জ্ঞান উৎপত্তিতে অভিজ্ঞতাবাদীদের মতবাদ সবিচার আলোচনা করো (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় দ্বিতীয় সেমিস্টার মাইনর দর্শন)।
আলোচনার শুরুতেই আমরা বলে রাখি যে, জ্ঞান উৎপত্তিতে অভিজ্ঞতাবাদ হলো জ্ঞানের উৎস সম্পর্কিত একটি দর্শন, যে দর্শন মনে করে মানুষের জ্ঞান প্রধানত ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে গঠিত হয়। অর্থাৎ আমাদের সমস্ত জ্ঞানের উৎপত্তির উৎস হলোঅভিজ্ঞতা। আর এই মতবাদ জ্ঞান উৎপত্তির ক্ষেত্রে বুদ্ধিবাদী মতবাদের একটি শক্তিশালী বিকল্প মতবাদ। যেখানে -
• আসলে অভিজ্ঞতাবাদীরা বিশ্বাস করেন যে, মানুষ জন্মের সময় কোনো সহজাত জ্ঞান নিয়ে আসে না, বরং জ্ঞান অর্জন করে ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার মাধ্যমে, যেমন - দেখা, শোনা, স্পর্শ, স্বাদ এবং গন্ধের মাধ্যমে।
• জ্ঞান উৎপত্তির ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতাবাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক মতবাদ।আর সেই মতবাদ অনুযায়ী, মানুষের সমস্ত জ্ঞান ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অর্জিত হয়। সেখানে মানুষের মন জন্মকালে একটি অলিখিত সাদা কাগজের মতো থাকে। যেখানে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে জ্ঞান লিপিবদ্ধ হয়।
•অভিজ্ঞতাবাদীদের জ্ঞান উৎপত্তিতে মূল বক্তব্য•
অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিকরা বুদ্ধিবাদীদের সহজাত ধারণাকে অস্বীকার করেন। তাঁদের মতে, জন্মকালে কোনো পূর্বনির্ধারিত ধারণা বা জ্ঞান মানুষের মনে থাকে না। জ্ঞানের প্রধান উৎস হলো ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষ এবং অনুভব। এই অভিজ্ঞতা আসে আমাদের কাছে দুইভাবে -
১) বহিঃসংবেদনঃ বাইরের জগৎ থেকে ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে আমরা যে জ্ঞান লাভ করি তা হলো বর্হিসংবেদনের নামান্তর। যেমন - কোনো বস্তুর রঙ, গন্ধ, স্বাদ, স্পর্শ ইত্যাদি।
২) অন্তঃসংবেদনঃ আমাদের মনের নিজস্ব কিছু কার্যকলাপ আছে। আর সেই কার্যকলাপ গুলি হলো অন্তঃসংবেদন।, যেমন - চিন্তা, বিশ্বাস, ইচ্ছা, আবেগ ইত্যাদি থেকে আমরা যে জ্ঞান লাভ করি। তবে-
•অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিকরা মনে করেন, প্রথমে আমরা ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে বিশেষ বিশেষ বস্তু বা ঘটনার জ্ঞান লাভ করি।এরপর আরোহ পদ্ধতি প্রয়োগ করে সামান্যীকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সার্বিক বচনে বা জ্ঞানে উপনীত হই। যেমন, বিভিন্ন মরণশীল মানুষের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা 'সব মানুষ মরণশীল' - এই সার্বিক জ্ঞান লাভ করি।
প্রধান অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিকগণ
•জ্ঞান উৎপত্তিতে লকের অভিমতঃ আমরা জানি যে,জন লক আধুনিক অভিজ্ঞতাবাদের জনক। তিনি 'An Essay Concerning Human Understanding' গ্রন্থে তাঁর অভিজ্ঞতাবাদী মতবাদ বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেছেন। আসলে লকের মতে, সমস্ত ধারণা হয় সরল অথবা জটিল। আর সেখানে,সরল ধারণাগুলো সরাসরি ইন্দ্রিয় থেকে আসে, আর জটিল ধারণাগুলো সরল ধারণার সমন্বয়ে গঠিত হয়।
•জ্ঞান উৎপত্তিতে বার্কলের অভিমতঃ দার্শনিক বার্কলে লকের মতবাদের এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেন "Esse est percipi" অর্থাৎ"অস্তিত্ব প্রত্যক্ষ নির্ভর"।আসলে বার্কলের মতে, বস্তুর অস্তিত্ব প্রত্যক্ষের উপর নির্ভরশীল, অর্থাৎ কোনো বস্তুর অস্তিত্ব ততক্ষণই থাকে, যতক্ষণ সেটি কারো দ্বারা প্রত্যক্ষ করা হয়। তাই তিনি জড় বস্তুর মন নিরপেক্ষ অস্তিত্ব অস্বীকার করেন।
•জ্ঞান উৎপত্তিতে হিউমের অভিমতঃ হিউম অভিজ্ঞতাবাদের চরমপন্থী রূপ দেন। তাঁর মতে, আমাদের সমস্ত জ্ঞান ছাপ (impressions) এবং ধারণা(ideas) থেকে আসে। আর এখানে ইম্প্রেশন বা ছাপ হলো জীবন্ত এবং প্রত্যক্ষ অনুভূতি, আর আইডিয়া হলো ছাপ র দুর্বল প্রতিচ্ছবি। তিনি কার্যকারণ সম্বন্ধের আবশ্যিকতাকে অস্বীকার করেন এবং বলেন যে, এটি কেবল একটি মানসিক প্রবণতা যা পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে।
•অভিজ্ঞতাবাদীদের মতবাদের সমালোচনা•
১. সর্বজনীন ও আবশ্যিক জ্ঞানের ব্যাখ্যায় ব্যর্থতা: অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিকরা মনে করেন সমস্ত জ্ঞান অভিজ্ঞতা থেকে আসে।। কিন্তু গণিত বা যুক্তিশাস্ত্রের মতো কিছু ক্ষেত্রে আমরা এমন জ্ঞান আমরা লাভ করি যা সর্বজনীন (universal) এবং আবশ্যিক (necessary)। যেমন-- '২+২=৪' বা 'সব ত্রিভুজের তিনটি বাহু আছে' - এই জ্ঞানগুলো অভিজ্ঞতানির্ভর নয়, বরং আবশ্যিক ও নিশ্চিত। অভিজ্ঞতাবাদ এই ধরনের জ্ঞানের উৎস ব্যাখ্যা করতে পারে না। হিউমের চরম অভিজ্ঞতাবাদ জ্ঞানকে আপতিক (contingent) ও সম্ভাবনামূলক করে তোলে, যা বৈজ্ঞানিক বা গাণিতিক জ্ঞানের নিশ্চয়তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
২) কার্যকরণ সম্বন্ধেঃ হিউম কার্যকারণ সম্বন্ধকে নিছক অভ্যাসের ফল বলে মনে করেন। তাঁর মতে, আমরা কেবল কার্য ও কারণের সহাবস্থান দেখি কিন্তু তাদের মধ্যে কোনো আবশ্যিক সংযোগ দেখি না। তবে বিজ্ঞানের অগ্রগতির জন্য কার্যকারণ সম্বন্ধের আবশ্যিকতা অপরিহার্য।
৩) ধারণার গঠন প্রক্রিয়াঃ অভিজ্ঞতাবাদীরা দাবি করেন যে, ধারণাগুলো কেবল ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার মাধ্যমে গঠিত হয়। কিন্তু কিছু বিমূর্ত ধারণা, যেমন - 'ন্যায়', 'সত্য', 'অসীমতা' ইত্যাদি কিভাবে কেবল ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার মাধ্যমে গঠিত হতে পারে, তা স্পষ্ট নয়। এসব ধারণা গঠনে বুদ্ধির সক্রিয় ভূমিকার প্রয়োজন হয়। তবে-
•বিচারবাদী দার্শনিক কান্ট অভিজ্ঞতাবাদ ও বুদ্ধিবাদীদের মাঝে অবস্থান করে তাদের মতবাদের মধ্যে একটি সমন্বয় সাধন করেছেন। আর সেখানে তার মতে- "ধারণা ছাড়া প্রত্যক্ষ অন্ধ এবং প্রত্যক্ষণ ছাড়া ধারণা শুন্য" অর্থাৎ, জ্ঞানের জন্য আমাদের ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা (উপাদান) এবং বুদ্ধি (আকার) উভয়ই প্রয়োজন। কারণ -
•অভিজ্ঞতা জ্ঞানের উপাদান সরবরাহ করে আর বুদ্ধি সেই উপাদানকে আকার দান করে অর্থপূর্ণ জ্ঞানে পরিণত করে। অভিজ্ঞতাবাদ জ্ঞানের উপাদানকে গুরুত্ব দিলেও জ্ঞানের আকারের ক্ষেত্রে বুদ্ধির ভূমিকা উপেক্ষা করে। অর্থাৎ প্রকৃত জ্ঞান লাভ করতে হলে আমাদের অবশ্যই অভিজ্ঞতা এবং বুদ্ধি দুইই প্রয়োজন।
ঠিক এরূপ অসংখ্য বিষয়ভিত্তিক আলোচনা, ব্যাখ্যা সাজেশন ভিডিও পেতে ভিজিট করুন আমাদের ফেসবুক পেজ এবং আমাদের SHESHER KOBITA SUNDARBAN Youtube channel 🙏
Comments
Post a Comment