বাংলা সাহিত্যের ধারায় কবি গানের ভূমিকা আলোচনা করো (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম সেমিস্টার বাংলা মাইনর)।
আলোচনার শুরুতেই আমরা বলে রাখি যে,বাংলা সাহিত্যের ধারায় কবিগানের ভূমিকা আলোচনা করতে গেলে আমাদের এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, বিষয়বস্তু, আঙ্গিক এবং প্রভাব ইত্যাদি বিভিন্ন দিক আলোচনা ও বিবেচনা করা প্রয়োজন। আর সেই প্রয়োজনে আমরা নিম্ন সুত্রাকারে আলোচনা করলাম-
•ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও উদ্ভব•
•কবিগান বাংলা লোকসাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা। এর উদ্ভব ঠিক কবে হয়েছিল তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ থাকলেও, অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে এর বিকাশ স্পষ্ট হতে দেখা যায়। বিশেষত ১৭৬০ থেকে ১৮৩০ সালের মধ্যবর্তী সময়কালকে কবিগানের স্বর্ণযুগ হিসেবে ধরা হয়। এই সময়ে রাঢ় অঞ্চল এবং কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় এই গানের জনপ্রিয়তা ব্যাপক আকার ধারণ করে।
•বিষয়বস্তু ও আঙ্গিক•
•কবিগানের মূল বৈশিষ্ট্য হলো দুই বা ততোধিক কবির মধ্যে প্রশ্নোত্তর বা প্রতিযোগিতামূলক গানের লড়াই। এই লড়াইয়ে তাৎক্ষণিক বুদ্ধি, বাগ্মিতা এবং সঙ্গীতজ্ঞানের পরিচয় দিতে হয়। কবিগানের বিষয়বস্তু ছিল বিচিত্র - ধর্মীয় আখ্যান, পৌরাণিক কাহিনী, সামাজিক রীতিনীতি, সমসাময়িক ঘটনা এবং মানবজীবনের নানা দিক।
কবিগানের আঙ্গিক মূলত সঙ্গীতনির্ভর। এতে বিভিন্ন রাগ-রাগিণী ও সুরের ব্যবহার দেখা যায়। সাধারণত একজন সরকার বা দলপতি থাকেন যিনি গানের সূচনা করেন এবং দোহাররা ধুয়া ধরে। পদ বা চরণগুলি সাধারণত আটটি ভাগে বিভক্ত থাকে: ডাক, মালসী, সখীসংবাদ, কবি, টপ্পা, ধুয়া, প্যার ও পাঁচালি।
•বাংলা সাহিত্যে কবি গানের ভূমিকা•
•লোকসাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশঃ কবিগান বাংলা লোকসাহিত্যের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি গ্রামীণ জনপদের মানুষের বিনোদন ও শিক্ষাদানের একটি শক্তিশালী মাধ্যম ছিল।
• সাহিত্য ও সঙ্গীতের সমন্বয়ঃকবিগান সাহিত্য এবং সঙ্গীতের এক অপূর্ব সমন্বয় ঘটায়। এর মাধ্যমে গান যেমন জনপ্রিয়তা লাভ করে, তেমনি সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয় সাধারণ মানুষের কাছে সহজবোধ্য হয়ে ওঠে।
•তৎকালীন সমাজের প্রতিচ্ছবিঃ কবিগানে তৎকালীন সমাজের নানা দিক প্রতিফলিত হতো। সামাজিক রীতিনীতি, কুসংস্কার, ধর্মীয় বিশ্বাস, মানুষের আনন্দ-বেদনা ইত্যাদি বিষয় গানের মাধ্যমে জীবন্ত হয়ে উঠত।
• ভাষা ও ছন্দের পরীক্ষা-নিরীক্ষাঃ কবিগান লোকমুখে প্রচলিত ভাষার ব্যবহার এবং বিভিন্ন ধরনের ছন্দের পরীক্ষা-নিরীক্ষার একটি ক্ষেত্র ছিল। এর মাধ্যমে বাংলা ভাষার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও লৌকিক উপাদান সাহিত্যে প্রবেশ করে।
• জনপ্রিয় সাহিত্যঃ অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে কবিগান সাধারণ মানুষের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। বিভিন্ন মেলা-পার্বণে কবিগানের আসর বসত এবং বিপুল সংখ্যক মানুষ তা উপভোগ করত।
•সাহিত্যিকদের অনুপ্রেরণাঃ পরবর্তীকালে অনেক সাহিত্যিক কবিগানের আঙ্গিক ও বিষয়বস্তু থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করেছেন। লোকসাহিত্যের এই ধারা বাংলা সাহিত্যের মূল স্রোতধারায় একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে।
•পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে,কবিগান বাংলা সাহিত্যের ধারায় একটি শক্তিশালী এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এটি একদিকে যেমন সাধারণ মানুষের বিনোদনের মাধ্যম ছিল, তেমনি অন্যদিকে তৎকালীন সমাজ ও সংস্কৃতির একটি মূল্যবান দলিল হিসেবেও বিবেচিত হয়। লোকসাহিত্যের এই বিশেষ ধারাটি বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে এবং পরবর্তী প্রজন্মের সাহিত্যিকদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করেছে।
Comments
Post a Comment