সংস্কৃত নাট্য সাহিত্যে নাট্যকার ভবভূতির কৃতিত্ব আলোচনা করো(পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্র বিশ্ববিদ্যালয়, ষষ্ঠ সেমিস্টার, বাংলা অনার্স)
আলোচনা শুরুতেই আমরা বলে রাখি যে,সংস্কৃত নাট্য সাহিত্যের ভবভূতির স্থান মহানাট্যকার কালিদাসের পরেই। তবে এই নাট্যকার তাঁর আবির্ভাবকাল সম্পর্কে স্পষ্ট নিদর্শন কোথাও রাখেননি। তাই অনুমান করা হয়ে থাকে যে, তাঁর জীবনকাল হলো সপ্তম শতাব্দীর শেষের দিকে কিংবা অষ্টম শতাব্দীর গোড়ার দিকে। তবে তিনি বেদজ্ঞ পন্ডিত ছিলেন। আর এই পণ্ডিত হওয়ার কারণে সাংখ্য ও যোগদর্শনে তাঁর পান্ডিত্যের পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু তিনি কোন রাজার আনুকূল্য লাভ করেছিলেন কিনা সে সম্পর্কে কোন তথ্য বিশেষভাবে পাওয়া যায় না। তবে সমকালীন পাঠকের অবজ্ঞা প্রদর্শন করে তিনি বলেছিলেন-
"নিরবধিকাল আর বসুধা বিপুল। জন্মিলে জন্মিতে পারে মম সমতুল।।"
অর্থাৎ অনাগত ভাবিকালের ওপর তাঁর কাব্যের বিচারের ভার দিয়ে তিনি নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন। তাই শ্রীকন্ঠ ভবভূতি সংস্কৃত নাট্য সাহিত্যের আঙিনায় কালিদাসের পরেই একটি স্মরণীয় নাম। আর সেখানে তাঁর আত্মপরিচয় থেকে জানা যায় তিনি বিদর্ভ দেশে পদ্মপুকুর নামক নগরে ব্রাহ্মণ বংশে জন্ম গ্রহণ করেন এবং উজ্জ্বয়িনী নগরের সাথে তিনি বেশ পরিচিত ছিলেন। আবার কলহনের 'রাজতরঙ্গিনী' তে ভবভূতিকে কান্যকুব্জের রাজা যশোবর্মনের সভাকবি বলে চিত্রিত করা হয়েছে।
আমরা ভবভূতির রচিত তিনটি নাটক গ্রন্থের কথা জানতে পারি। আর সেই তিনটি নাট্যগ্রন্থ হলো- মহাবীর চরিত, মালতি মাধব, উত্তররামচরিত। তবে এখানে আরোও অনুমান করা হয় যে এই তিনটি নাট্যগ্রন্থ ছাড়াও তিনি অন্যান্য বেশকিছু গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। কারণ অন্যান্য কোষগ্রন্থ বা শ্লোকে ভবভূতি নামাঙ্কিত পাওয়া যায়। যেখানে-
••' মালতীমাধব' নাট্যরচনায় ভবভূতির কৃতিত্বঃ
নাট্যকার ভবভূতি রচিত প্রথম নাটক হল 'মালতিমাধব'।নাটকটির বিষয়বস্তু লোককাহিনী নিয়ে রচিত কিন্তু এখানে প্রেম মিলনের কাহিনী অত্যন্ত গতানুগতিক ধারায় রচিত। আর সেখানে আমরা দেখি বৌদ্ধ পরিব্রাজিকা কামন্দকীর নীতিকৌশলে মন্ত্রী ভূরিবসুর কন্যা মালতির সাথে অমাত্য দেবারতের পুত্র মাধবের মিলন, মালতীমাধব নাটকের প্রধান ঘটনা। নাটকটি ঘটনাবহুল, যেখানে নায়ক নায়িকার হৃদয়গত প্রণয় চেষ্টার বর্ণনা প্রধান স্থান অধিকার করেছে। তবে নাট্যকার যে অদ্ভুত বীভৎস ও রৌদ্র রসের অবতারণা করেছেন তা অভিনব। তবে-
মালতী মাধব নাটকে নাট্যকার ভবভূতি বামাচারী তন্ত্রসাধনার বিষয়ে মূল্যবান তথ্য বিশেষ বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপিত করতে পেরেছেন। পাশাপাশি বৌদ্ধ সাধক ও সাধকদের জনকল্যাণমূলক কার্যপ্রণালীরও পরিচয়দানে সক্ষম হয়েছেন। যেখানে পরিব্রাজিকা কামন্দকী সংসার ত্যাগ করলেও লোককল্যাণের বিশেষ করে নায়ক-নায়িকার মিলনের প্রয়োজনে সাংসারিক কাজে লিপ্ত হতে দ্বিধা করেননি। তিনি তাঁর দুই সহযোগী অবলোকিতা ও সৌদামিনীর সাহায্যে অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। আর এই ব্যাপারে কাপালিকদের মতো মহাযানী বৌদ্ধরাও যে মন্ত্রবলে ও যোগবলের অধিকারিণী ছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় সৌদামিনীর কার্যকলাপে। আর এখানেই এই নাটকে নাট্যকার অবভূতির নাট্য কৃতিত্বের পরিচয় মেলে।
••উত্তররামচরিত নাট্যরচনায় ভবভূতির কৃতিত্বঃ
নাট্যকার ভবভূতির অন্যতম আরেকটি নাটক হল 'উত্তররামচরিত'। যে নাটকটিতে সীতার বিসর্জনের পর থেকে লবকুশের জন্ম, পিতার সঙ্গে মিলন ও সীতা এবং রামের পুনর্মিলন দেখানো হয়েছে। আসলে এই নাটকটি রামায়ণের উত্তরকান্ড অবলম্বনে রচিত। তাই নাটকটির মূল ঘটনা রামায়ণ থেকে গৃহীত হয়েছে। তবে এখানে অনেক বিষয় নাট্যকারের কল্পিত বিষয় আছে। আর সেখানে আমরা দেখি-
মূল রামায়ণে যেখানে রাম সীতার বিচ্ছেদ ঘটেছে এই নাট্যকার সেখানে তাঁদের পুনর্মিলন বর্ণনা করেছেন। কারণ ভারতীয় নাটকে মৃত্যুর প্রয়োগ নিষিদ্ধ। তাই নাট্যকার এই নাটকের সীতার পাতাল প্রবেশ না দেখিয়ে রামের সঙ্গে তাঁর মিলনেই নাটকের পরিসমাপ্তি ঘোষনা করেছেন।
পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, সংস্কৃত নাট্য সাহিত্যে মহানাট্যকার কালিদাসের পরই নাট্যকার ভবভূতির স্থান। এই নাট্যকারের প্রতিটি নাটকে বিশেষ করে চরিত্র চিত্রনে বিশেষ পারদর্শিতা প্রদর্শন করেছেন। রাম সীতা, লব কুশ চরিত্রগুলি তাঁর হাতে মহা উজ্জ্বল চরিত্র হয়ে উঠেছে। পাশাপাশি তাঁর নাটকে বিভিন্ন নাট্যরসের উদ্ভাবনে তাঁর ক্ষমতা অপরিসীম এবং অপরিমেয়। এছাড়াও নাটকের মধ্যে নাটক প্রদর্শন এ নাট্যকারের একটি অভিনব কৃতিত্বের নিদর্শন। তাই বিদ্যাসাগর বলেন- "ভবভূতির রচনা হৃদয়গ্রাহিণী ও অতি চমৎকারিণী।সংস্কৃত ভাষায় যত নাটক আছে ভবভূতি প্রণীত নাটক ত্রয়ের রচনা সেসকল অপেক্ষা সমাধিক প্রগাঢ়।"
Comments
Post a Comment