পাঁচালী কাকে বলে? চারজন পাঁচালী কারের নাম লেখো। শ্রেষ্ঠ পাঁচালীকারের পরিচয় দাও (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম সেমিস্টার বাংলা মাইনর )।
পাঁচালী কীঃ পাঁচালি হল বাংলা লোকসাহিত্যের একটি প্রাচীন ধারা।যেটি গান ও গল্পের মিশ্রণে গঠিত একটি আখ্যানমূলক পরিবেশনা।আসলে পাঁচালী গান বাংলার প্রাচীন লোকিক সংগীত গুলোর মধ্যে অন্যতম। তবে এই গান প্রধানত সনাতন ধর্মীদের বিভিন্ন আখ্যান বিষয়ক বিষয়বস্তু সংবলিত ও তাদের তুষ্টির জন্য পরিবেশিত হয়।তবে মনে করা হয় যে,'পাঁচালী'শব্দটি সম্ভবত 'পুতুল' বা "পুতুলিকা" শব্দ থেকে এসেছে।কারণ পূর্বে এই পরিবেশনার সাথে পুতুলনাচও যুক্ত থাকত। আবার- অন্য মতে, এই শব্দটি পাঁচটি উপাদান - গান, বাদ্য, তাৎক্ষণিক কবিতা রচনা, কবিগান এবং নৃত্য - এর সমন্বয়কে বোঝায়।
পাঁচালীর বৈশিষ্ট্যসমূহঃ
• আখ্যানমূলকঃ পাঁচালিতে একটি গল্প বা কাহিনি বর্ণনা করা হয়। যার কাহিনি সাধারণত ধর্মীয় বা পৌরাণিক বিষয়ভিত্তিক হয়ে থাকে, যেমন রামায়ণ, মহাভারত, মঙ্গলকাব্য অথবা বিভিন্ন লৌকিক দেবদেবীর মাহাত্ম্য।
গান ও গল্পঃ পাঁচালীতে গানের মাধ্যমে কাহিনির বিভিন্ন অংশ গেয়ে শোনানো হয় এবং মাঝে মাঝে গল্পের অংশ গদ্যে বর্ণনা করা হয়।
একক ও দলবদ্ধ পরিবেশনাঃ পাঁচালী গান পূর্বে একক শিল্পী প্রধানত গাইতেন এবং সেটি নৃত্য ও বাদ্যের মাধ্যমে পরিবেশন করে আকর্ষণীয় করে তুলতেন। সময়ের সাথে সাথে দলবদ্ধ পরিবেশনাও প্রচলিত হয়েছে, যেখানে মূল গায়েনের সাথে বাদ্যকার ও অন্যান্য সহায়ক শিল্পী থাকেন।
সংলাপ ও অভিনয়ঃ কিছু পাঁচালিতে চরিত্রের সংলাপ এবং সামান্য অভিনয়ও দেখা যায়। সেইসাথে পাঁচালির গানগুলি সাধারণত লোকায়ত সুরে বাঁধা হয়। তবে উদ্দেশ্য শুধুমাত্র বিনোদন দেওয়া নয়, এর মাধ্যমে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষাও প্রদান করা হত।
• ঊনবিংশ শতাব্দীতে পাঁচালির ব্যাপক জনপ্রিয়তা ছিল। দাশরথি রায় ছিলেন একজন বিখ্যাত পাঁচালি রচয়িতা ও গায়ক। এছাড়াও ঠাকুরদাস দত্ত, রশিকচন্দ্র রায়, ব্রজমোহন রায় প্রমুখ উল্লেখযোগ্য পাঁচালিকার ছিলেন।
দাশরথি রায়ঃ আলোচনা শুরুতেই আমরা বলে রাখি যে, দাশু রায় বা দাসরথি রায় ছিলেন পাঁচালিকারদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ পাঁচালিকার। তিনি ছিলেন বর্ধমান জেলার কাটোয়া মহকুমার বাসিন্দা। তবে বাল্যকাল থেকেই তার মধ্যে সহজাত কবিত্ব প্রতিভার স্ফুরণ লক্ষিত হয়। আসলে তখন ছিল কবি গানের যুগ। আর কবি গানের যুগ হওয়ার কারণে তিনি স্বভাবতই সেই কবি দলে যোগদান করেন। কিন্তু-
