মেঘনাদবধ কাব্যের চতুর্থ সর্গের কাব্যেপযোগিতা আছে কি? আলোচনা কর(পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, চতুর্থ সেমিস্টার, বাংলা মেজর)
আলোচনা শুরুতেই আমরা বলে রাখি যে, কাব্যকার মধুসূদন দত্ত সর্বপ্রথম ইউরোপীয় কাব্যকলাকে মেঘনাদবধ কাব্যে সংযুক্তি করেছেন।আর সেখানে তিনি কাব্যটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গতিধারা অপরিবর্তিত দেখেছেন।আর এই প্রেক্ষিতে বলা যেতে পারে যে, এ কাব্যের কোন সর্গ অপ্রয়োজনীয় নয়। কিন্তু সমালোচনার জন্য বেশ কিছু সমালোচক অভিযোগ করেন যে, এই সর্গের সাথে মূল কাহিনীর কোন সংযোগ নেই। শুধু তাই নয়, কবি দীর্ঘ পথ চলতে চলতে সহসা পথ হারিয়েছে।আর সেই অভিযোগ নিতান্তই অসত্য অসত্য প্রমাণ করা যেতে পারে। আর সেখানে আমরা দেখি-
•কবি চতুর্থ সর্গে বাল্মিকীর চরণ বন্দনা করে নতুন এক শক্তি সংগ্রহের জন্য জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এই শক্তির জন্য বিশেষ প্রস্তুতির প্রয়োজন ছিল,কবি তা ভালোভাবেই উপলব্ধি করেন।তবে যারা মনে করেন চতুর্থ সর্গের উপজীব্য বিষয় সীতা চরিত্র অঙ্কন করা, তারা কবি কৃতিত্ব পর্যাপ্ত ব্যাখ্যা করতে পারেননি। তবে আমাদের মনে রাখা দরকার যে, এই কাব্যটি অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। যেখানে চতুর্থ সর্গটির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কবি অত্যন্ত সচেতন বলেই প্রার্থনাটি এরই প্রারম্ভে সন্নিবেশিত হয়েছে। তবে -
আমরা জানি যে, মহাকাব্যের প্রয়োজন বৈচিত্র্য।আর এই বৈচিত্রের দিক থেকে চতুর্থ সর্গটির সমগ্র কাব্যের মধ্যে অদ্বিতীয়।তৃতীয় স্বর্গের কবি বীররস ও ঐশ্বর্য পর্যাপ্ত পরিমাণে পরিবেশন করেছেন। যেখানে দানব বালা, প্রমিলার হুংকার, দানব নন্দিনী আমি, রুক্ষকুল বধূ, রাবণ শ্বশুর মম, মেঘনাদ স্বামী, আমি কি ডরাই সখি ভিখারী রাঘবে? অতঃপর নৃমুন্ডমালিনী ও বেড়ীবৃন্দ নিয়ে প্রমিলার অভিযান। আর এই সকল ঘটনা মিলেমিশে যেন মহিষাসুর বধের আয়োজন। তবে বলা যেতে পারে এই সকল ঘটনা বর্ণনায় কবির যথেষ্ট বীরত্ব ও ঐশ্বর্যের পরিমণ্ডল সৃষ্টি করেছেন।কিন্তু মহাকাব্যের সামগ্রিক উৎকর্ষ বিধানে শান্ত, শীতল পরিবেশের বেশ প্রয়োজন ছিল। আর সেই শান্ত শীতল পরিমণ্ডল সৃষ্টিতে করুণ রসে প্লাবিত চতুর্থ সর্গের কাব্যেপযোগিতা অনেক বেশি। যেখানে-
