গীতগোবিন্দ কাব্য অবলম্বনে কবি জয়দেবের কাব্য প্রতিভা আলোচনা করো।
আলোচনার শুরুতেই আমরা বলে রাখি যে,কবি জয়দেব বাঙালি কবি, 'গীতগোবিন্দ' র কাব্যের কবি।তবে তিনি বাঙালি কবি হয়েও তাঁর কবি খ্যাতি আসমুদ্র হিমাচল পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত।আর সেকারণেই কবি জয়দেব আজও প্রতি ঘরে ঘরে শ্রদ্ধার সাথে, ভক্তির সাথে পূজিত। কারণ তাঁর একখানি কাব্যই তাঁকে সাহিত্যের দরবারে অমরত্ব দান করেছে। তবে--
গীতগোবিন্দ সংস্কৃত কাব্য, যেখানে গীত রচনাই প্রাধান্য পেয়েছে। তবে বলে রাখা ভালো যে, কবি জয়দেবের পূর্বে সংস্কৃত সাহিত্যে আর কেউ এই সংগীতমূলক সংস্কৃত কাব্য রচনা করেননি। পাশাপাশি একথাও উল্লেখযোগ্য যে, জয়দেবের পরেও সংস্কৃত সাহিত্যে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য রচনা সাহিত্য দরবারে জায়গা করে নিতে পারেনি। আর এদিক থেকে বলা যেতে পারে- কবি জয়দেব সংস্কৃত সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য অন্যতম এবং শেষ কবি। যিনি লক্ষণ সেনের যে পাঁচটি রত্ন, তাঁর সভা আলোকিত করে থাকতেন। তাই -
কালের বিচারে কবি জয়দেব সংস্কৃত সাহিত্যের অবক্ষয় যুগের কবি। কিন্তু প্রতিভা এবং জনপ্রিয়তার বিচারে সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটে মহাকবি কালিদাসের পরই যে তাঁর আসন,সে বিষয়ে কোন সন্দেহর অবকাশ নেই। আসলে জয়দেবের আবির্ভাব কালটি ভারতীয় সাহিত্যের ইতিহাসে এক যুগসন্ধিকাল। যে কালে মধ্যযুগের অন্তে তখন নবযুগের আবির্ভাবস্চিত হচ্ছে। আর ঠিক সেই সময়ে-
নব্য ভারতীয় আর্যভাষা সমূহ তথা ভারতের আঞ্চলিক ভাষাসমূহ তখন আত্মপ্রকাশের পথে। ঠিক তখন সংস্কৃত ভাষা উচ্চ সমাজে কোন প্রকারে বেঁচেবর্তে আছে মাত্র। আর ঠিক সেই সময়ই আবির্ভূত হলেন কবি জয়দেব। যিনি ক্ষয়িষ্ণু সংস্কৃত সাহিত্যে নিয়ে এলেন নতুন যুগের ধ্বনি। যেখানে সংস্কৃত সাহিত্যের পতন দশায় কবি 'গীতগোবিন্দম' এর মাধ্যমে শেষবারের মতো উজ্জ্বল আলো সামনে তুলে ধরলেন। আর সেখানে আমরা দেখি-
গীতগোবিন্দ কাব্যখানি দ্বাদশ সর্গে রচিত। যেখানে আছে ২৪ টি গানের একটি পালা। এছাড়াও কাহিনীতে আছে বিভিন্ন ছন্দে রচিত বেশ কতকগুলি শ্লোক। আর এই গান বা শ্লোকগুলি কৃষ্ণ,রাধা বা কোন এক সখীর উক্তি রুপে সমগ্র কাব্যে ব্যবহৃত হয়েছে। যার ফলে কাব্যটি একটি নাটকের পালায় আকার ধারণ করে। তবে বারটি স্বর্গের একটি ভিন্ন ভিন্ন নাম আছে, যে নামগুলি বিশেষ অর্থবহ এবং তাৎপর্যপূর্ণ। আর সেখানে সেই কাব্যে আমরা দেখি-
বসন্তকাল সমাগত। প্রেমলীলার পরম নায়ক শ্রীকৃষ্ণ ও পরম নায়িকা রাধা পরস্পর মিলন কামনায় ব্যাকুল হয়ে উঠেছেন। এসময় সখীমুখে শ্রীরাধার হৃদয়েরর অবস্থা জানতে পেরে শ্রীকৃষ্ণ তাকে কুঞ্জে আসতে বলেন। কিন্তু শ্রীরাধা তখন শ্রীকৃষ্ণের বিরহে এমনই কাতরা যে, চলচ্ছক্তি পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছেন। তাই তিনি কৃষ্ণকেই আসার জন্য অনুরোধ করে পাঠালেন। শ্রীকৃষ্ণ আসবেন জেনে শ্রীরাধা সারারাত্রি প্রতীক্ষা করলেন। শেষে বিলাপের মধ্য দিয়েই তাঁর রাত্রি শেষ হল। এদিকে রাত্রি শেষ হতে শ্রীকৃষ্ণ সেখানে উপস্থিত হলেন। অভিমানিনী রাধার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়, মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে শ্রীকৃষ্ণের প্রতি তীব্র ভৎসনা বাক্য। শেষে সখীর উপদেশে ও চেষ্টায় রাধার ক্রোধ কিছুটা প্রশমিত হলে শ্রীকৃষ্ণ দীর্ঘকাল ধরে অনুনয় বিনয়ে তাঁর প্রীতি উৎপাদনে সমর্থ হলেন। এরপর শ্রীরাধা কৃষ্ণের শাশ্বত মিলনের মধ্যে দিয়ে গীতগোবিন্দ কাব্যের কবি জয়দেব পরিসমাপ্তি করেছেন।
পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, গীতগোবিন্দ কাব্যখানি শ্রেষ্ঠতম সংস্কৃত কাব্য। কারণ এ কাব্যের গানের ভাষা প্রাচীন সংস্কৃত কাব্যের সমকালীন অপভ্রংশ ও প্রাকৃত কাব্যের ভাষাকে সংমিশ্রত করে মধুর কোমলকান্ত পদাবলী সৃষ্টি করেছেন। যেখানে আছে অলৌকিক দেবকাহিনীর সাথে লৌকিক প্রেমকথা। যে কথা ভারতীয় সাহিত্যে একেবারেই অভিনব এবং নাটকীয় গুণসম্পন্ন। যার ফলে কাব্যখানি ভক্ত রসিক সমাজের ভক্তি ও রসতৃষ্ণা নিবারণে সমর্থ হয়েছে। আর সেকারণে-
আমরা বলতে পারি,যিনি ভক্ত তিনি এ কাব্য থেকে কখনোই আরাধ্য দেবতার সন্ধান পেতে পারেন না, কিন্তু যিনি কাব্যরসিক তিনি অবশ্যই এ কাব্য থেকে অনাবিল আনন্দ লাভে পরিতৃপ্তি পাবেন। সুতরাং কাব্যে দেবটকাহিনী বর্ণনায় কবি হিসেবে জয়দেবের জয় এখানেই আমরা বলতে পারি।
ঠিক এরূপ অসংখ্য বিষয়ভিত্তিক আলোচনা সাজেশন এবং ভিডিও পেতে ভিজিট করুন আমাদের SHESHER KOBITA SUNDORBON YOUTUBE CHANNEL ।
Comments
Post a Comment