ইংরেজি সাহিত্যিক চার্লস ডিকেন্সের ঔপন্যাসিক চেতনার পরিচয় দাও(পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় ষষ্ঠ সেমিস্টার, বাংলা অনার্স)
আলোচনার শুরুতেই আমরা বলে রাখি যে, ইংরেজি উপন্যাস সাহিত্যের ইতিহাসে চার্লস ডিকেন্স এক অনন্য সাহিত্যিক। আসলে তিনি ইংরেজি উপন্যাস সাহিত্যের এক কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব। অষ্টাদশ শতকে ইংরেজি উপন্যাসে ক্রম পরিণতি ডিকেন্সের রচনায় সমৃদ্ধি ও জনপ্রিয়তার এক নব দিগন্ত উপনীত হয়েছিল।আর এই প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, তাঁর স্থান শেক্সপিয়ারের পাশেই। তাছাড়াও তাঁর গল্প বলার ভঙ্গি ছিল নুতন দিগন্তের দিশারী।আর সেখানে-
•ডিকেন্সের রচনাসমূহ•
তৎকালীন যুগের দারিদ্রতা, ব্যর্থ প্রেম, অমানুষিক পরিশ্রম ইত্যাদি অভিজ্ঞতার দ্বারা সমৃদ্ধ হয়ে ডিকেন্স চারিত্রিক দৃঢ়তা ও নিজস্ব দক্ষতার গুণে তিনি সংবাদদাতার কাজ শুরু করেন। আর তিনি যে পত্রিকায় সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেন সেটি হল 'The True Sun'। আসলে সাংবাদিক জীবনের নানান অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি শুরু করলেন ছোট ছোট নকশাধর্মী কিছু রচনা। এখানে তিনি নিজেকে তুলে ধরলেন'Boz' এই ছদ্মনাম নিয়ে। ধারাবাহিকভাবে রচনার মধ্যে দিয়ে তিনি অর্জন করলেন জনপ্রিয়তা এবং খ্যাতি, যা তাঁকে লেখকের মর্যাদা এনে দেয়। অতঃপর প্রকাশিত হতে থাকে-
Oliver Twist-1838, Nicholas Nickleby-1839, The Old Curiosity Shop -1841, Barna by Redge -1841 Black House-1853, Our Mutual Friend -1861 প্রভৃতি রচনাসমূহ।আর এই সকল রচনার মধ্যে দিয়ে উপন্যাসিক ডিকেন্সকে আমরা দেখতে পাই-
মানবতন্ত্রী ডিকেন্সঃ ধারাবাহিক রচনার মধ্যে দিয়ে ডিকেন্স পাঠকের দরবারে উপস্থিত হলেন। আর সেখানে তিনি পাঠকের মনকে হরণ করে নিয়ে জনপ্রিয়তার শীর্ষে প্রবাদপ্রতিম উপন্যাসিক হিসেবে নিজেকে তুলে ধরলেন। আসলে তার উপন্যাসের জগত বড় বিচিত্রময় এবং উদ্ভট। তবে তাঁর উপন্যাসের মনোরম জগত, মানুষের বেশভূষা, আচার-আচরণ, স্বভাব মানসিকতার যে জগৎ গড়ে তুলেছিলেন তা ভীষণ আকর্ষনীয়। বলা যায় মানবতন্ত্রী ডিকেন্স উদর দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পর্যবেক্ষণের আন্তরিকতায় জীবনকে চিত্রিত করেছে। যেখানে মানবজগত হয়ে উঠেছে রসময় স্পন্দমান।
সমাজ বাস্তবতার দৃষ্টিভঙ্গিঃ ডিকেন্সের উপন্যাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো সমসাময়িক ইংল্যান্ডের সমাজবাস্তবতার নিপুণ চিত্রণ। আর সেই চিত্র তিনি তুলে ধরেছেন- দারিদ্র্য, শিশুশ্রম, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, দুর্নীতিগ্রস্ত বিচার ব্যবস্থা, এবং শ্রেণী বৈষম্য,যা তৎকালীন সমাজে অত্যন্ত জীবন্ত চিত্র। সেই চিত্রে তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘অলিভার টুইস্ট’, ‘নিকোলাস নিকলবি’, ‘হার্ড টাইমস’ এবং ‘গ্রেট এক্সপেকটেশনস’-এ এই দিকগুলো বিশেষভাবে ফুটে উঠেছে। তবে ডিকেন্স শুধু তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থা চিত্রায়ণ করেননি, বরং তাঁর তীক্ষ্ণ সমালোচনামূলক দৃষ্টিও উপন্যাসগুলোতে স্পষ্ট। তিনি সমাজের অসংগতি ও অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন এবং তাঁর লেখার মাধ্যমে জনমত গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিলেন।
