চন্ডীমঙ্গল(2nd.Sem) কাব্যের আখেটিক খন্ডে তৎকালীন সমাজ জীবন ও অর্থনৈতিক প্রভাব কিভাবে পড়েছিল আলোচনা কর( পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, দ্বিতীয় সেমি
চন্ডীমঙ্গল কাব্যের আখেটিক খন্ডে তৎকালীন সমাজ জীবন ও অর্থনৈতিক প্রভাব কিভাবে পড়েছিল আলোচনা কর( পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, দ্বিতীয় সেমিস্টার বাংলা,মেজর CC2)।
আলোচনার শুরুতেই আমরা বলে রাখি যে,চন্ডীমঙ্গল কাব্যের আখেটিক খন্ড, যা মূলত কালকেতুর ব্যাধ জীবনের বর্ণনা এবং দেবী চন্ডীর কৃপায় তার ধনপ্রাপ্তি ও গুজরাট নগর পত্তনের আগের অংশের কাহিনী নিয়ে গঠিত। আর সেই কাব্যে তৎকালীন সমাজ ও অর্থনীতিতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল। সেই প্রেক্ষিতে আমরা আখেটিক খন্ডের মূল ভিত্তি স্থাপনে দেখি-
•তৎকালীন সমাজের ওপর প্রভাব•
১) নিম্নবর্গের মানুষের জীবন ও জীবিকাঃ চন্ডিমঙ্গল কাব্যের আখেটিক খন্ডে ব্যাধ কালকেতুর শিকারজীবী জীবনের কাহিনী প্রাণবন্ত ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। বনজঙ্গল থেকে শিকার করে আনা পশুর মাংস ও চামড়া বিক্রি করে তার সংসার চলত। এই চিত্র তৎকালীন সমাজের প্রান্তিক ও নিম্নবর্গের মানুষের জীবনযাত্রা, তাদের সংগ্রাম এবং জীবিকা অর্জনের পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা দেয়। এটি সমাজের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর থেকে ভিন্ন একটি জীবনালেখ্য তুলে ধরা হয়েছে।
• জাতিভেদ প্রথার চিত্রায়নঃ কালকেতুর ব্যাধ জীবনের পরিচয় তৎকালীন সমাজে তার সামাজিক অবস্থান স্পষ্ট করে। তৎকালীন সমাজে ব্যাধরা সাধারণত সমাজের নিম্নস্তরে মানুষ বলে পরিগণিত হত। তবে এই খন্ডে জাতিভেদ প্রথার কঠোরতা এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যেকার ভেদাভেদ পরিলক্ষিত হয়। যেখানে দেবীর কৃপায় কালকেতুর উন্নতি এই প্রথার একটি ব্যতিক্রমী দিকও তুলে ধরে।
•ধর্মীয় বিশ্বাস ও লৌকিক দেবদেবীর প্রভাবঃ চন্ডীমঙ্গল কাব্যে আখেটিক খন্ডেও দেবী চন্ডীর প্রতি কালকেতুর ভক্তি ও বিশ্বাস দেখানো হয়েছে।যে কাব্যে দেবীর আশীর্বাদ লাভের আকাঙ্ক্ষা এবং দেবীর অলৌকিক ক্ষমতা কালকেতুর জীবনে পরিবর্তন আনে।আসলে এটি তৎকালীন সমাজে লৌকিক দেবদেবীর পূজা ও তাদের প্রভাবের একটি স্পষ্ট চিত্রণ। দেবীর মাহাত্ম্য প্রচারের ক্ষেত্রে এই খন্ডটিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
•পারিবারিক জীবন ও নারীর ভূমিকাঃ চন্ডীমঙ্গল কাব্যের আখেটিক খণ্ডে কালকেতুর স্ত্রী ফুল্লরার চরিত্র বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যেখানে ফুল্লরা একজন পরিশ্রমী ও বাস্তববাদী নারী, যে শিকারে স্বামীকে সাহায্য করে এবং সংসারের দৈনন্দিন কাজকর্ম সামলায়। তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং ফুল্লরার বুদ্ধিমত্তা ও কর্মদক্ষতা তৎকালীন সমাজে নারীর ভূমিকা সম্পর্কে একটি ধারণা দেয়।
