বাংলা কাব্য ও কবিতায় কাজী নজরুল ইসলামের কবি কৃতিত্বের পরিচয় দাও (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় তৃতীয় সেমিস্টার বাংলা মেজর)।
আলোচনা শুরুতেই আমরা বলে রাখি যে, রবীন্দ্র যুগে তিনজন কবি অতি ধীরলয় গতিতে বর্ধিত হয়েছেন। শুধু বর্ধিত নয়, তাঁরা রবীন্দ্রবাণীকণিকা থেকে রস আহরণও করেছেন। কিন্তু তাঁদের বেশ কিছু মৌলিক নিজস্ব চিন্তা ভাবনার দ্বারা তাঁরা প্রবুদ্ধ হয়েছিলেন। আর সেই সকল চিন্তা ভাবনায় প্রবুদ্ধ হয়ে যে সমস্ত কাব্য ও কবিতা তাঁরা রচনা করেছেন,তার মধ্যে ভাষা ভঙ্গিমায় রবীন্দ্রানুসরণ লক্ষ্য করা গেলেও তাঁদের বক্তব্যের মধ্যে অদ্ভুত অভিনবত্বের সূচনা হয়েছিল। বলা যায় পরবর্তীকালে রবীন্দ্রপন্থা পরিত্যাগ করে আধুনিক বাংলা কবিতা যে নতুন পথে যাত্রা করেছে, তার প্রধান প্রথম পথিক হলেন কাজী নজরুল ইসলাম। যাঁর মধ্যে ছিল আধুনিক বাংলা কবিতার রস ও রবীন্দ্র প্রভাব ছাড়িয়ে নতুন পথে যাত্রার শুভ ইঙ্গিত। যেখানে -
কাজী নজরুল ইসলাম রুদ্রভাবের কবিতা লিখে যে অভিনবত্বের সূচনা করেন, তার বিস্ফোরণের কিছুকাল স্বয়ং কবিগুরুও ম্লান হয়ে গিয়েছিলেন। আসলে নজরুলের জীবন ও কাব্য দুই-ই বিস্ময়কর, অভিনব, উৎকেন্দ্রিক। রবীন্দ্র যুগে প্রেম অধ্যাত্মবাদ, সৌন্দর্যবোধ প্রভৃতি শান্তরসাস্পাদ কাব্যপ্রত্যয় ছেড়ে হাবিলদার কবি নজরুল ইসলাম একেবারে সামরিক হুংকার দিয়েই কাব্যপ্রাঙ্গনে প্রবেশ করলেন। তবে-
কাজী নজরুল ইসলাম শিক্ষা-দীক্ষায় পোশাকিভাবে বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেননি। কিন্তু অবলীলাক্রমে শিক্ষার যে ফল জ্ঞানলাভ ও ভূয়োদর্শন, তা তাঁর আয়ত্তে হয়েছিল। প্রথম মহাযুদ্ধে নাম লিখিয়ে নজরুল কিছুকাল সামরিক আবহাওয়ায় বাস করি নিজের কাব্যবোধকে সানিয়ে নিয়েছিলেন। সেখান থেকে ফিরে এসে ঘর বাঁধলেন বটে, কিন্তু ঘরের মায়া তাঁকে কখনো বেঁধে রাখতে পারেনি। বন্ধুবৎসল নজরুল বন্ধুদের আড্ডায় ধুমকেতুর মতো আবির্ভূত হতেন। যাঁর ওষ্ঠাধারে পানের রস এবং কন্ঠে সুরের রেশ নিয়ে তিনি সঙ্গীতে ডুবে যেতেন। যেখানে-
নজরুল যৌবন ধর্মের অতিরেকে সারা দেশটাকে চষে বেড়াতেন। আর সেখানে ছিল তার তেজী ঘোরার মত দুরন্ত দুর্মদ যৌবনবেগ, যা তাঁকে কোথাও স্থির থাকতে দেয়। বিদ্রোহ ব্যঞ্জক কবিতা ও গান লিখে তিনি 'বিদ্রোহী কবি' আখ্যা পেয়েছিলেন। আর কবি এর সম্মান পেয়েছিলেন বাংলার জনসাধারণের কাছ থেকে।আসলে-
নজরুল ইসলাম বাংলায কবিতায় আনলেন নতুন যুগ, নতুন চেতনা। তিনি অতিক্রম করলেন রবীন্দ্রনাথের প্রভাবকে এবং বাঞ্ছিত এক পরিবর্তনকে অবশ্যম্ভাবী করে তুললেন-যার ফলে কল্লোল গোষ্ঠীর লেখকদের আবির্ভাব ঘটল। তবে সমকালীন যুগের যে চাহিদা ছিল,সেই চাহিদা নজরুল নিজের মধ্যেই সাঙ্গীকৃত করে প্রতিবাদী চেতনায় মানুষের আকাঙ্ক্ষা গুলিকে তিনি কাব্যে তুলে ধরলেন। আর এখানেই তাঁর কাব্যের মৌলিকতার প্রমাণ মেলে। যেখানে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন, সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন, ওয়াহাবী আন্দোলন, সোভিয়েত বিপ্লব, অসহযোগ আন্দোলন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট থেকে তিনি কখনো নিজেকে সরিয়ে রাখেননি,বরং ওতপ্রোতভাবে নিজেকে পৌঁছে দিয়েছেন জনমানসে। কারণ তিনি উপলব্ধি করেছেন যে, মানুষ আজ অত্যাচারের, অবিচারের শাসন, শোষণের আঘাতে জর্জরিত। মায়ের বুক থেকে সন্তান অপহৃত, অজস্র প্রাণ বলিদান, সাম্প্রদায়িক হানাহানি এর মতো না বিষয়গুলি 'আমার কৈফিয়ৎ' কবিতায় তিনি তুলে ধরেছেন।তবে-