বিধ্বস্ত লঙ্কাপুরী, ছায়া শীতল অশোকবন এই কাব্যের মূল আবহাওয়াকে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে ঘুরিয়ে দেয় প্রবল গতিতে। আবার সীতা সরমার কথোপকথন তৃতীয় স্বর্গের উত্তেজনার পারদকে স্তিমিত করে দেয়। তাই বীর রসাত্মক কাব্য উপলব্ধি করতে যে মানসিক বিশ্রাম প্রয়োজন তা আমরা চতুর্থ স্বর্গে এসে পাই। এদিক থেকে বলা যায় এই স্বর্গটি কাব্যের মধ্যে অন্যতম প্রধান উপযোগী হয়ে ওঠে। যেখানে -
আমাদের স্মরণ করা প্রয়োজন যে, মূল কাহিনীর প্রমিলার চরিত্র ও যুদ্ধ-বিধ্বস্ত লঙ্কার পাশাপাশি সীতার চরিত্র ও অশোকবনের অশ্রু সজল কথোপকথন মেঘনাদবধ কাব্যের কাব্যমূল্য অধিকতর বর্ধিত করেছে।বিশেষতঃ সীতার অরণ্য জীবনের মধুর স্মৃতি পাঠকের মনে মাধুর্যের সঞ্চার করেছে এবং সেই বিষয়টি এখানে অনেক আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। সেকারণে -
আমরা বলতে পারি যে, মেঘনাদবধ কাব্যের চতুর্থ সর্গের সংযোজন কাহিনীগত ভাবে অবশ্যই প্রয়োজন ছিল। যাকে নিয়ে লঙ্কাকান্ড, সেই সীতার কথা কাব্য থেকে বিচ্ছিন্ন হবে এটা আশা করা যায় না। যার জন্য রঘুসৈন্য সমুদ্র পার হয়ে লঙ্কা আক্রমণ, যার জন্য মহাযুদ্ধ, আর তার কথা আভাসে একটু বলতে না পারলে কাব্য রচনাটি বুঝি অপূর্ণতা থেকে যেত। তার কথা একটু বলার জন্য কবি অস্ত্র ঝংকারপূর্ণ লঙ্কা যুদ্ধের মধ্যে একটু নিভৃত অবসর সৃষ্টি করে নিয়েছেন। সেই অবসরটুকু জানকীর পবিত্র চরিত কথায় পরিপূর্ণ করে তুলেছেন। তাই -
চতুর্থ সর্গটির নীতিগত প্রয়োজনীয়তাই বোধহয় সর্বাধিক। আর এই স্বর্গটি না থাকলে রাবণের জীবনে এত করুন ও ট্রাজিক নেমে আসত না। তাই তার কন্ঠে আমরা শুনি-দেবতার সঙ্গে যুদ্ধ করে তিনি ক্ষতবিক্ষত। নিয়তির পরিহাসে তার এই করুন অবস্থা। যেখানে দৈবের প্রতিকূল আঘাতে রাবণ আজ বিলাপ করেন-
"কোন পাপে তার এই শাস্তি?"
আমরা জানি, বন্দিনী সীতার দীর্ঘশ্বাস হতে লঙ্কায় আগুন জ্বলছে। লঙ্কার সকল শৌর্য, বীর্য, ঐশ্বর্য সবই এই আগুনে ছারখার হয়ে যাবে। শুধু তাই নয়, এই আগুনে কত রক্ষোবীরের দেহ, বধুর কপালের সিঁদুর পুড়ে যাবে। এই নিয়তি বা অদৃষ্ট কোন বাইরের শক্তি নয়। আসলে অশোক বনে বন্দিনী সীতার মূর্তিই এই মর্মান্তিক পরিনামের মূল। সুতরাং এদিক থেকে বিচার করলে এই সর্গটির কাব্যেপযোগিতা অবশ্যই স্বীকার্য।
ঠিক এরূপ অসংখ্য বিষয়ভিত্তিক আলোচনা ব্যাখ্যা সাজেশন ভিডিও পেতে ভিজিট করুন আমাদের ফেসবুক পেজ এবং আমাদের SHESHER KOBITA SUNDARBAN Youtube channel 🙏
Comments
Post a Comment