জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে বুদ্ধিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদের তুলনামূলক আলোচনা করো(পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, দ্বিতীয় সেমিস্টার দর্শন, মাইনর)
বুদ্ধিবাদ অনুসারে আমরা জানি যে, বুদ্ধিই জ্ঞানের আদর্শ উৎস। আসলে বুদ্ধির সাহায্যে মন তার সহজাত ধারণাগুলি থেকে সক্রিয়ভাবে সর্বজনীন স্বীকৃত যথার্থ জ্ঞান লাভ করে। অর্থাৎ বুদ্ধিবাদ অনুসারে যথার্থ জ্ঞান অধিকাংশ ক্ষেত্রে অবরোহ পদ্ধতির মাধ্যমে অর্জন করা হয়। আর এক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা লব্ধ জ্ঞান অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সম্ভাব্য। তাই অভিজ্ঞতা প্রসূত জ্ঞান কখনো সার্বিক জ্ঞান হতে পারে না। কিন্তু-
অভিজ্ঞতাবাদ অনুসারে ইন্দ্রিয়ানুভব হল জ্ঞানলাভের আদর্শ উৎস। তাদের মতে, আমাদের সব জ্ঞানই অভিজ্ঞতালব্ধ এবং সেই অভিজ্ঞতালব্ধের মূলে আছে ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ। আর এই ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষের মাধ্যমে আমরা সাধারণ বা সার্বিক সত্যে উপনীত হই। আর এই কারণে বুদ্ধিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদীদের মধ্যে জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে যে পার্থক্যগুলি দেখা যায় তা হল-
১) বুদ্ধিবাদ অনুসারে বুদ্ধিই হল জ্ঞানলাভের একমাত্র উৎস। অর্থাৎ বুদ্ধি ছাড়া অন্য কোন উপায়ে জ্ঞান লাভ করা সম্ভব নয়। কিন্তু-
অভিজ্ঞতাবাদ অনুসারে অভিজ্ঞতাই হলো জ্ঞান লাভের একমাত্র উৎস। অর্থাৎ ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা ছাড়া অন্য কোন উপায়ে জ্ঞানের উৎস তারা স্বীকার করেন না।
২) বুদ্ধিবাদীদের মতে, আমাদের জ্ঞান উৎপন্ন সহজাত ধারণ থেকে। আর সহজাত ধারণা থেকে জ্ঞান উৎপন্ন হয় বলে আমাদের জ্ঞান হলো পূর্বতঃসিদ্ধ। কিন্তু -
অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিকদের মতে সহজাত ধারণা বলে কিছুই নেই। বরং তারা মনে করেন, জ্ঞান লাভের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, পর্যবেক্ষণ বা বাস্তব ব্যাপার বিষয়ক জ্ঞানের উপর প্রাধান্য দেন।
৩) বুদ্ধিবাদী দার্শনিকরা মনে করেন, গণিতের জ্ঞান হলো আদর্শ জ্ঞান। আর এই ধরনের জ্ঞান বুদ্ধি দ্বারা লাভ করা যায়। কিন্তু-
অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিকগণ দাবি করেন যে, গণিতের জ্ঞানের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বা মর্যাদা নেই। এই ধরনের জ্ঞান অভিজ্ঞতার অন্তর্গত।
৪) বুদ্ধিবাদীরা জ্ঞানের উৎপত্তির ক্ষেত্রে অবরোহ পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকেন। এই পদ্ধতির মাধ্যমে গৃহীত সিদ্ধান্ত তারা নিশ্চিত বলে গণ্য করেন। কিন্তু-
অভিজ্ঞতাবাদীরা জ্ঞ জ্ঞানের উৎপত্তির ক্ষেত্রে আরোহ পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকেন। এই পদ্ধতির মাধ্যমে গৃহীত সিদ্ধান্ত নিশ্চিত বলে গণ্য হয় না, সব সময় সম্ভাব্য হয়।
বুদ্ধিবাদীরা জ্ঞানের ক্ষেত্রে বিশ্লেষক বচনের উল্লেখ করেছেন এবং তাদের মতে এই বচন পূর্বতঃসিদ্ধ। কিন্তু-
অভিজ্ঞতাবাদীরা জ্ঞানের ক্ষেত্রে সংশ্লেষক বচনের উল্লেখ করেছেন। আর সেই বচনের জ্ঞান পরতঃসাধ্য হওয়ার কারণে সত্য কিম্বা মিথ্যা হতে পারে।
৬) বুদ্ধিবাদীদের মতে, আমাদের জ্ঞানের মূল বৈশিষ্ট্য হলো- সার্বিকতা ও আবশ্যিকতা। তাদের মতে যা জ্ঞানরূপে গণ্য হয় তা সর্বদেশে সর্বকালে একইভাবে আবশ্যিক রূপে গণ্য হবে। যেমন-২ + ২=৪, এটি সর্বকালে ও সর্বশেষে আবশ্যিক। কিন্তু-
অভিজ্ঞতাবাদীদের মতে, জ্ঞানের মূল বৈশিষ্ট্য হলো নতুনত্ব। কারণ আমরা আমাদের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে নতুন নতুন জ্ঞানের সন্ধান পাই।এর ফলে উদ্দেশ্য সম্পর্কে বিধেয়ে নতুন নতুন তথ্য সংযোজন হয়।
৭) বুদ্ধিবাদী দার্শনিক বিশেষত কান্ট তিন ধরনের বচনের উল্লেখ করেছেন। আর সেই বচনগুলি হলো-পূর্বতঃসিদ্ধ বিশ্লেষক, পরতঃসাধ্য সংশ্লেষক এবং পূর্বতঃসিদ্ধ সংশ্লেষক। কিন্তু -
নরমপন্থী অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিকরা দুই প্রকার বচন স্বীকার করেছেন। আর সেই বচনগুলি হলো-পূর্বতঃসিদ্ধ বিশ্লেষক এবং পরতঃসাধ্য সংশ্লেষক।
৮) বুদ্ধিবাদী দার্শনিক ডেকার্ড, স্পিনোজা এবং লাইবনিজ প্রমূখ বুদ্ধিবাদী দার্শনিকের মতে বুদ্ধির দ্বারা অধিবিদ্যাকে জানা যায়। কিন্তু-
অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক হিউম ও যৌক্তিক দৃষ্টিবাদীদের মতে, অধিবিদ্যার জ্ঞান কখনোই সম্ভব নয়।
৯) বুদ্ধিবাদী দার্শনিকদের মতে, মৌলিক ধারণা গঠনের ক্ষেত্রে আমাদের মন স্বরূপত সক্রিয় থাকে। কিন্তু-
অভিজ্ঞতাবাদীদের মতে, মৌলিক ধারণা গঠনের ক্ষেত্রে আমাদের মন থাকে নিষ্ক্রিয়।
Comments
Post a Comment