Skip to main content

বাংলা (3rd.Sen Mejor )নাট্য সাহিত্যে তুলসী লাহিড়ীর অবদান আলোচনা করো।

বাংলার নাট্য সাহিত্যে তুলসী লাহিড়ীর অবদান আলোচনা করো।

          আলোচনা শুরুতেই আমরা বলে রাখি যে,প্রখ্যাত নট, নাট্যকার,নাট্যপরিচালক,গীতিকার তুলসী লাহিড়ী ছিলেন যুগন্ধর শিল্পী। যুগের অস্থিরতা, সংশয়, জিজ্ঞাসা তাঁর সৃষ্ট শিল্পে বাগ্ময় রূপ পেয়েছে। আসলে তিনি ছিলেন জীবনবাদী নাট্যকার। তবে প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন আইনজীবী কিন্তু নেশায় অভিনেতা ও সংগীত শিল্পী। কিন্তু-                                                              

         পরবর্তী সময়ে তুলসী লাহিড়ী আইন ব্যবসা ছেড়ে অভিনয়ের জগতে পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর নিজস্ব শিক্ষা-দীক্ষা, পারিবারিক সংস্কৃতি ও পরিবেশ, আইন ব্যবসার অভিজ্ঞতা, রংপুরের তদানীন্তন নাট্যসংস্কৃতি, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ ও পঞ্চাশের মন্বন্তরের প্রতিক্রিয়া এ নাট্যকারকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল।আর সেকারণেই তাঁর নাটকে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে মানুষের জীবনযাত্রা, তাদের বিশিষ্ট পরিবেশ, ভাষা ও সংস্কার তিনি গভীর আগ্রহ ও মমতার সাথে তুলে ধরেছেন। তবে-                             

            তুলসীর লাহিড়ীর নাট্য জগতের আবির্ভাবের পটভূমি ছিল বেশ স্মরণীয়। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক থেকে বাঙালির মনোজীবনে এক সর্বাত্মক আলোড়নের ঢেউ লেগেছিল। তৃতীয় দশক থেকে প্রশ্ন, সংশয়, জিজ্ঞাসার ক্ষেত্রে নতুন মোড় পরিবর্তনের সূচনা করল। আর চতুর্থ দশক থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সর্বগ্রাসীর তাণ্ডবের ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া, মন্বন্তর, দেশ বিভাগজনিত ভাঙাগড়া প্রভৃতি মানুষের জীবনবোধের ক্ষেত্রে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করলো। যেখানে-                                           পূর্ব লালিত সংস্কার, জীবনবোধ গণ্ডি চেতনার বাইরে বাঙালি মানসিকতাকে এক ধাক্কায় একটা অস্থিরতা অনিশ্চয়তার বিশাল প্রান্তরে এনে দিল। আর সেদিন অর্থনৈতিক,সামাজিক ও নৈতিক জীবন নিদারুনভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ল। নৈতিক মূল্যবোধ সম্পূর্ণ বদলে গেল। অর্থনৈতিক সংকট, পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের ক্ষেত্রে গুরুতর পরিবর্তন ঘটলো। বস্তুত যুদ্ধ,মন্বন্তর,দেশবিভাগ আমাদের শান্ত নিরুদ্বিগ্ন বিভিন্ন জীবনে যে শোচনীয় বিপর্যয় এনে দিল সেই ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ পটভূমিতে নাট্যকার তুলসী লাহিড়ীর আবির্ভাব।আর সেই  সময়ে-

         যুগের অস্থিরতা, সংশয়, জিজ্ঞাসা তুলসী লাহিড়ীর নাটকে বাস্তব রূপ লাভ করেছে। যুদ্ধের বিভীষিকা ও তার তীব্র প্রতিক্রিয়া, মন্বন্তরের কুৎসিত বিপর্যয়,দেশবিভাগ, উত্তর বাঙালির জীবনের অর্থনৈতিক,সামাজিক,নৈতিক মূল্যবোধের বিক্রিয়াজনিত পরিবর্তন দ্রুত পরিবর্তনশীল সমাজের রূপ ও রূপান্তর তাঁর নাট্যশিল্পে রূপান্তরিত হয়েছে। গভীর জীবন সমস্যাকে তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর নাটকে। তবে তাঁর প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য মানুষ।আর সেখানে-

