রোমান্টিক,অনুবাদ মূলক নাটক রচনা করে এ নাট্যকার সেকালের সকল শ্রেণীর দর্শকদের মানসিক চাহিদা পুরণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, রামনারায়ণ তর্করত্ন এমনই এক নাট্যকার যাঁর নাট্যকলম দিয়ে সেকালে সবদিকে কালিছিটাতে সক্ষম হয়েছিলেন। সমাজের অসঙ্গতি গুলি যেমন তার নাটকে উঠে এসেছে ঠিক তেমনি ভাবে উঠে এসেছে অনেক পুরান প্রসঙ্গ। পাশাপাশি তিনি অনেক প্রহসন নাটক রচনার মধ্যে দিয়ে সমাজের বহু বিষয় হাস্যরসের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। আসলে এ নাট্যকার সমাজের সবদিকে সমভাবে নজর দিয়ে সেইসকল বিষয়গুলো নাট্যপিপাসু দর্শকের সামনে তুলে ধরেছেন।
(ঠিক এরূপ অসংখ্য বিষয়ভিত্তিক আলোচনা সাজেশন এবং ভিডিও পেতে ভিজিট করুন আমাদের SHESHER KOBITA SUNDORBON YOUTUBE CHANNEL) ।
Comments
Post a Comment