ডাকঘর নাটকটির নামকরণের স্বার্থকতা আলোচনা করো।
আমরা জানি যে,সাহিত্য সৃষ্টির প্রধান আকর্ষণ হল নামকরণ। আর এই নামকরণ বিষয়কেন্দ্রিক, চরিত্র কেন্দ্রিক বা সাংকেতিক বা ভাবব্যঞ্জনা অর্থে করা হয়। আমাদের আলোচ্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ডাকঘর নাটকটি বিষয় কেন্দ্রিক বা চরিত্র কেন্দ্রিক ঘটনাকে বর্জন করেছেন। যার ফলে এই ডাকঘর নাটকটি রূপক সাংকেতিক নাটক হয়ে উঠেছে। যেখানে -
আলোচ্য নাটকটির মূল বক্তব্য-জীবাত্মার প্রতীক অমলের চারিদিকে সামাজিক বাধা-নিষেধের গণ্ডি অতিক্রম করে বিশ্বজীবনে মুক্তি লাভ করা। আর সেখানে আত্মা মুক্তি লাভ করে আলোর দেশে যাওয়ার জন্য আকুল আগ্রহে প্রতীক্ষারত। শুধু তাই নয়, আত্মা এখানে বিশ্বরাজের সাথে মিলিত হবার আকাঙ্ক্ষায় অপেক্ষায় থাকে। আবার বিশ্বরাজ অনাদিকালব্যাপী মানবতার সাথে মিলিত অবার জন্য অজানা পথ ধরে আসছেন। আর সেখানে-
অমল এক জটিল ব্যাধিতে শয্যাগত। সে নিজেকে ঘরের বন্ধন ছিন্ন করে বাইরের অসীমতায় বিস্তার করতে চায়। কিন্তু কবিরাজের নিষেধে তাকে বাইরে যেতে দেওয়া যাবে না। এই সময়ে অমল হঠাৎ দেখে রাজার ডাকঘর। বছরের সারাটা ঋতুতে ডাকহরকরা চিঠি বিলি করছে। অমল ভাবে রাজাও একদিন তাকে চিঠি দেবেন। এই ভাবনা নিয়ে সে রোগশয্যায় শুয়ে রোগযন্ত্রণা ভোগ করতে থাকে। কিন্তু একটা সময় তার রোগ যন্ত্রণা প্রবল আকার ধারণ করলে রাজকবিরাজ জানায়-
“অর্ধরাত্রে যখন রাজা আসবেন তখন তুমি বিছানা ছেড়ে উঠে তাঁর সঙ্গে বেরোতে পারবে।”
এই বিশ্বে রাজার ডাকঘর স্থাপন হল বিধাতার ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ। আর সেই ডাকঘর অসীম ঈশ্বরের প্রতীক রূপে অমলকে ডাকঘরের দিকে তাকিয়ে কিম্বা রাজার চিঠি পাওয়ার প্রতীক্ষাকে নাট্যকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সীমা ও অসীমের নির্দ্বন্দ্ব সাধনাকে প্রতীক অর্থে অমলের মাধ্যমে ব্যক্ত করতে ডাকঘরকে রূপক অর্থে অঙ্কন করেছেন। আর এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি, ডাকঘর নাটকটি রূপক সাংকেতিক অর্থে নামকরণ সার্থক হয়েছে।
১) "এরা আমার ঘর অন্ধকার করে দিচ্ছে কেন? তারার আলোতে আমার কি হবে?"+সংলাপটির অন্তর্নিহিত অর্থ ব্যক্ত করো।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ডাকঘর নাটকে অন্তিমে মাধব দত্তের এই উক্তিতে বোঝা যায় যে, রাজ কবিরাজ এসে বালক অমলের গৃহবন্দী দশা মোচনের জন্য সমস্ত দরজা-জানলা খুলে দেওয়ার পর রাজ কবিরাজের সেবায় মহারাজ আগমনের সূচনায় অমল গভীর মুখে ঢলে পড়ে। তখন মাধব দত্ত এই উক্তির মধ্যে দিয়ে, শূন্য হৃদয়ের ব্যাকুলতাকে প্রকাশ করেছে।
২) “সুধা তোমাকে ভোলেনি”-সুধা কে? তোমাকে বলতে কার কথা বলা হয়েছে?
উত্তরঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ডাকঘর নাটকে সুধা হল জনৈকা মালিনীর মেয়ে এবং সে মৃত্যু পথযাত্রী অমলের জন্য ফুল এনেছিল।
এখানে তোমাকে বলতে আলোচ্য নাটকের নায়ক চরিত্র অমলের কথা বলা হয়েছে।
৩) প্রশ্নঃ ডাকঘর নাটকে অমলের চরিত্রটি বিশ্লেষণ করো।
ডাকঘর নাটকের কেন্দ্রীয় প্রধান চরিত্র হলো অমল। আর এই নাটকের সূচনাতে আমরা দেখি-তার অসুস্থতার চরম অবস্থা লক্ষ্য করে কবিরাজ তাকে ঘরের বাইরে বেরোনো নিষিদ্ধ করেছেন। তবে এই বিধিনিষেদের সীমারেখা তাকে আরো অসুস্থ করে তুলেছে। তাই সে বাধ্য হয়ে জানালার ধারে বসে বাইরে জগতের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে। অর্থাৎ এখানে দেখা যায় যে, প্রকৃতির সাথে মিলতে, একাত্ম হতে তার মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। আর সেখানেই-
আলোচ্যর নাটকেই আমলের আসন্ন মৃত্যুক্ষণটির মুহূর্ত তুলে ধরা হয়েছে। আর ঠিক এরূপ পরিবেশের মধ্যে রাজ কবিরাজ মহাশয় বলে-”হাসিটা তো ভালো ঠেকছে না।” রাজ কবিরাজের এই কথা শুনে আসন্ন সুদূরের পিয়াসী অমল বলতে থাকে-
“আমি যেন অনেক দূরের কথাও শুনতে পাচ্ছি।”
অর্থাৎ অমল এ সমাজের সকল রীতি-নীতি, সংস্কার, বন্ধন ছিন্ন করে অসীমের বুকে ফিরে যেতে ব্যাকুল হয়ে ওঠে। আবার-
অমলের বাড়ির সামনে রাজা ডাকঘর স্থাপন করেছেন। এখানে অমল রাজার চিঠির প্রতীক্ষায়রত ছিল। ইতিমধ্যে মোড়ল একটা সাদা কাগজ তার সামনে এনে জানায় রাজা চিঠি দিয়েছে। আসলে সেই কাগজটি ছিল অক্ষরবিহীন সাদা কাগজ। তবে এখানে আমলের মনে সীমা থেকে অসীমে কথা প্রকাশিত হয়েছে-
“ঐ যে ফকির, তাঁর বাজনা বাজছে।”
আসলে এই পার্থিব জগতের কোন বস্তুর প্রতি অমলের কোন মোহ ছিল না। তাই মাধব দত্ত রাজার নিকট ধন-সম্পত্তির প্রাপ্তির কথা বললে অমল জানায়-
“তিনি যেন আমাকে ডাক হরকরা করে দেন-আমি দেশে ঘরে ঘরে তাঁর চিঠি বিলি করব।”
এই চিঠি বিলির করার মধ্য দিয়ে মানব জীবনের সীমা অসীমের নির্দ্বন্ধ সাধনাকে প্রকাশ করা হয়েছে। অবশেষে অমলের মৃত্যু হয়। অমল ঘুমিয়ে পড়ে মৃত্যুর দেশে। যেখানে তার ঘুম মৃত্যুর প্রতীক। আর অমল সেই মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মানবাত্মার সাথে পরমাত্মার মিলন সাধন করেছে।
Comments
Post a Comment