          তুলসী লাহিড়ী মোট ১৩টি পূর্ণাঙ্গ নাটক ও ১৫টি একাঙ্ক নাটক রচনা করেন। কাহিনী বিন্যাসের নৈপুণ্যে,চরিত্র চিত্রনের দক্ষতায়, জীবনবোধের গভীরতায় তিনি নাট্যসাহিত্যে সমুজ্জ্বল।এক অর্থে বলা যায় যে, তাঁর নাটকগুলি উদ্দেশ্যমূলক সৃষ্টি। ঠিক তেমনই-

•'দুঃখীর ইমান'নাটকে আমরা দেখি বিশ্বগ্রাসী যুদ্ধে ক্ষুধার অরণ্যে আমাদের দেশের খাদ্য গেল। সেই সাথে  নিমেষের মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেল জীবন ধারণের সামান্যতম দ্রব্যও। সাধারণ মানুষ অন্ন-বস্ত্রহীন হয়ে পথে প্রান্তরে ঘুরতে লাগলো। শুধু তাই নয়, মানুষের চিরপোষিত নীতি, ধর্মসংস্কার দুর্যোগের ঝড়ে জীর্ণ পত্রের মতো খসে পড়ল। সমাজের এই অসহনীয় বাস্তব অবস্থা তাঁর নাটকে উদঘাতিত হয়েছে। আসলে -           

     "এ নাটক শুধু দুঃখীদের ঈমান নয়, এদেশের                   সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ও মুসলিম কৃষকদের প্রতি                   বাংলার একজন অভিজ্ঞ শিল্পীর ইমান।"

•'ছেঁড়া তার'তুলসী লাহিড়ী শ্রেষ্ঠ নাটক। আর এই নাটকটি কৃষিজীবন ভিত্তিক। যেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় ভয়াবহ মন্বন্তর সাধারণ মানুষের জীবন কিভাবে বিপর্যস্ত করেছিল তারই মর্মান্তিক চিত্র নাটকটিতে প্রতিফলিত হয়েছে। যেখানে একদিকে সমগ্র দেশের, অপরদিকে রহিম-ফুলজানের সংসারে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও নৈতিক অপচয়ের শোচনীয় পরিনাম অঙ্কিত হয়েছে। নাটকটির কাহিনী দ্বারা প্রধান চরিত্র রহিমকে কেন্দ্র করে বিবর্তিত ও পরিবর্তিত হয়ে বিষাদজনক পরিণতিতে পৌঁচেছে। আর সেখানে শ্রমিক আন্দোলনের আদর্শকে সামনে রেখে নাট্যকার ও নাটকের অভ্যুদয় ঘটে। আর তারই ফলশ্রুতি হিসেবে রচিত হল ছেঁড়া তার নাটকটি। যে নাটকে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে সম্ভাব্য গণ আন্দোলনের। 

     নবনাট্য আন্দোলনের পটভূমিকারূপে দুর্ভিক্ষ, মন্বন্তর, কায়েমি স্বার্থের শোষণ ও চক্রান্ত, ধর্মীয় ভাঁড়ামি,ফ্যাসিবাদী শক্তির প্রকাশকে নাট্যকার রূপ দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু এর মধ্য থেকে সাধারণ মানুষ সচেতন হয়ে উঠেছে, তাদের বক্তব্যও প্রতিবাদের আকার গ্রহণ করেছে। যে প্রতিবাদের দ্বারা নাট্যকার মানুষের গননাট্য আন্দোলনের ইঙ্গিতকে স্পষ্ট করেছেন। ছেঁড়া তার তাই শুধু তার ছিঁড়ে যাওয়ার কাহিনী দিয়ে শেষ হয়নি। তার যারা ছিঁড়ে দেয়, যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও জীবনের ছন্দ যারা হারিয়ে ফেলতে বাধ্য হয় তাদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে সচেতন করার ইঙ্গিতের মাধ্যমে নাট্যকার ছেঁড়া তারের যবনিকা টেনেছেন।