নজরুল ইসলাম মানুষের কবি তাই মানুষের সমান অধিকার ও সম্ভাবনার দিকে তিনি সমানভাবে জোর দিয়েছেন এবং মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, সুখ দুঃখ, যৌবনপ্রেম, বীরধর্ম প্রভৃতি বিষয় নিয়ে কবিতা লিখেছেন। যে কবিতাগুলি পরবর্তীকালে কবিদের কাছে নতুন পথের দিশা দেখায়। আর সেখানে এ কবির কবি স্বভাবের বৈশিষ্ট্য গুলি হলো-
১) "আমি শুধু সুন্দরের হাতে বীণা ,পায়ে পদ্মফুল দেখিনি, তার চোখে চোখ ভরা জল দেখেছি।"
২)"স্রষ্টাকে আমি দেখিনি কিন্তু মানুষকে দেখেছি।... কিছু করতে যদি নাই পারি তাদের সাথে প্রাণ ভরে যেন কাঁদতে পারি।"
৩) "ফুল ফোটানোই আমার ধর্ম, তরবারি আমার হাতে বোঝা, কিন্তু তাই বলে তাদের ফেলেও দেইনি।"
•আসলে উক্ত উদ্ধৃতিগুলি নজরুলের শিল্পতাত্ত্বিক চেতনার পরিচয় বহন করে। ওয়াল্টার পেটার কথিত 'শিল্পের জন্য শিল্প' এ কথা তিনি মানেননি, বরং তিনি মনে করতেন- 'মানুষের জন্য শিল্প'। তাই 'আমার কৈফিয়ত' কবিতা তিনি তাঁর কাব্যরচনার আদর্শ সম্বন্ধে জানালেন-
"প্রার্থনা করো যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস। যেন লেখা হয় আমার রক্তলেখায় তাদের সর্বনাশ।"
নজরুলের কাব্যে দুটি ধারা-সৌন্দর্য ও প্রেমধ্যানে তিনি আদর্শবাদী কিন্তু সমাজ ও রাষ্ট্রচিন্তায় তিনি বাস্তববাদী। আর এই বাস্তব জীবন প্রীতি বিদ্রোহের নেতিবাদ থেকে বিপ্লবের আদেশে দীক্ষিত করেছে, সর্বহারা-য় এসেই তিনি সাম্যবাদের কথা প্রচার করেছেন। যেখানে সর্বহারা শ্রেণী এ কবিকে বিপ্লব ধর্মের দীক্ষা দেয়, সাম্যের গান গাইতে তাঁকে প্রেরণা যোগায়। যেখানে ঐতিহাসিক চেতনা নেই, নেই শ্রেণী সংগ্রামের তাগিদ, আছে শুধু মানবিক প্রীতি। আর এখানেই একবির মৌলিকতার মূল কৃতিত্ব। আর সেই কৃতিত্বে কবিকে দেখি-
১) নজরুলের কবিসত্তা ছিল যুগসচেতন। সেজন্য তিনি বিদ্রোহী। এই বিদ্রোহ অন্যায়, অসাম্য ও ভন্ডামির বিরুদ্ধে।
২) নজরুলের বিদ্রোহী চেতনার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন পরবর্তী কল্লোল গোষ্ঠীর লেখকরা। লেখকগণ নজরুলের চিন্তার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন।
৩) নজরুলের কবিসত্তার মূলে ছিল মানবপ্রীতি ও স্বদেশপ্রেম। মানুষকে ও দেশকে তিনি ভালোবেসেছিলেন বলেই সেই ভালোবাসার উৎস থেকে রচিত হয়েছে তাঁর কবিতা।
পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, কেবলমাত্র বিদ্রোহী নয়, মানব প্রীতি নয়, সেই সাথে বেশ কিছু শিশু বিষয়ক কাব্য,কবিতা,নাটক তিনি রচনা করেছেন। আসলে তিনি রবীন্দ্রোত্তর আধুনিক কাব্য ধারায় পথপ্রদর্শক। আসলে নজরুলের কিন্তু অবিসংবাদিত এবং বাংলা সাহিত্যের সুদর্শিক ও ভাবুক এর কাছে নজরুল আজও নিত্য প্রেরণা।
ঠিক এরূপ অসংখ্য বিষয়ভিত্তিক আলোচনা সাজেশন এবং ভিডিও পেতে ভিজিট করুন আমাদের SHESHER KOBITA SUNDORBON YOUTUBE CHANNEL
Comments
Post a Comment