আমরা কবি গানের ইতিহাস থেকে জানতে পারি যে, কোন এক কবি গানের আসরে তাঁর প্রতিপক্ষ তাকে জাতকুল তুলে তীব্রভাবে গালি দেয় এবং অপমান করে। আর সেই অপমানে অপমানিত হয়ে তিনি কবিদল ত্যাগ করেন এবং ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে পাঁচালী নববিন্যাস করে এক আখড়া স্থাপন করেন। অতঃপর তিনি অসংখ্য গান রচনা ছাড়াও ৬৮ টি পালাগীত রচনা করেছিলেন। আর সেই গীত গুলি ১০টি খন্ডে পরবর্তীকালে প্রকাশিত হয়।
দশরথি রায় তাঁর পাঁচালী রচনা করে তৎকালীন সময়ে জনমানসে বিপুল সম্মান এবং প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। এখানে বলে রাখা ভালো যে, কেবলমাত্র জনসাধারণই নয়- বিশিষ্ট নৈয়ায়িক পন্ডিতগণও তাঁর গুণবত্তায় মুগ্ধ হয়েছিলেন। তার প্রধান কারণ হলো সমসাময়িক জীবনসত্য এবং সমাজসমস্যাকে কেন্দ্র করে দাশরথি রায় তাঁর পাঁচালীর বিষয় করে নিয়েছিলেন। যার ফলে তিনি সমকালীন যেমন প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছিলেন, ঠিক তেমনি কালাতিক্রমে হয়েছিলেন উপেক্ষিত। তবে-
পাঁচালিকার দাশরথি রায় কেবলমাত্র যুগের দাবীকে মেটাতে সক্ষম হয়েছিলেন,কিন্তু যুগকে অতিক্রম করে তিনি যেতে পারেননি। এছাড়াও তিনি সভার মনোরঞ্জনেই সমস্ত শক্তি ব্যয় করেছেন। কিন্তু প্রতিভার যথার্থ ব্যবহারে স্থায়ী কীর্তি অর্জনে তিনি কোনভাবেই সচেষ্ট ছিলেন না। আর তার ফলে দাশরথি রায় অকৃত্রিম ও অবিমিশ্র বাংলা ভাষায় এবং বাঙালি মনোভাবের সর্বশেষ কবি হওয়া সত্ত্বেও পরবর্তীকালে বাংলা সাহিত্যে প্রায় উপেক্ষিত থেকে গেলেন। তাই তারাপদ ভট্টাচার্য বলেন- "ইনি ইংরেজ-পূর্ব আধুনিক যুগের যুগান্ধর কবি। এই যুগের সমস্ত কবির সমগ্র শক্তির কেন্দ্রীভূত বিগ্রহ দাশরথি।"
আসলে দাশরথি রায়ের প্রাণশক্তি ছিল বিপুল, তেমনি ছিল অসামান্য রচনাশক্তি। তবে কেবল প্রাচুর্যে নয়, ঐশ্বর্যেও দাশরথির কবি প্রতিভা অসামান্য। যেখানে একদিকে আছে প্রাচীন পদাবলীর মতো ভাবোদ্দীপক গান এবং মঙ্গকাব্যের মতো নানা জ্ঞাতব্য বস্তুতালিকা,আবার অপরদিকে অর্বাচীন তর্জার বা বিতন্ডায় কবিগানের রসকলহ। আর সেখানে তিনি যাত্রা অভিনয়ে,কৌতুকে পাঁচালীকে করে তুললেন সম্পূর্ণ ঐশ্বর্ময়। সেই ঐশ্বর্যে আমরা দেখি-
"দোষ কারো নয় গো মা। আমি স্বাদ সলিলে ডুবি মরি শ্যামা।"
পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, পাঁচালিকার দাসরথি রায়ের গানগুলি শুনে মনে হয় যে, তাঁর মধ্যে কবিত্ব ভাবনা কত গভীর ছিল। তাই আমরা বলতে পারি দাসরথি রায়ের কবিত্ব ও রচনা নৈপুূণ্য সম্বন্ধে পন্ডিত ও সমালোচকগণ যাই বলুক না কেন, প্রায় ২০০ বছর ধরে সমগ্র গ্রামবাংলা এবং নাগরিক শ্রোতাদের একটি বড় অংশ তাঁকে উচ্ছ্বসিত প্রশংসার শিরোপা দিয়ে আসছেন।
ঠিক এরূপ অসংখ্য বিষয়ভিত্তিক আলোচনা, নোটস, সাজেশন পেতে ভিজিট করুন আমাদের SHESHER KOBITA SUNDARBAN Youtube channel ।
Comments
Post a Comment