Skip to main content

রামমোহন রায় (3rd.Sem) বাংলা গদ্যের জনক বা গদ্য সাহিত্য বিকাশে তাঁর অবদান আলোচনা করো।

রামমোহন রায় বাংলা গদ্যের জনক বা গদ্যসাহিত্যের বিকাশে তাঁর অবদান অসামান্য- আলোচনা করো(পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, তৃতীয় সেমিস্টার বাংলা মেজর) ।

           আলোচনা শুরুতেই আমরা বলে রাখি যে, বাংলা নবজাগরণের যুগে এই বাংলায় রামমোহন রায়ের আবির্ভাব। আসলে তিনি আধুনিক বাংলাদেশের নবজাগরণের অগ্রপথিক। তবে তিনি শুধুমাত্র বাংলা গদ্যের লেখক নন, তিনি বাংলাদেশের আধুনিক চিন্তাধারার প্রবর্তক। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন-

     "রামমোহন রায়কে আমাদের বর্তমান                              বঙ্গদেশের নির্মাণকর্তা বলিয়া আমরা জানি।                 কি রাজনীতি কি সমাজনীতি এমন কিছু নাই।                রামমোহন রায় স্বহস্তে সূত্রপাত করিয়া যান নাই।"

              •গদ্য সাহিত্যের প্রেরণাঃ 

সামাজিক অভিজ্ঞতাই রামমোহনের গদ্য সাহিত্যের প্রেরণা। তাঁর মধ্যে সকল প্রাবন্ধিকের গুণ ছিল- আরবি, ফারসি, সংস্কৃত, ঊর্দু ইংরেজি ভাষায় প্রবল অভিজ্ঞ ছিলেন। আর সেই অভিজ্ঞতার সাথে ছিল তাঁর প্রবল বৃদ্ধিও বিচার করার ক্ষমতা‌। তবে বেদ-বেদান্ত তন্ত্র বিষয়ে তিনি ছিলেন প্রাচীন সমার্থক। আবার শিক্ষা ও সমাজ দর্শনের ক্ষেত্রে ইংরেজের স্বতন্ত্রবোধ তথা পাশ্চাত্য ধ্যান ধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন।

                 •বেদান্ত গ্ৰন্থঃ 

রবীন্দ্রনাথের মতে- রামমোহন ভারত পথিক। আর এই পথিক সুন্দর পথের হাত ধরে ধর্মের গোঁড়ামী থেকে আচার সর্বস্ব কুসংস্কার থেকে মানবজাতিকে তিনি মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। আর সেই তিনি বলেন নিরাকার ঈশ্বর সাধনা সম্ভব। তবে তিনি অদ্বৈতবাদী হলেও সংস্কার বিমুখ ছিলেন না ছিলেন প্রবল যুক্তিবাদী। 

           •সাময়িক পত্র পরিচালনায়ঃ 

রামমোহনের 'সম্বাদ কৌমুদী'পত্রিকা ১৮২১ সালে প্রকাশিত হয়। শ্রীরামপুর মিশন প্রচারিত সাময়িক পত্রিকায় হিন্দু ধর্মের বিরুদ্ধে বিভিন্ন রচনা প্রচারিত হতে দেখে তিনি তাঁর পত্রিকায় তীব্র প্রতিবাদ করতে থাকেন। এছাড়াও নানাবিধ সারগর্ভ প্রবন্ধে কলেরব পূর্ণ থাকত। এছাড়াও তিনি ইংরেজি ও ফরাসি পত্রিকা ও প্রকাশ করেছিলেন। 

                  •প্রাবন্ধিক রামমোহনঃ 

১৮১৫ থেকে ১৮১৯ এর মধ্যে রামমোহন কয়েকখানি উপনিষদের অনুবাদ করেন। এছাড়াও বেদান্ত গ্রন্থ ও বেদান্ত সার নামক দুই খানি বেদান্ত সম্বন্ধে গ্রন্থ প্রকাশ করেন। আর এই দুটি গ্রন্থে তিনি বেদান্ত মতের বিচার করেছেন। যে বিচারের মধ্যে দিয়ে তিনি একেশ্বরবাদ প্রতিষ্ঠা ও ব্রাহ্মধর্মের ভিত্তি স্থাপন করেন। এছাড়াও সহমরণ প্রথা নিবারণের যৌক্তিকতা নিয়ে তিনি বিশদ যুক্তি প্রদর্শন করেছেন। আসলে তাঁর প্রবল ব্যক্তিত্বই তাঁর রচনার মধ্যে প্রতিফলিত। তবে তিনি প্রাচ্যের ভাবানুগামী হলেও সামাজিক ও ব্যক্তিগত আচারে, শিক্ষাগত, সামাজিক মতবাদে পাশ্চাত্ত্যনুসারী ও বিষয়কর্মে সু অভিজ্ঞ ছিলেন।