      তুলসী লাহিড়ীর নাটকে সমকালীন দেশ ও মাটির মানুষের ভাবনা অবিচ্ছিন্নভাবে প্রকাশিত হয়েছে। বিভিন্ন আঞ্চলিক পটভূমিকায় চিত্রিত তার নাট্যকাহিনীতে পরিবেশ, রচনাকৌশল লক্ষ্যনীয়। তাই তাঁর নাটকে উঠে এসেছে আধুনিক সংগ্রামী মানুষের ত্রুটি-বিচ্যুতি, অবক্ষয়, নৈরাশ্য,সাফল্য, ব্যর্থতা। এক কথায় যন্ত্রণাকাতর মানুষের অসামান্য শিল্প রূপের প্রকাশ ঘটেছে তাঁর নাটকগুলিতে। আর এদিক থেকে নাট্যকার হিসেবে তিনি খ্যাতির শীর্ষদেশে পৌঁছেছেন।

          পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, তুলসী লাহিড়ী তাঁর নাটকে লোকজীবনকে প্রাধান্য দিয়ে সেই লোকজীবনের একজনকে নাটকের নায়ক করবার প্রয়াস করেছেন। কিংবা জনতা চরিত্রের মধ্যে প্রতিবাদের রূপ দেবার প্রত্যক্ষ প্রয়াস তাঁর নাটকগুলোতে লক্ষ্য করা যায়। যার ফলে তাঁর নাটকগুলি এক অর্থে দুর্ভিক্ষ সাহিত্য বা মন্বন্তরের সাহিত্য বলা যেতে পারে। সেই দুর্ভিক্ষ বা মন্বন্তরের চিত্র তাঁর নাটকগুলিতে বাস্তব রূপ গ্রহণ করেছে।

ঠিক এরূপ অসংখ্য বিষয়ভিত্তিক আলোচনা সাজেশন এবং ভিডিও পেতে ভিজিট করুন আমাদের SHESHER KOBITA SUNDORBON YOUTUBE CHANNEL 


Comments

Popular posts from this blog

দর্শন প্রথম সেমিস্টার সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তর।

দর্শন প্রথম সেমিস্টার সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, মাইনর সিলেবাস)  ১)চার্বাক মতে ভূত কয়টি ও কি কি? উত্তরঃচার্বাক মতে ভূত চারটি- ক্ষিতি, অপ্ , তেজ ও মরুৎ ২) স্বভাববাদ কী? উত্তরঃ চার্বাক জড়বাদের ভিত্তি হল স্বভাববাদ। যে মতবাদ অনুসারে স্বভাব থেকেই ভূত সৃষ্টি, আবার স্বভাব থেকেই বিচ্ছেদ। যার জন্য ঈশ্বরকে স্বীকার করা প্রয়োজন নেই। ৩) অব্যাপ্যদেশ কথাটির অর্থ লেখো। উত্তরঃ অব্যাপ্যদেশ বলতে বোঝায়- অশাব্দ অর্থাৎ যাকে শব্দের দ্বারা প্রকাশ করা যায় না। ৫) জ্ঞান লক্ষণ প্রত্যক্ষ কাকে বলে?  কোন একটি ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে তার নিজের বিষয়ীভূত গুণ ছাড়াও যদি অপর একটি ইন্দ্রিয়ের বিষয়ীভূত গুণকে প্রত্যক্ষ করার হয়, তাহলে সেই প্রত্যক্ষকে জ্ঞানলক্ষণ প্রত্যক্ষ বলা হয়। ৬) ন্যায় মতে প্রমাণের প্রকার  উত্তরঃ ন্যায় মতে প্রমাণ চার প্রকার। প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান এবং শাব্দ। ৭) সন্নিকর্ষ কাকে বলে? উত্তরঃ ন্যায় মতে ইন্দ্রিয় ও কোন বাস্তব পদার্থের মধ্যে একপ্রকার বিশেষ সম্পর্ক ঘটলে তবেই আমাদের একটি বস্তুর প্রত্যক্ষজ্ঞান ।আর ঐ বিশেষ বিশেষ সম্পর্কের পারিভাষিক নাম হলো সন...

ব্রিটিশ(3rd.Sem) পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব

ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব(পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় তৃতীয় সেমিস্টার রাষ্ট্রবিজ্ঞান মাইনর সিলেবাস)। ব্রিটেনের সংবিধান অলিখিত বলে বিভিন্ন ঐতিহাসিক দলিল, শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতি, পার্লামেন্ট প্রণীত আইন প্রভৃতির মাধ্যমে পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব অর্জিত হয়েছে। ব্রিটেনের পার্লামেন্ট আইনানুগ সার্বভৌমত্ব অর্জন করেছে, রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব নয়। আর সেখানে আইনানুগ সার্বভৌমত্ব বলা হয়, কারণ-       যেকোনো বিষয়ে পার্লামেন্ট আইন প্রণনয়নের অধিকারী। এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র হওয়ায় পার্লামেন্টে কোন আইন প্রণয়নের সময় প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় না। কমন্সসভা তথা নিম্নকক্ষের সার্বভৌমত্বকেই বলা হয় পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব।     ••ব্রিটিশ পার্লামেন্টকে সার্বভৌমত্ব বলার কারণ- ১) পার্লামেন্টের ওপর আইনগত কোনরূপ বাধানিষেধ আরোপ করা যায় না। ২) পার্লামেন্ট প্রণীত আইনের বৈধতার ব্যাপারে আদালত কোন প্রশ্ন তুলতে পারেনা। ব্রিটেনের আদালত পার্লামেন্ট প্রণীত আইনের ওপর বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার দ্বারা সীমিত করতে পারে না। ৩) ব্রিটিশ পার্লামেন্টের আইন প্রণয়ন ক্ষমতার উপর শাসনবিভাগ অনুরূপ ন...

ইতিহাস (3rd Semester) সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর।

 তৃতীয় সেমিস্টার ইতিহাস মাইনর সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, তৃতীয় সেমিস্টার ইতিহাস মাইনর)। ১)বন্দেগান-ই-চাহালগানি বলতে কী বোঝায়? •উত্তরঃবন্দেগান-ই-চাহালগান বলতে চল্লিশ জন তুর্কি ও অ-তুর্কি দাসদের সমন্বয়ে গঠিত একটি বাহিনীকে বোঝায়। এই বাহিনীকে ডাল চালিশা বা তুরকান-ই- চাহালগানি নামে ডাকা হতো। ২)আমির খসরু কে ছিলেন? •উত্তরঃ আমির খসরু ছিলেন প্রখ্যাত সুফি সাধক বা আরেফ নিজামউদ্দিন আওলিয়ার ছাত্র এবং অন্যতম প্রধান খলিফা। যাঁকে 'ভারতের তোতা' উপাধি দেওয়া হয়েছিল। ৩) মহরানা প্রতাপ কে ছিলেন?  •উত্তরঃ মেবারের শিশোদিয়া রাজবংশের একজন হিন্দু রাজপুত রাজা ছিলেন মহারানা প্রতাপ সিং। যিনি রাজপুতদের বীরত্ব ও দৃঢ় সংকল্পের প্রতীক। বহু বছর ধরে তিনি মুঘল সম্রাট আকবরের সঙ্গে লড়াই করেন। ৪) জায়গীরদারী সংকট কী? •উত্তরঃ জায়গিরদারী সংকট ছিল মোগল সাম্রাজ্যের একটি অর্থনৈতিক সংকট। এই সংকটে জমি বা জায়গিরের অভাব দেখা দিয়েছিল। যার ফলে প্রশাসনিক খরচ মেটানো এবং যুদ্ধের খরচ বহন করা সম্ভব হতো না। ৫) দাক্ষিণাত্য ক্ষত কী? •উত্তরঃ দাক্ষিণাত্য ক্ষত বলতে ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীত...