Skip to main content

বাংলা সাহিত্যের (1st . Sem.)আদিপর্বে বৌদ্ধধর্ম ও সংস্কৃতি চর্চা কিভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল তার পরিচয় দাও।

বাংলা সাহিত্যের আদিপর্বে বৌদ্ধধর্ম ও সংস্কৃতিচর্চা কিভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল তার পরিচয় দাও (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা মাইনর, প্রথম সেমিস্টার)।

          আলোচনা শুরুতেই আমরা বলে রাখি যে, বাংলা সাহিত্যের আদি পর্বে বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতি চর্চার গভীর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। এই প্রভাব সাহিত্য এবং সমাজের বিভিন্ন দিককে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল।প্রভাবিত সেই বিষয়গুলির নিম্ন সূত্রাকারে আলোচনা করা হলো-

ক) চর্যাপদঃ বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন হলো চর্যাপদ। এই পদগুলো মূলত বৌদ্ধ সহজিয়া সাধকদের ধর্মীয় গান। চর্যাপদের ভাষা, ভাব, এবং দার্শনিক চিন্তাভাবনা বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতির দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত।

           •সহজিয়া বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিফলন• 

চর্যাপদে সহজিয়া বৌদ্ধধর্মের দর্শন ও সাধন পদ্ধতির স্পষ্ট চিত্র দেখা যায়। কায়া-সাধন, শূন্যবাদ, এবং সহজ পথের অনুসারীদের জীবনযাত্রা ও আধ্যাত্মিক উপলব্ধি এই পদগুলোতে বর্ণিত হয়েছে।

             •প্রতীক ও রূপকের ব্যবহার• 

 চর্যাপদের ভাষা আলো-আঁধারির ভাষা বা সন্ধ্যাভাষা নামে পরিচিত। এই ভাষায় বৌদ্ধ ধর্মের গূঢ় তত্ত্ব ও আচার-অনুষ্ঠান বিভিন্ন প্রতীক ও রূপকের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে। ডোম্বী, শবরী, নাঙ্গা, কাপালী প্রভৃতি সমাজের প্রান্তিক মানুষের জীবনযাত্রা এবং তাদের প্রতীকী ব্যবহার বৌদ্ধ দর্শনের গভীর তত্ত্বকে ব্যঞ্জনা দিয়েছে।

                •ভাষা ও ছন্দের ব্যবহার•

 চর্যাপদের ভাষা বাংলা ভাষার আদি রূপ। এই সময়ে বৌদ্ধ পণ্ডিত ও সাধকদের মধ্যে স্থানীয় ভাষার ব্যবহার সাহিত্য চর্চার একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। চর্যাপদে ব্যবহৃত ছন্দও পরবর্তী বাংলা কবিতার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

খ) পাল যুগঃ পাল রাজারা ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। তাদের শাসনকালে বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতির ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়। এর প্রভাব সমকালীন সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে স্পষ্ট দেখা যায়।

              •শিক্ষা ও জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে

শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চা: পাল যুগে নালন্দা, বিক্রমশীলা, জগদ্দল্ল মহাবিহারের মতো বিখ্যাত বৌদ্ধ শিক্ষা কেন্দ্রগুলো জ্ঞানচর্চার প্রধান পীঠস্থান ছিল। এখানে শুধু বৌদ্ধ ধর্ম নয়, ব্যাকরণ, দর্শন, ন্যায়শাস্ত্র, চিকিৎসাবিদ্যা প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে চর্চা হতো। এই জ্ঞানচর্চার প্রভাব পরবর্তীকালের বাংলা সাহিত্য ও চিন্তাভাবনার উপর পড়েছিল।

                     •শিল্প ও স্থাপত্যের ক্ষেত্রে

শিল্প ও স্থাপত্যঃ পাল যুগে বৌদ্ধ শিল্প ও স্থাপত্যের উল্লেখযোগ্য বিকাশ ঘটেছিল। পাহাড়পুর, ময়নামতী, সোমপুর বিহারের মতো স্থাপত্যকীর্তি বৌদ্ধ সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। ভাস্কর্য ও চিত্রকর্মেও বৌদ্ধ দেবদেবী ও জাতকের কাহিনি বিশেষভাবে স্থান পায়। এই শিল্পকলার প্রভাব সমকালীন সাহিত্যকেও নানাভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল।

গ) লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতিঃ  ধর্মের নীতি ও কাহিনি লোকসাহিত্যের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল।

                        •নাথ সাহিত্য

নাথ সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে রয়েছে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব। মীননাথ, গোরক্ষনাথ প্রমুখ নাথপন্থীরা বৌদ্ধ তন্ত্র ও যোগাচারের সঙ্গে স্থানীয় লোকবিশ্বাসের মিশ্রণে এক নতুন ধর্মমতের সৃষ্টি করেছিলেন। নাথ সাহিত্যের কাহিনি ও চরিত্রগুলোতে বৌদ্ধ দর্শনের কিছু প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

                     •প্রবাদ ও লোককথা• 

প্রবাদ হলো কথাঃ বৌদ্ধ জাতকের কাহিনি এবং বৌদ্ধ ধর্মের নীতিবোধ অনেক প্রবাদ ও লোককথার জন্ম দিয়েছিল যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে লোকমুখে প্রচলিত হয়ে আসছে।

ঘ)ভাষার বিবর্তনঃ বাংলা ভাষার উৎপত্তি ও বিকাশে বৌদ্ধ পণ্ডিত ও সাধকদের অবদান অনস্বীকার্য। চর্যাপদের মাধ্যমে বাংলা ভাষার প্রাচীন রূপের পরিচয় পাওয়া যায়। বৌদ্ধ সহজিয়াদের মধ্যে স্থানীয় ভাষায় ধর্ম প্রচারের আগ্রহ ভাষার বিকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

             পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, বাংলা সাহিত্যের আদি পর্বে বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতি চর্চা সাহিত্যিক সৃষ্টি, ভাষার বিকাশ, শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চা, শিল্পকলা এবং লোকসংস্কৃতির মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে গভীর ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করেছিল। চর্যাপদ এই প্রভাবের সবচেয়ে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।


Comments

Popular posts from this blog

দর্শন প্রথম সেমিস্টার সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তর।

দর্শন প্রথম সেমিস্টার সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, মাইনর সিলেবাস)  ১)চার্বাক মতে ভূত কয়টি ও কি কি? উত্তরঃচার্বাক মতে ভূত চারটি- ক্ষিতি, অপ্ , তেজ ও মরুৎ ২) স্বভাববাদ কী? উত্তরঃ চার্বাক জড়বাদের ভিত্তি হল স্বভাববাদ। যে মতবাদ অনুসারে স্বভাব থেকেই ভূত সৃষ্টি, আবার স্বভাব থেকেই বিচ্ছেদ। যার জন্য ঈশ্বরকে স্বীকার করা প্রয়োজন নেই। ৩) অব্যাপ্যদেশ কথাটির অর্থ লেখো। উত্তরঃ অব্যাপ্যদেশ বলতে বোঝায়- অশাব্দ অর্থাৎ যাকে শব্দের দ্বারা প্রকাশ করা যায় না। ৫) জ্ঞান লক্ষণ প্রত্যক্ষ কাকে বলে?  কোন একটি ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে তার নিজের বিষয়ীভূত গুণ ছাড়াও যদি অপর একটি ইন্দ্রিয়ের বিষয়ীভূত গুণকে প্রত্যক্ষ করার হয়, তাহলে সেই প্রত্যক্ষকে জ্ঞানলক্ষণ প্রত্যক্ষ বলা হয়। ৬) ন্যায় মতে প্রমাণের প্রকার  উত্তরঃ ন্যায় মতে প্রমাণ চার প্রকার। প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান এবং শাব্দ। ৭) সন্নিকর্ষ কাকে বলে? উত্তরঃ ন্যায় মতে ইন্দ্রিয় ও কোন বাস্তব পদার্থের মধ্যে একপ্রকার বিশেষ সম্পর্ক ঘটলে তবেই আমাদের একটি বস্তুর প্রত্যক্ষজ্ঞান ।আর ঐ বিশেষ বিশেষ সম্পর্কের পারিভাষিক নাম হলো সন...

ব্রিটিশ(3rd.Sem) পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব

ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব(পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় তৃতীয় সেমিস্টার রাষ্ট্রবিজ্ঞান মাইনর সিলেবাস)। ব্রিটেনের সংবিধান অলিখিত বলে বিভিন্ন ঐতিহাসিক দলিল, শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতি, পার্লামেন্ট প্রণীত আইন প্রভৃতির মাধ্যমে পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব অর্জিত হয়েছে। ব্রিটেনের পার্লামেন্ট আইনানুগ সার্বভৌমত্ব অর্জন করেছে, রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব নয়। আর সেখানে আইনানুগ সার্বভৌমত্ব বলা হয়, কারণ-       যেকোনো বিষয়ে পার্লামেন্ট আইন প্রণনয়নের অধিকারী। এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র হওয়ায় পার্লামেন্টে কোন আইন প্রণয়নের সময় প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় না। কমন্সসভা তথা নিম্নকক্ষের সার্বভৌমত্বকেই বলা হয় পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব।     ••ব্রিটিশ পার্লামেন্টকে সার্বভৌমত্ব বলার কারণ- ১) পার্লামেন্টের ওপর আইনগত কোনরূপ বাধানিষেধ আরোপ করা যায় না। ২) পার্লামেন্ট প্রণীত আইনের বৈধতার ব্যাপারে আদালত কোন প্রশ্ন তুলতে পারেনা। ব্রিটেনের আদালত পার্লামেন্ট প্রণীত আইনের ওপর বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার দ্বারা সীমিত করতে পারে না। ৩) ব্রিটিশ পার্লামেন্টের আইন প্রণয়ন ক্ষমতার উপর শাসনবিভাগ অনুরূপ ন...

ইতিহাস (3rd Semester) সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর।

 তৃতীয় সেমিস্টার ইতিহাস মাইনর সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, তৃতীয় সেমিস্টার ইতিহাস মাইনর)। ১)বন্দেগান-ই-চাহালগানি বলতে কী বোঝায়? •উত্তরঃবন্দেগান-ই-চাহালগান বলতে চল্লিশ জন তুর্কি ও অ-তুর্কি দাসদের সমন্বয়ে গঠিত একটি বাহিনীকে বোঝায়। এই বাহিনীকে ডাল চালিশা বা তুরকান-ই- চাহালগানি নামে ডাকা হতো। ২)আমির খসরু কে ছিলেন? •উত্তরঃ আমির খসরু ছিলেন প্রখ্যাত সুফি সাধক বা আরেফ নিজামউদ্দিন আওলিয়ার ছাত্র এবং অন্যতম প্রধান খলিফা। যাঁকে 'ভারতের তোতা' উপাধি দেওয়া হয়েছিল। ৩) মহরানা প্রতাপ কে ছিলেন?  •উত্তরঃ মেবারের শিশোদিয়া রাজবংশের একজন হিন্দু রাজপুত রাজা ছিলেন মহারানা প্রতাপ সিং। যিনি রাজপুতদের বীরত্ব ও দৃঢ় সংকল্পের প্রতীক। বহু বছর ধরে তিনি মুঘল সম্রাট আকবরের সঙ্গে লড়াই করেন। ৪) জায়গীরদারী সংকট কী? •উত্তরঃ জায়গিরদারী সংকট ছিল মোগল সাম্রাজ্যের একটি অর্থনৈতিক সংকট। এই সংকটে জমি বা জায়গিরের অভাব দেখা দিয়েছিল। যার ফলে প্রশাসনিক খরচ মেটানো এবং যুদ্ধের খরচ বহন করা সম্ভব হতো না। ৫) দাক্ষিণাত্য ক্ষত কী? •উত্তরঃ দাক্ষিণাত্য ক্ষত বলতে ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীত...