দিল্লির সুলতানি বংশের পতনকে তুমি কিভাবে ব্যাখ্যা করবে? অথবা দিল্লি সুলতানি পতনের কারণগুলি কি ছিল ?সেগুলি লেখো (তৃতীয় সেমিস্টার, ইতিহাস মাইনার)
আলোচনা শুরুতেই আমরা বলে রাখি যে, পৃথিবীর ইতিহাসে কোন সাম্রাজ্যের চিরস্থায়ী অস্তিত্বের নজির নেই। সুলতানি রাজবংশও এই স্বাভাবিক নিয়মে কোন ব্যতিক্রম ছিল না। প্রকৃতপক্ষে ফিরোজ তুঘলকের মৃত্যুর অনেক আগেই সুলতানি রাজবংশের পতন শুরু হয়েছিল। আর সেই পতনের কারণগুলি হল-
প্রথমতঃ ফিরোজের মৃত্যুর পরই তাঁর পুত্র মহম্মদ এবং উজিরের মধ্যে উত্তরাধিকার নিয়ে সংঘর্ষ শুরু হয়েছিল। তুঘলক বংশের সর্বশেষ সুলতান ছিলেন নাসির উদ্দিন মামুল।১৪১২ খ্রিস্টাব্দে তুঘলক বংশের অবসান ঘটেছিল।
দ্বিতীয়তঃ প্রাদেশিক শাসকরা নিজেদের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং এ ব্যাপারে গুজরাটের শাসক প্রথম স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। অতঃপর পাজগরের খোকরা, মালব ও খান্দেশের শাকরা বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। নাসিরুদ্দিন মামুদ উজির খোজা-ই-জাহান কনৌজ থেকে বিহার পর্যন্ত নিজের শাসনে নিয়ে আসেন। এইভাবে জৌনপুর রাজ্যের সৃষ্টি হয়েছিল। বহু প্রভাবশালী হিন্দু প্রধানরা সেদিন থেকে ভূমি রাজস্ব দেওয়া বন্ধ করেছিলেন।।
তৃতীয়তঃ ক্রীতদাস বা দাসদের বিদ্রোহ ফিরোজ শাহ তুঘলকের সাম্রাজ্যের ভিত্তি শিথিল করে দিয়েছিল।
চতুর্থতঃ ফিরোজ তুঘলকের সাম্রাজ্যের উপর প্রচন্ড আঘাত এনেছিলেন তৈমুরলং। ১৩৯৮ থেকে ১৩৯৯ খ্রিস্টাব্দে তৈমুরলং দিল্লিতে ব্যাপক ধ্বংসলীলা এবং লুণ্ঠন করেছিলেন। তিনি নিজের দেশে চলে যাবার সময় প্রচুর ধন সম্পত্তি ছাড়াও বহু সংখ্যক ক্রীতদাসদের নিয়ে গিয়েছিলেন। তাছাড়াও পাথর কাটা ও খোদাইয়ের কাজে দক্ষ অনেক রাজমিস্ত্রিকে তাঁর সমরখন্দের প্রাসাদ নির্মাণ ও সুন্দর করে গড়ে তোলার জন্য নিয়ে গেছেন। তিনি লাহোর,দিপালপুর এবং মুলতান নিজের সাম্রাজ্যের অধীনে এনেছিলেন।
পঞ্চমতঃ দিল্লির সুলতানি বংশের পতনের জন্য কোন একজন বিশেষ সুলতানকে দায়ী করা চলে না। কারণ সুলতানীর অধীনস্থ অনেক প্রভাবশালী আঞ্চলিক শাসকদের আনুগত্যের অভাব এবং প্রকারন্তরে বিদ্রোহী মনোভাব অভ্যন্তর থেকে সুলতানি বংশকে দুর্বল করেছিল। এছাড়াও কেন্দ্রীয় সরকারের দুর্বলতার সুযোগ তারা প্রায়শই নিতেন।
ষষ্ঠতঃ সুলতানীর সৈন্যবাহিনী ছিল বহু জাতি ও গোষ্ঠীর অধ্যুষিত। সেখানে তুর্কি, আফগান, মোঙ্গল নব্য মুসলমান, রাজপুত,জাঠ প্রভৃতি ছিল বহুজাতি ও গোষ্ঠী সম্প্রদায়। আর এই সকল সম্প্রদায়ের প্রত্যেকের নিজস্ব কিছু সমস্যা ছিল, তাই তারা ঐক্যবদ্ধভাবে যুদ্ধ করতে পারত না
পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, সুলতানদের উত্তরাধিকার সংক্রান্ত যুদ্ধ এবং বিবাদ সুলতানের পতনের অন্যতম কারণ ছিল। জ্যেষ্ঠ পুত্রকেই সুলতানের মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার হিসেবে মেনে নিতে হবে এরকম কোন বাঁধা ধরা নিয়ম ছিল না। যার ফলে সুলতানের মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার সংক্রান্ত যুদ্ধ উচ্চভিলাষী অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে ভাঙ্গন সৃষ্টি করেছিল তবে-
ফিরোজের মৃত্যুর পর এই দ্বন্দ্ব ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল। অবশেষে এই ঘটনা দিলের সুলতানের পতনের পথ ও প্রশস্ত করেছিল। আবার ফিরোজ তুঘলক মাঝে মাঝে অসহিষ্ণুতার পরিচয় দিয়েছিলেন। ব্যাপক ধর্মীয় সহিষ্ণুতার পরিচয় দিতে তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন। তার ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা প্রকারন্তরে গোঁড়া ধর্মীয় উলেমাদের শক্তি বৃদ্ধি করে। তিনি তাঁর পূর্ববর্তী শাসক মহম্মদ বিন তুঘলকের হিন্দু মুসলমান উভয়কে নিয়ে মিশ্র শাসক গোষ্ঠী গড়ে তোলার প্রচেষ্টাকে অনুসরণ করতে পারেননি। যার ফলে দিল্লির সুলতানি শাসনের পতন অবসম্ভাবি হয়ে পড়ে।
Comments
Post a Comment