•প্রকৃতি ও পরিবেশের মেলবন্ধনঃ চন্ডীমঙ্গল কাব্যে আখেটিক খন্ডের পটভূমি মূলত বনভূমি। যেখানে কালকেতুর জীবনযাপন প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। শিকারের জন্য বন জঙ্গলের জ্ঞান এবং প্রকৃতির সঙ্গে তার নিবিড় সম্পর্ক দেখানো হয়েছে। এটি তৎকালীন সমাজে মানুষের প্রকৃতি নির্ভর জীবনযাত্রার একটি দিক উন্মোচন করে।
• তৎকালীন সমাজের ওপর অর্থনৈতিক প্রভাব•
•শিকার ও পশু পালন অর্থনীতির অংশঃ চন্ডীমঙ্গল কাব্যের আখেটিক শিকার কেবল একটি জীবিকা নির্বাহের উপায় নয়, বরং তৎকালীন অর্থনীতির একটি অংশ হিসেবেও প্রতিভাত হয়। সেই সময়ে শিকার করা পশুর মাংস বিক্রি এবং চামড়া সম্ভবত বাণিজ্যিক পণ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। যদিও এর ব্যাপকতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় না, তবে এটি গ্রামীণ অর্থনীতির একটি দিক অবশ্যই ছিল এ কথা বলা চলে।
•সম্পদের সীমাবদ্ধতা ও অভাবঃ কালকেতুর দারিদ্র্য এবং অভাবের চিত্র তৎকালীন সমাজের একটি বড় অংশের অর্থনৈতিক দৈন্য দশাকে প্রতিফলিত করে।আর সেখানে জীবিকা অর্জনের জন্য কঠোর পরিশ্রম এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ছবি এই খন্ডে অতি স্পষ্টতর।
•দেবীর আশীর্বাদ ও ভাগ্য পরিবর্তনঃ দেবীর কৃপায় বা আশীর্বাদে কালকেতুর জীবনে অপ্রত্যাশিত ধনপ্রাপ্তি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে একটি আকস্মিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। যেটি সমাজে ভাগ্যের উপর বিশ্বাস এবং দৈব সহায়তার ধারণাকে শক্তিশালী করে।
•পরবর্তীতে অর্থনৈতিক সম্ভাবনার প্রভাবঃ চন্ডীমঙ্গল কাব্যে আখেটিক খন্ডে সরাসরি কোনো বড় ধরনের অর্থনৈতিক পরিবর্তন দেখানো হয়নি। তবে কালকেতুর ধনপ্রাপ্তি এবং পরবর্তীকালে গুজরাট নগর পত্তনের প্রেক্ষাপট তৈরি হয় এই খন্ডের মাধ্যমেই।যা একটি নতুন অর্থনৈতিক কেন্দ্র স্থাপনের সম্ভাবনা তৈরি করে এবং পরবর্তীকালে বাণিজ্য ও অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিস্তার ঘটাতে সাহায্য করে।
পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, চন্ডীমঙ্গল কাব্যের আখেটিক খন্ড তৎকালীন সমাজের নিম্নবর্গের মানুষের জীবন, জাতিভেদ প্রথা, ধর্মীয় বিশ্বাস, পারিবারিক সম্পর্ক এবং প্রকৃতি নির্ভর জীবিকার একটি স্পষ্ট চিত্র তুলে ধরে। শুধুমাত্র তাই নয়, এই খন্ডটি অর্থনৈতিক দিক থেকে এটি শিকারবৃত্তির গুরুত্ব, সম্পদের সীমাবদ্ধতা এবং ভাগ্যের পরিবর্তনের ধারণাকে তুলে ধরে, যা পরবর্তীকালে একটি নতুন অর্থনৈতিক সম্ভাবনার বাতাবরণ সূচনা করে। তবে চন্ডীমঙ্গল কাব্যের আগে ঠিক খন্ডটি সেই সময়ের সমাজ ও অর্থনীতির একটি মূল্যবান দলিল হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে সে বিষয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই।
•ঠিক এরূপ অসংখ্য বিষয়ভিত্তিক আলোচনা, ব্যাখ্যা, সাজেশন, ভিডিও পেতে ভিজিট করুন আমাদের ফেসবুক পেজ, এবং"SHESHER KOBITA SUNDARBAN" Youtube channel 🙏•
Comments
Post a Comment