বাংলা কবিগানের ইতিহাসে ভোলা ময়রার কৃতিত্ব আলোচনা করো (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, প্রথম সেমিস্টার, বাংলা মাইনর)
আলোচনার শুরুতেই আমরা বলে রাখি যে,বাংলা কবিগানের ইতিহাসে ভোলা ময়রা এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছেন। যেখানে তিনি ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে একজন অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং প্রভাবশালী কবিয়াল হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তাই বলা যেতে পারে তাঁর কৃতিত্ব বহুমুখী এবং বাংলা কবিগানকে এক নতুন দিশা তিনিই দিয়েছিলেন। আর সেই কবি কৃতিত্বে আমরা দেখি-
১) তাৎক্ষণিক বুদ্ধিমত্তায়ঃ
ভোলা ময়রার সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব ছিল আসরে বসেই তাৎক্ষণিকভাবে কবিতা রচনা করার অসাধারণ ক্ষমতা। তাঁর মুখ থেকে অনর্গল যেসকল কথা বেরিয়ে আসত তা শ্রোতাদের মুগ্ধ করত। আর এক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের যুক্তি খণ্ডন এবং নতুন আক্রমণ শানানোর ক্ষেত্রে তাঁর উপস্থিত বুদ্ধি ছিল অত্যন্ত প্রখর।
২) বাগ্মিতা ও ভাষা প্রয়োগেঃ
ভোলা ময়রার বাচনভঙ্গি ছিল অত্যন্ত আকর্ষণীয়, সুমধুর,যা শ্রোতাদের মনে ধরে রাখার মতো। তিনি লঘু ও গুরু উভয় প্রকার বিষয়বস্তুকে সুন্দরভাবে, সরলভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন। এক্ষেত্রে তাঁর ভাষার ব্যবহার ছিল চটুল, সরস এবং অনেক সময় শ্লেষপূর্ণ, যা আসরের আমোদ বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে থাকে।
৩) হরু ঠাকুরের শিষ্যত্ব গ্ৰহণেঃ
কবিয়াল ভোলা ময়রা বিখ্যাত কবিয়াল হরু ঠাকুরের শিষ্য ছিলেন। হরু ঠাকুর নিজেও ভোলা ময়রার জন্য গান বেঁধে দিতেন। গুরুর কাছে শিক্ষালাভ করে এবং তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে ভোলা ময়রা কবিগানের আঙ্গিক ও পরিবেশনাকে সমৃদ্ধ করেছিলেন।
৪) প্রতিপক্ষের মোকাবিলা করার কৌশলঃ
ভোলা ময়রার সময়ে অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি, রাম বসু, যজ্ঞেশ্বরী দাসীর মতো শক্তিশালী কবিয়ালরা বিদ্যমান ছিলেন। ভোলা ময়রা এঁদের সঙ্গে বহু স্মরণীয় কবিগানের লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করেছেন এবং নিজের দক্ষতা প্রমাণ করেছেন। অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির সাথে তাঁর কবির লড়াই আজও কিংবদন্তী হয়ে আছে।
৫) লোকমনোরঞ্জনের দক্ষতাঃ
ভোলা ময়রার কবিগানের আসর সর্বস্তরের মানুষের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। তাঁর গানগুলিতে সমাজের বিভিন্ন দিক, মানুষের দৈনন্দিন জীবন এবং সমসাময়িক ঘটনাবলী প্রতিফলিত হতো, যা সাধারণ শ্রোতাদের সাথে সহজে সংযোগ স্থাপন করত। তাঁর সরস উপস্থাপনা এবং আকর্ষণীয় বাচনভঙ্গি আসরকে প্রাণবন্ত করে রাখত।
৬) নবীনচন্দ্র দাসের সাথে মেলবন্ধনঃ
বাংলায় রসগোল্লার উদ্ভাবক নবীনচন্দ্র দাস ছিলেন ভোলা ময়রার জামাতা। এই পারিবারিক সম্পর্ক তৎকালীন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে ভোলা ময়রার পরিচিতি ও প্রভাব বিস্তারে সহায়ক বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল মনে করা হয়।
৭) বিদ্যাসাগরের দৃষ্টিতেঃ
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো ব্যক্তিত্ব ভোলা ময়রার কবিপ্রতিভার স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে বাংলা সমাজের সজীবতার জন্য রামগোপাল ঘোষের ন্যায় বক্তা, হুতোম প্যাঁচার ন্যায় রসিক এবং ভোলা ময়রার ন্যায় কবিওয়ালার প্রাদুর্ভাব নিতান্ত আবশ্যক। এই উক্তি ভোলা ময়রার গুরুত্ব এবং সমাজের উপর তাঁর প্রভাব স্পষ্ট করে তোলে।
পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, ভোলা ময়রা ছিলেন বাংলা কবিগানের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর তাৎক্ষণিক কবিতা রচনা, বাগ্মিতা, শক্তিশালী প্রতিপক্ষদের মোকাবিলা করার ক্ষমতা এবং লোকমনোরঞ্জন গুণ তাঁকে সেই সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিয়াল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। কবিগানের ইতিহাসে তাঁর অবদান আজও সকলেই অতি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে থাকেন।
Comments
Post a Comment