কালিদাস রচিত নাটকগুলির নাম লেখো। উক্ত নাটকগুলির মধ্যে কোনটিকে তুমি শ্রেষ্ঠ বলে মনে করো, সে সম্পর্কে আলোচনা করো।
আলোচনা শুরুতেই আমরা বলে রাখি যে, সংস্কৃত সাহিত্যে কালিদাস অতুলনীয় কবি।শুধু মাত্র কবি নন, তিনি সংস্কৃত সাহিত্যের একজন অতি পরিচিত নাট্যকার। বলা যেতে পারে ভারতবর্ষের সাহিত্য বিশ্বে যে খ্যাতি লাভ করেছিল তা তাঁরই সাহিত্য রচনার মধ্যে দিয়ে, বিশেষ করে নাট্য রচনার মাধ্যমে।আর সেই নাট্যকারের অন্যতম বিশেষ, বিখ্যাত নাটক হলো 'অভিজ্ঞান শকুন্তলম্'। শুধুমাত্র অভিজ্ঞান শকুন্তলম নয়, তার অন্যান্য নাটকগুলি হলো-বিক্রমোর্বশী, মালবিকাগ্নিমিত্র।
•'অভিজ্ঞান শকুন্তলম্'নাট্যকার কালিদাসের শ্রেষ্ঠ রচনা। প্রেম ও সৌন্দর্যকে তিনি এই নাটকে এমনভাবে তুলে ধরেছেন যে প্রত্যেক পাঠকই এই নাটকটি পড়ে মুগ্ধ না হয়ে পারবেন না। তবে প্রেম এখানে শ্রেয়োবোধের দ্বারা পরিশলিত হয়ে পবিত্ররূপ ধারণ করেছে। তাই প্রেম এখানে শুধু সম্ভোগের বস্তু বলে গণ্য হয়নি। তবে-
অভিজ্ঞান শকুন্তলম্ নাটকের কাহিনী নাট্যকার গ্রহণ করেছেন মহাভারতের আদিপর্ব এবং পদ্মপুরাণ থেকে। তবে এখানে বলে রাখা ভালো যে, তিনি মহাভারতের এবং পদ্মপুরাণ থেকে কাহিনী গ্রহণ করলেও কাহিনীর মধ্যে নাটকীয় সুক্ষরসের আমদানি করেছেন, যা তাঁর একান্ত নিজস্ব। শুধু তাই নয়, মহাভারতে দুর্বাসার অভিশাপ নেই, এটি নাট্যকারের উদ্ভাবনা এবং এই উদ্ভাবনে দেখানো হয়েছে ভোগে নয়, ত্যাগেই মঙ্গলকে পাওয়া যায়। যার ফলে তাঁর নাটকে প্রেম অপেক্ষা প্রেমের কামনা যুক্ত হয়েছে। তবে -
আমরা বলতে পারি অভিজ্ঞান শকুন্তলা কালিদাসের শ্রেষ্ঠ রচনা প্রেম ও সৌন্দর্যকে তিনি নাটকে উপস্থাপিত করেছেন একান্ত নিজস্ব বৈশিষ্ট্যগুনে। যার ফলে তাঁর নাট্যেৎকর্ষ এবং কবিত্ব পাঠকের মনকে জয় করে নিয়েছেন। আসলে শকুন্তলায় যা কিছু বাস্তব রসের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়; কালিদাসের কালে সমাজে কি চেহারা ছিল-তারও কিছু ছবি শকুন্তলা নাটকের দেখা যায়। রাজপ্রাসাদে দ্বারপালের উৎকোচ গ্ৰহণের বিষয়টিও তাঁর দৃষ্টি এড়ায়নি। আসলে বাস্তব জগতের প্রতি কালিদাস দৃষ্টি দিয়েছেন এবং জাগতিক ঘটনার কিছু কিছু বিচার বিশ্লেষণ করেছেন,যা নাট্যকারেরাই করে থাকেন। তবে-
প্রসঙ্গত বলা দরকার যে,কালিদাসের মধ্যে নাটকাবলীর অভিনেতা গুণ একটু কম ছিল। তাঁর কোন নাটকেই ঘটনার দুর্বার গতি নেই, শুধু আবেগের সুক্ষতাই সেখানে মুগ্ধ হয়ে উঠেছে। তবে শকুন্তলাতে যে প্রেমের পরিচয় পাওয়া যায় তাতে বাস্তবতার যোগ নেই প্রায় বললেই চলে। অবশ্য প্রেম লিরিক কাব্যেরই বর্ণিতব্য বিষয়। কালিদাসও লিরিক রসের মাধ্যমে কিছু শ্লোকের সাহায্যে এই প্রেমের আবেগ পাঠক তথা দর্শকের সামনে তুলে ধরেছেন।সেই জন্য তাঁকে নাট্যকার অপেক্ষা কবি হিসেবেই সমালোচকরা বড় বলে ভেবেছেন।
কালিদাসের সর্বশ্রেষ্ঠ নাটক অভিজ্ঞান শকুন্তলম্। যেখানে শকুন্তলার জীবন কাহিনী অবলম্বন করে তিনি এই নাটকটি রচনা করেছেন। একতা সম্রাট দুষ্মন্ত উপলক্ষে কণ্বমুনির আশ্রম সীমান্তে উপনীত হয়ে মহর্ষির আতিথ্য গ্রহণ করেন। তখন অবশ্য মহর্ষি কন্ব আশ্রমে ছিলেন না। যেখানে দুষ্মন্ত শকুন্তলার রূপ লাবণ্য বিমোহিত হয়ে তার জন্ম বৃত্তান্ত জেনে গান্ধর্ব মতে বিবাহ করেন। বিবাহের পর রাজনীতিতে নিয়ে যাওয়ার আশ্বাস দিয়ে দুষ্মন্ত ফিরে যান। কিন্তু-
শকুন্তলা দুষ্মন্তের চিন্তায় একদা ভাবতন্ময় হয়ে পড়েন। ঠিক সেই সময় ঋষি দুর্বাসার আগমন ঘটলেও তাঁর আহ্বান শকুন্তলা শুনতে পাননি। ঠিক সেই সময় দুর্বাসা তাকে অভিশাপ দেন যে, যার জন্য সে এতই ভাবতন্ময় হয়ে পড়েছে সে তার জীবন থেকে বিস্মৃত হবে। এই সময় শকুন্তলার সখী অনুসূয়া ও প্রিয়ম্বদা ঋষিকে তুষ্ট করে অভিশাপ খন্ডনের একটি উপায় জানতে পারেন। আর সেই উপায়টি হলো শকুন্তলা যদি কোন অভিজ্ঞান দেখাতে পারেন তবে রাজার তাঁকে মনে পড়বে। এদিকে সন্তানসম্ভবা হয়ে পতিগৃহে যাওয়ার সময় নদীতে রাজা দুষ্মন্তের দেওয়া আংটিটি আঙ্গুল থেকে খুলে পড়ে যায়।তবে-
সঠিক সময়েই শকুন্তলা কোন অভিজ্ঞান দেখাতে না পারায় অপমানিত হয়ে রাজসভা থেকে বিতাড়িত হন। অবশেষে তিনি কশ্যপমুনির আশ্রমে আশ্রয় লাভ করার পর এক সন্তানের হয়। তিনি হলেন ভরত। নানা ঘটনা প্রবাহের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া শকুন্তলার আংটি টি রাজা দুষ্মন্তের হাতে এসে পৌঁছায়। অতঃপর দুষ্মন্তের পূর্বের সব কথা মনে পড়ে। কিন্তু নানা খোঁজাখুঁজির পরেও তিনি শকুন্তলাকে ফিরে পেলেন না। অতঃপর অসুর দমন করে স্বর্গ থেকে প্রত্যাবর্তনের সময় কশ্যপমুনির আশ্রমে উপনীত হয়ে একটি দুরন্ত বালকের হাতের রেখা প্রত্যক্ষ করে ভাবলেন এ নিশ্চয়ই কোন সৌভাগ্যবান রাজার তনয়। আর সেই তনয় ভারতের সূত্র ধরে রাজা দুষ্মন্ত ও শকুন্তলার পুনর্মিলন ঘটে।
নাটকটির মধ্যে ভাবাবেগ এবং রসসৃষ্টির উৎকর্ষতা সম্পর্কে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। কারণ নাটকটিতে তিনি প্রকৃতির যে সজীবতা এবং প্রকৃতির সঙ্গে মানবহৃদয়ের অবিচ্ছেদ্য সম্বন্ধ, তা তিনি শকুন্তলা নাটকের মধ্যে তুলে ধরেছেন। যার মধ্যে দিয়ে নাট্যকারের গার্হস্থ্য জীবনবোধ ও পরিমিতি বোধের পরিচয় দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, চরিত্র সৃষ্টিতে তিনি স্বাতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের পরিচয় দিয়েছিলেন,যা নাট্য সাহিত্যের ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। এদিক থেকে বিচার করলে অবশ্যই বলা যায় যে অভিজ্ঞান শকুন্তলম্ নাটকটি নাট্যকার কালিদাসের অনন্য সৃষ্টি এবং তিনি অনন্য নাট্যকার।
Comments
Post a Comment