                        •ভাষারীতিতেঃ 

বাংলা গদ্য ভাষা রামমোনের হাতে আভিজাত্য লাভ করে। তিনি বাংলা শিশু গদ্যে বেদান্ত উপনিষদের তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করেন। প্রাচীন শাস্ত্রের প্রমাণে এবং যুক্তির প্রবলতায়, বিতর্কে তাঁর গদ্য এক কঠিন পৌরষ লাভ করে। বাংলা গদ্যে গুরুগম্ভীর আলোচনা তিনিই প্রথম দেখালেন। তবে তাঁর গদ্যে সরলতা না থাকার জন্য তাঁকে অভিযুক্ত করা যায় না। তবুও তিনি পূর্বের তুলনায় ভাষাকে জড়ত্ব ও কাঠিন্য থেকে মুক্ত করেন।আর সবদিক থেকে আলোচনা করলে রামমোহন রায়কে বাংলা ভাষার প্রথম প্রাবন্ধিক বলা যেতেই পারে।

                •রামমোহনের গদ্যঃ

 বাংলা গদ্য সাহিত্যে রামমোহন রায়ের গদ্য উচ্চ প্রশংসিত সে বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। কারণ তাঁর গদ্যভাষা এতটাই সহজ সরল যে,আপামর জনসাধারণ সকলেই তাঁর গদ্য ভাষাকে নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে একান্ত আপন করে নিয়েছিল।আর সন্দেহ নেই বলেই প্রমথ চৌধুরী রামমোহন রায়ের গদ্যকে বলেছেন-                                                                         "জলবৎ তরল।"

আর এই দৃষ্টিতে তাঁর গদ্য ভাষার প্রধান বৈশিষ্ট্য গুলি হল-

•রামমোহনের গদ্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল বোধগম্যতা। গদ্যকে আড়ষ্টতার হাত থেকে মুক্ত করার জন্য তিনি যতিচিহ্ন ব্যবহার করেন। ফলে গদ্য পাঠকের কাছে তাঁর ভাষা বোধগম্য হলো এবং অর্থবোধও পূর্বের তুলনায় সহজ হলো।

•বাংলা সাহিত্যে তিনি সর্বপ্রথম লেখক যিনি আধুনিক অনুশীলিত মন লইয়া গদ্য রচনায় আত্মনিয়োগ করেছেন। তাঁর গদ্য মননদীপ্ত ও ভাবের সমুন্নতিতে মর্যাদাময়।

•রামমোহন রায় নিজের বিষয়কে প্রতিষ্ঠা করতে একদিকে খ্রিস্টান মিশনারীদের অপরদিকে হিন্দু পন্ডিতের সঙ্গে তর্কযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে বাংলা গদ্যকে তর্ক-বিতর্কের অনিবার্য বহন করে তুলেছেন।

           পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, বাংলা গদ্য পরিসরে, পরিবর্তনে, পরিবর্ধনে, আধুনিকতায় উন্নতিতে রামমোহনের ভূমিকা অসামান্য। তবে তিনি বাংলা গদ্যের আদি জনক কিনা তা আমাদের আলোচনা করা দরকার। কারণ বাংলা গদ্যের ভিত্তি স্থাপনে ফোট উইলিয়াম কলেজের পন্ডিতদের দান অপরিমেয়। তার ভাষারীতি উন্নত, তবে তাঊর গদ্যের একটা বড় ত্রুটি হলো ইংরেজি কমপ্লেক্স বাক্যের অনুসরণে বাংলা বাক্যের কাঠামো গড়ে তোলা। রামমোহনের বহুপূর্বে মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার বাংলা গদ্যকে সাহিত্যরূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। সে কারণেই রামমোহনকে বাংলা গদ্যের উল্লেখযোগ্য লেখক এবং প্রাবন্ধিক বলে অভিনন্দিত করলেও বাংলার গদ্যের জনক বলা চলে না।