•মানবতাবোধ ও ডিকেন্সঃ ডিকেন্সের উপন্যাস গুলিতে আমরা তাঁরই গভীর মানবতাবোধ দেখতে পাই। আসলে তিনি সমাজের প্রান্তিক ও অসহায় মানুষের প্রতি গভীর সহানুভূতিশীল ছিলেন। তাই তাঁর উপন্যাসের সৃষ্ট চরিত্রগুলি প্রায়শই কঠিন পরিস্থিতিতে সংগ্রাম করে, কিন্তু তাদের মধ্যেকার মানবিক গুণাবলী যেমন- দয়া, সহমর্মিতা, বন্ধুত্ব উজ্জ্বলভাবে প্রকাশিত হয়। ডিকেন্সের সেই সহানুভূতিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি পাঠকদের মনে চরিত্রগুলির জন্য গভীর আবেগ, মমত্ববোধ ও শ্রদ্ধা জাগিয়ে তোলে।
• কৌতুকরস ও ডিকেন্সঃ ডিকেন্সর উপন্যাসে কৌতুকরস একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ও সম্পদ। তিনি বিভিন্ন হাস্যকর পরিস্থিতি এবং মজাদার চরিত্রের মাধ্যমে গল্পকে আকর্ষণীয় করে তুলতে শ্রদ্ধাবান ছিলেন। তবে তাঁর কৌতুকরস কেবল নিছক আনন্দ দান করে না, অনেক সময় তা সমাজের ভণ্ডামি ও ত্রুটিগুলোকে ব্যঙ্গাত্মকভাবে তুলে ধরে। ‘পিকউইক পেপার্স’-এর চরিত্রগুলি এবং অনেক ক্ষেত্রে পার্শ্বচরিত্রদের ব্যবহারে ডিকেন্সের এই কৌতুকপ্রিয়তা দেখা যায়।
• আবেগময়তা ও ডিকেন্সঃ ডিকেন্সের উপন্যাসে মেলোড্রামাটিক উপাদান এবং তীব্র আবেগ প্রায়শই দেখা যায়। তিনি নাটকীয় পরিস্থিতি তৈরি করতে এবং চরিত্রের আবেগপূর্ণ অনুভূতিগুলিকে তীব্রভাবে প্রকাশ করতে দক্ষ ছিলেন। যদিও আধুনিক সাহিত্য সমালোচকরা কখনও কখনও এর সমালোচনা করেন, তবে তৎকালীন পাঠকসমাজের কাছে এই আবেগপূর্ণ উপস্থাপনা অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল।
• নীতি নৈতিকতা ও ডিকেন্সঃ ডিকেন্সের উপন্যাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো নীতিবোধের প্রতি তাঁর দৃঢ় অঙ্গীকার ও বিশ্বাস।তাঁর গল্পগুলিতে ন্যায়বিচার ও সততার জয় এবং অন্যায় ও দুর্নীতির পরাজয় দেখানো হয়। আসলে তিনি পাঠকদের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধ জাগাতে চেয়েছিলেন।তাই তিনি উপন্যাসের মাধ্যমে সেই নৈতিক বার্তা তুলে ধরেছেন।
• চরিত্র চিত্রন ও ডিকেন্সঃ ডিকেন্স তাঁর উপন্যাসের চরিত্রগুলিকে অত্যন্ত জীবন্ত এবং স্বতন্ত্রভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলি একটু অদ্ভুত বৈশিষ্টময়। এখানে চরিত্রগুলির বাচনভঙ্গি এবং অভ্যাসের জন্য বিখ্যাত হয়ে উঠেছে বলা যেতেই পারে।এই চরিত্রগুলি তাদের নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য এবং জটিলতার জন্য পাঠকের মনে দীর্ঘস্থায়ী ছাপ ফেলেছে।
• ভাষার ব্যবহার ও ডিকেন্সঃ ডিকেন্স ভাষার ব্যবহার ও বর্ণনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন।তাই তাঁর লেখার ভাষা অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং বর্ণনাময়।বলা বাহুল্য যে, পাঠককে সেই সময়ের পরিবেশে নিমজ্জিত করে। সেই প্রেক্ষিতে তাঁর বাক্যগঠন এবং শব্দচয়নে এক বিশেষ আকর্ষণ লক্ষ্যণীয়।
পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে,চার্লস ডিকেন্সের ঔপন্যাসিক চেতনা একদিকে যেমন তৎকালীন সমাজের বাস্তব চিত্রায়ণ ও সমালোচনার সমন্বয়ে গঠিত, তেমনই অন্যদিকে গভীর মানবতাবোধ, কৌতুকরস, আবেগ এবং নীতিবোধের এক শক্তিশালী সংমিশ্রণ। তবে তাঁর উপন্যাসের চরিত্রায়ণ এবং বর্ণনার স্বতন্ত্রতা তাঁকে ইংরেজি সাহিত্যের এক অমর উজ্জ্বল ঔপন্যাসিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
ঠিক এরূপ অসংখ্য বিষয়ভিত্তিক আলোচনা সাজেশন এবং ভিডিও পেতে ভিজিট করুন আমাদের SHESHER KOBITA SUNDORBON YOUTUBE CHANNEL
Comments
Post a Comment