ভারতবর্ষের মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠায় বা সুলতানি সাম্রাজ্যের সংহতির জন্য গিয়াসউদ্দিন বলবন এর ভূমিকা আলোচনা করো(পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় তৃতীয় সেমিস্টার ইতিহাস মাইনার)।
ভূমিকাঃ আলোচনা শুরুতেই আমরা বলে রাখি যে, কগিয়াসউদ্দিন বলবন সিংহাসন আরোহন করার পর নানাবিধ জটিল সমস্যা সমস্যার সম্মুখীন হন। সেই সময়ে যুদ্ধবিগ্রহ ও অব্যবস্থার ফলে রাজকোষ প্রায় শূন্য হয়ে পড়েছিল। আর এরূপ অবস্থার মধ্যে দেশের অভ্যন্তরে বিদ্রোহ, দস্যুদের উপদ্রব, অপরদিকে বৈদেশিক আক্রমণের সম্ভাবনা সমগ্র অবস্থাটাকে জটিল করে তুলেছিল। কিন্তু গিয়াসউদ্দিন বলবন অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে এবং নানা রকম উপায় অবলম্বন করে রাজশক্তিকে শক্তিশালী করেন এবং সেই সাথে সাম্রাজ্যের সংহতি রক্ষা করতে বিশেষভাবে উদ্যোগী হন। আর সেখানে আমরা দেখি-
১) রাজ আদর্শে বলবনঃ দিল্লির সুলতানদের মধ্যে গিয়াস উদ্দিন বলবন প্রথম রাজতন্ত্রকে একটি শক্তিশালী ও স্বয়ংক্রিয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে উপস্থাপিত করতে বিশেষভাবে প্রয়াসী হয়েছিলেন। আসলে তাঁর উদ্দেশ্য ছিল নিজস্ব শক্তির ওপর আস্থা রেখে রাজতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করা। আসলে তিনি-
ক) পারসিক রাজতন্ত্রের আদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তবে তিনি সুলতানদের দ্বৈবস্বত্ত্বে ও সৈরতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন।
খ) গিয়াসউদ্দিন বলবান সুলতানের বাহ্যিক আড়ম্ভর ও মর্যাদার উপর বিশেষ গুরুত্ব দিলেন এবং রাজতন্ত্রকে এক মহতী মর্যাদা প্রদান করা ছিল এর উদ্দেশ্যে।
গ) প্রজাবর্গ ও অভিযাত শ্রেণীর আনুগত্য লাভ এবং রাজ্যের নিরাপত্তা বিধান করার নীতি গ্রহণ করলেন।
ঘ) প্রজাবর্গের মধ্যে রাজকীয় মর্যাদা বৃদ্ধি এবং ভীতি উৎপাদনের জন্য তিনি সিজদা পাইবস প্রভৃতি পারসিক আদব কায়দা ও রীতির প্রচলন করলেন। এই সকল নীতি গ্রহণ করার ফলে রাজকীয় মর্যাদা ও ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করতে বলবন কিছুটা সক্ষম হয়েছিলেন।
২) শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষায় বলবনঃ গিয়াসউদ্দিন বলবন মেওয়াটি দস্যুদের উৎখাত করে এবং অভিজাত শ্রেণীর স্বেচ্ছাচার দমন করে দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। আসলে তাঁর শাসন ব্যবস্থা ছিল সামরিক শাসন ব্যবস্থা। আর এখানে তিনি গুপ্তচর বাহিনী নিয়োগ করে দেশের বিভিন্ন অংশ থেকে সংবাদ সংগ্রহের ব্যবস্থা করেন। যার মধ্যে দিয়ে দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় থাকে।
৩) নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থাঃ গিয়াসউদ্দিন বলবন বিচার বিষয়ে বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। আসলে তিনি ছিলেন ন্যায় বিচারের সমর্থক এবং বিচারে যাতে কোন প্রকার পক্ষপাতিত্ব না হতে পারে তার জন্য তিনি নানান ব্যবস্থা অবলম্বন করেছিলেন। অভিজাত সম্প্রদায়ের বিশেষ ক্ষমতা গুলির যিনি অবসান ঘটান এবং প্রয়োজনমতো তিনি তাদের শাস্তি দিতে দ্বিধা করেননি।
৪)রাজ্যের জয়ের নীতিঃগিয়াসউদ্দিন বলবান ছিলেন সামরিক শক্তিতে বিশ্বাসী। কারণ তিনি মনে করতেন সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করে রাজ্যের সংহতি বজায় রাখা সম্ভব। তাই তিনি সর্বশক্তি দিয়ে সামরিক ক্ষেত্রে সংস্কার সাধন করেন।
৫) মঙ্গলদের প্রতিরোধঃ দিল্লির সাম্রাজ্যের কাছে সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল মুঘলদের আক্রমণ। আর তাদের আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য মুলতান, দিপালপুর, সুনাম অঞ্চলে তার প্রথম এবং দ্বিতীয় পুত্রকে সসৈন্যে মোতায়ন করেন। তবে -
১২৭৯ সালে মোঙ্গলরা পাঞ্জাব আক্রমণ করলে তাঁর দুই পুত্রের কাছে পরাজিত হয়ে শেষ পর্যন্ত ভারত ত্যাগ করতে বাধ্য হন।
গুণীদের সমাদরঃ মঙ্গল আক্রমণের মধ্য এশিয়া থেকে বিতাড়িত ১৫ জন রাজা কে তার রাজসভায় স্থান দিয়েছিলেন। গণিত সমতলে তিনি কখনো বিমুখ ছিলেন না। ওই সময়ের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি ভারতের তোতাপাখি বলে পরিচিত আমির খসরু ঐতিহাসিক মীনহাজউদ্দিন তারিখ সভা অলংকৃত করতেন।
পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, বলবন যখন দিল্লির সিংহাসনে বসেন সেই সময় দিল্লির সুলতানিরা অত্যন্ত সংকটজনক অবস্থায় ছিলেন। এমনকি দিল্লির সুলতানি রাজ্যের অস্তিত্ব বিপন্ন প্রায়। আর এই জায়গায় দাঁড়িয়ে বলবান অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে সেই অবস্থার মোকাবিলা করেন। শুধু তাই নয়-
তিনি এই সময়কালে রাজ্য বিস্তার নীতি থেকে সচেতন ভাবে সরে আসেন। আবার বিদেশী মঙ্গল আক্রমণ প্রতিরোধ করে রাজ্যের নিরাপত্তার বিধান করেছিলেন। আসলে তুর্কি শাসনের ভিত্তি সুদৃঢ় করাই ছিল তার প্রথম কাজ ও কর্তব্য। তাই তার হাত ধরে তুর্কি সাম্রাজ্য অপমৃত্যুর হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছিল। অতঃপর তাঁর প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করে আলাউদ্দিন খলজী সুলতানি সাম্রাজ্যের চরম অগ্রগতি সাধন করেন।
Comments
Post a Comment