Comments

Popular posts from this blog

দর্শন প্রথম সেমিস্টার সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তর।

দর্শন প্রথম সেমিস্টার সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, মাইনর সিলেবাস)  ১)চার্বাক মতে ভূত কয়টি ও কি কি? উত্তরঃচার্বাক মতে ভূত চারটি- ক্ষিতি, অপ্ , তেজ ও মরুৎ ২) স্বভাববাদ কী? উত্তরঃ চার্বাক জড়বাদের ভিত্তি হল স্বভাববাদ। যে মতবাদ অনুসারে স্বভাব থেকেই ভূত সৃষ্টি, আবার স্বভাব থেকেই বিচ্ছেদ। যার জন্য ঈশ্বরকে স্বীকার করা প্রয়োজন নেই। ৩) অব্যাপ্যদেশ কথাটির অর্থ লেখো। উত্তরঃ অব্যাপ্যদেশ বলতে বোঝায়- অশাব্দ অর্থাৎ যাকে শব্দের দ্বারা প্রকাশ করা যায় না। ৫) জ্ঞান লক্ষণ প্রত্যক্ষ কাকে বলে?  কোন একটি ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে তার নিজের বিষয়ীভূত গুণ ছাড়াও যদি অপর একটি ইন্দ্রিয়ের বিষয়ীভূত গুণকে প্রত্যক্ষ করার হয়, তাহলে সেই প্রত্যক্ষকে জ্ঞানলক্ষণ প্রত্যক্ষ বলা হয়। ৬) ন্যায় মতে প্রমাণের প্রকার  উত্তরঃ ন্যায় মতে প্রমাণ চার প্রকার। প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান এবং শাব্দ। ৭) সন্নিকর্ষ কাকে বলে? উত্তরঃ ন্যায় মতে ইন্দ্রিয় ও কোন বাস্তব পদার্থের মধ্যে একপ্রকার বিশেষ সম্পর্ক ঘটলে তবেই আমাদের একটি বস্তুর প্রত্যক্ষজ্ঞান ।আর ঐ বিশেষ বিশেষ সম্পর্কের পারিভাষিক নাম হলো সন...

ব্রিটিশ(3rd.Sem) পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব

ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব(পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় তৃতীয় সেমিস্টার রাষ্ট্রবিজ্ঞান মাইনর সিলেবাস)। ব্রিটেনের সংবিধান অলিখিত বলে বিভিন্ন ঐতিহাসিক দলিল, শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতি, পার্লামেন্ট প্রণীত আইন প্রভৃতির মাধ্যমে পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব অর্জিত হয়েছে। ব্রিটেনের পার্লামেন্ট আইনানুগ সার্বভৌমত্ব অর্জন করেছে, রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব নয়। আর সেখানে আইনানুগ সার্বভৌমত্ব বলা হয়, কারণ-       যেকোনো বিষয়ে পার্লামেন্ট আইন প্রণনয়নের অধিকারী। এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র হওয়ায় পার্লামেন্টে কোন আইন প্রণয়নের সময় প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় না। কমন্সসভা তথা নিম্নকক্ষের সার্বভৌমত্বকেই বলা হয় পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব।     ••ব্রিটিশ পার্লামেন্টকে সার্বভৌমত্ব বলার কারণ- ১) পার্লামেন্টের ওপর আইনগত কোনরূপ বাধানিষেধ আরোপ করা যায় না। ২) পার্লামেন্ট প্রণীত আইনের বৈধতার ব্যাপারে আদালত কোন প্রশ্ন তুলতে পারেনা। ব্রিটেনের আদালত পার্লামেন্ট প্রণীত আইনের ওপর বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার দ্বারা সীমিত করতে পারে না। ৩) ব্রিটিশ পার্লামেন্টের আইন প্রণয়ন ক্ষমতার উপর শাসনবিভাগ অনুরূপ ন...

ইতিহাস (3rd Semester) সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর।

 তৃতীয় সেমিস্টার ইতিহাস মাইনর সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, তৃতীয় সেমিস্টার ইতিহাস মাইনর)। ১)বন্দেগান-ই-চাহালগানি বলতে কী বোঝায়? •উত্তরঃবন্দেগান-ই-চাহালগান বলতে চল্লিশ জন তুর্কি ও অ-তুর্কি দাসদের সমন্বয়ে গঠিত একটি বাহিনীকে বোঝায়। এই বাহিনীকে ডাল চালিশা বা তুরকান-ই- চাহালগানি নামে ডাকা হতো। ২)আমির খসরু কে ছিলেন? •উত্তরঃ আমির খসরু ছিলেন প্রখ্যাত সুফি সাধক বা আরেফ নিজামউদ্দিন আওলিয়ার ছাত্র এবং অন্যতম প্রধান খলিফা। যাঁকে 'ভারতের তোতা' উপাধি দেওয়া হয়েছিল। ৩) মহরানা প্রতাপ কে ছিলেন?  •উত্তরঃ মেবারের শিশোদিয়া রাজবংশের একজন হিন্দু রাজপুত রাজা ছিলেন মহারানা প্রতাপ সিং। যিনি রাজপুতদের বীরত্ব ও দৃঢ় সংকল্পের প্রতীক। বহু বছর ধরে তিনি মুঘল সম্রাট আকবরের সঙ্গে লড়াই করেন। ৪) জায়গীরদারী সংকট কী? •উত্তরঃ জায়গিরদারী সংকট ছিল মোগল সাম্রাজ্যের একটি অর্থনৈতিক সংকট। এই সংকটে জমি বা জায়গিরের অভাব দেখা দিয়েছিল। যার ফলে প্রশাসনিক খরচ মেটানো এবং যুদ্ধের খরচ বহন করা সম্ভব হতো না। ৫) দাক্ষিণাত্য ক্ষত কী? •উত্তরঃ দাক্ষিণাত্য ক্ষত বলতে ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীত...