Skip to main content

যযাতি কবিতায়(4th.Sem Major) কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ফ্যাসিবাদের একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রবল ঘৃণা করে পুরাণ কাহিনী রচনায় প্রবৃত্ত হয়েছেন-আলোচনা করো(

'যযাতি' কবিতায় কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ফ্যাসিবাদের একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রবল ঘৃণা করে পুরাণ কাহিনী রচনায় প্রবৃত্ত হয়েছেন-আলোচনা করো(পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, চতুর্থ সেমিস্টার, বাংলা মেজর)

           আলোচনার শুরুতেই আমরা বলে রাখি যে, কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের 'যযাতি' কবিতাটি নিছক একটি পৌরাণিক কাহিনি পুনর্নির্মাণ নয়, বরং এর গভীরে প্রোথিত আছে কবিমনের ফ্যাসিবাদী একনায়কতন্ত্রের প্রতি প্রবল ঘৃণা ও বিতৃষ্ণা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে লেখা এই কবিতাটিতে তিনি আধুনিক সভ্যতার সংকট, নৈতিক অবক্ষয় এবং ক্ষমতার অন্ধ লালসার বিরুদ্ধে এক জোরালো প্রতিবাদ তুলে ধরেছেন। আর সেখানে-

•পৌরাণিক অনুষঙ্গের ব্যবহারে কবিঃ আমরা জানি যে,'যযাতি' মহাভারতের একটি সুপরিচিত আখ্যান।আর সেই আখ্যানে রাজা যযাতি বার্ধক্যের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে তার পুত্রের যৌবন হরণ করেন। আলোচ্য কবিতায় সুধীন্দ্রনাথ এই পৌরাণিক ঘটনাকে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেছেন।আসলে কবির কাছে যযাতি কেবল এক পৌরাণিক রাজা নন, বরং তিনি ফ্যাসিবাদী একনায়কদের প্রতীক।যারা নিজেদের ক্ষমতার লোভে এবং ভোগবাদের জন্য যুবসমাজের ভবিষ্যৎকে ধ্বংস করে। পুত্রের যৌবন হরণ করে যযাতির ভোগলিপ্সা মেটানোর চিত্রটি ফ্যাসিবাদী শাসকদের দ্বারা সাধারণ মানুষের, বিশেষত তরুণ প্রজন্মের, আশা-আকাঙ্ক্ষা ও স্বাধীনতার হরণের প্রতিচ্ছবি আলোচ্য কবিতাটিতে তুলে ধরা হয়েছে। যেখানে-

•অন্ধ ক্ষমতার লালসা ও নৈতিক অবক্ষয়ে কবিঃআসলে ফ্যাসিবাদ হলো এমন এক রাজনৈতিক মতাদর্শ যেখানে মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা খর্ব করে রাষ্ট্র বা একনায়কের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করা হয়। 'যযাতি' কবিতায় যযাতির যৌবনলোভ এবং আত্মকেন্দ্রিকতা ফ্যাসিবাদী মানসিকতারই প্রতিফলন। আর সেখানে কবি দেখাতে চেয়েছেন, কীভাবে ক্ষমতার উন্মত্ততা মানুষকে নৈতিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে এবং বৃহত্তর সমাজের কল্যাণের পরিবর্তে ব্যক্তিগত ভোগকেই একমাত্র লক্ষ্য করে তোলে। যযাতির চরিত্রটি যেন সেই ফ্যাসিবাদী শাসকের প্রতিচ্ছবি, যে কেবল নিজের সুখ ও ক্ষমতাকেই সর্বোচ্চ মূল্য দেয়, অন্যের জীবন ও স্বাধীনতার কোনো মূল্য দেয় না।

•উদ্দীপ্ত যৌবনের বলিদান ও হতাশায় কবিঃ ফ্যাসিবাদ সব সময় তারুণ্যের ওপর জোর দেয়, তাদের জাতীয়তাবাদী উন্মাদনায় ব্যবহার করে। কিন্তু পরিণামে তাদের ভবিষ্যৎকে অন্ধকারে ঠেলে দেয়। যযাতি যেমন পুরুর যৌবন হরণ করে নিজের বার্ধক্য থেকে মুক্তি পান, তেমনই ফ্যাসিবাদী শাসকরা তরুণদের স্বপ্ন, শক্তি ও সম্ভাবনাকে নিজেদের সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করে তাদের জীবনকে অর্থহীন করে তোলে। এই কবিতাটি সেই তরুণ প্রজন্মের নীরব কান্না, যারা একনায়কতন্ত্রের বলি হয়।

•মানবিক মূল্যবোধ সংকটে কবিঃ আমরা জানি যে,সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন একজন মানবতাবাদী কবি।আর সেই দৃষ্টিতে তিনি ফ্যাসিবাদী মতাদর্শের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় দেখেছিলেন।তাই তিনি কবিতায় তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, যখন নৈতিকতা ও মানবিকতা পদদলিত হয়, তখন সমাজের কী পরিণতি হয়। ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থায় ব্যক্তিত্ব এর গুরুত্ব থাকে না।কেবল রাষ্ট্রের যন্ত্র হিসেবেই তাদের ব্যবহার করা হয়। যযাতির আচরণে সেই নির্মম, অমানবিক দিকটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

•সমাজের অস্থিরতা, নৈরাশ্যে কবিঃ যযাতি কবিতাটি শুধু ফ্যাসিবাদবিরোধী  কবিতা নয়, এটি আধুনিক যুগের অস্থিরতা, মূল্যবোধের সংকট এবং গভীর নৈরাশ্যকেও তুলে ধরে। যখন মানবতা বিপন্ন, তখন কবি দেখতে পান এক অন্ধকার ভবিষ্যৎ। এই কবিতায় এক ধরণের হতাশার সুর শোনা যায়, কারণ যযাতির মতো চরিত্রেরা সমাজে কেবল জন্ম দিতে পারে নৈরাশ্য ও ধ্বংসের।

•প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গিতে কবিঃ কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে সব সময় সোচ্চার ছিলেন। পাশাপাশি 'পরিচয়' পত্রিকার সম্পাদক হিসেবেও তিনি প্রগতিশীল চিন্তাভাবনা এবং মার্কসবাদী ভাবাদর্শ প্রচারের জন্য উন্মুক্ত ছিলেন। আসলে  ফ্যাসিবাদবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘের সঙ্গেও তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল।আর সেখানে 'যযাতি' কবিতাটি তাঁর এই রাজনৈতিক ও সামাজিক সচেতনতারই এক শক্তিশালী শিল্পরূপ।

                •পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে,যযাতি' কবিতায় সুধীন্দ্রনাথ দত্ত পৌরাণিক কাহিনির আড়ালে ফ্যাসিবাদী একনায়কতন্ত্রের অমানবিক রূপ, ক্ষমতার অন্ধ লালসা এবং মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়কে অত্যন্ত তীক্ষ্ণভাবে তুলে ধরেছেন। আর সেখানে এটি কেবল একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের বর্ণনা নয়, বরং  বলা যেতে পারে আধুনিক সভ্যতার এক গভীর সংকট ও অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে কবির দৃঢ় প্রতিবাদ স্বরূপ আলোচ্য কবিতা যযাতি।

Comments

Popular posts from this blog

দর্শন প্রথম সেমিস্টার সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তর।

দর্শন প্রথম সেমিস্টার সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, মাইনর সিলেবাস)  ১)চার্বাক মতে ভূত কয়টি ও কি কি? উত্তরঃচার্বাক মতে ভূত চারটি- ক্ষিতি, অপ্ , তেজ ও মরুৎ ২) স্বভাববাদ কী? উত্তরঃ চার্বাক জড়বাদের ভিত্তি হল স্বভাববাদ। যে মতবাদ অনুসারে স্বভাব থেকেই ভূত সৃষ্টি, আবার স্বভাব থেকেই বিচ্ছেদ। যার জন্য ঈশ্বরকে স্বীকার করা প্রয়োজন নেই। ৩) অব্যাপ্যদেশ কথাটির অর্থ লেখো। উত্তরঃ অব্যাপ্যদেশ বলতে বোঝায়- অশাব্দ অর্থাৎ যাকে শব্দের দ্বারা প্রকাশ করা যায় না। ৫) জ্ঞান লক্ষণ প্রত্যক্ষ কাকে বলে?  কোন একটি ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে তার নিজের বিষয়ীভূত গুণ ছাড়াও যদি অপর একটি ইন্দ্রিয়ের বিষয়ীভূত গুণকে প্রত্যক্ষ করার হয়, তাহলে সেই প্রত্যক্ষকে জ্ঞানলক্ষণ প্রত্যক্ষ বলা হয়। ৬) ন্যায় মতে প্রমাণের প্রকার  উত্তরঃ ন্যায় মতে প্রমাণ চার প্রকার। প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান এবং শাব্দ। ৭) সন্নিকর্ষ কাকে বলে? উত্তরঃ ন্যায় মতে ইন্দ্রিয় ও কোন বাস্তব পদার্থের মধ্যে একপ্রকার বিশেষ সম্পর্ক ঘটলে তবেই আমাদের একটি বস্তুর প্রত্যক্ষজ্ঞান ।আর ঐ বিশেষ বিশেষ সম্পর্কের পারিভাষিক নাম হলো সন...

ব্রিটিশ(3rd.Sem) পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব

ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব(পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় তৃতীয় সেমিস্টার রাষ্ট্রবিজ্ঞান মাইনর সিলেবাস)। ব্রিটেনের সংবিধান অলিখিত বলে বিভিন্ন ঐতিহাসিক দলিল, শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতি, পার্লামেন্ট প্রণীত আইন প্রভৃতির মাধ্যমে পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব অর্জিত হয়েছে। ব্রিটেনের পার্লামেন্ট আইনানুগ সার্বভৌমত্ব অর্জন করেছে, রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব নয়। আর সেখানে আইনানুগ সার্বভৌমত্ব বলা হয়, কারণ-       যেকোনো বিষয়ে পার্লামেন্ট আইন প্রণনয়নের অধিকারী। এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র হওয়ায় পার্লামেন্টে কোন আইন প্রণয়নের সময় প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় না। কমন্সসভা তথা নিম্নকক্ষের সার্বভৌমত্বকেই বলা হয় পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব।     ••ব্রিটিশ পার্লামেন্টকে সার্বভৌমত্ব বলার কারণ- ১) পার্লামেন্টের ওপর আইনগত কোনরূপ বাধানিষেধ আরোপ করা যায় না। ২) পার্লামেন্ট প্রণীত আইনের বৈধতার ব্যাপারে আদালত কোন প্রশ্ন তুলতে পারেনা। ব্রিটেনের আদালত পার্লামেন্ট প্রণীত আইনের ওপর বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার দ্বারা সীমিত করতে পারে না। ৩) ব্রিটিশ পার্লামেন্টের আইন প্রণয়ন ক্ষমতার উপর শাসনবিভাগ অনুরূপ ন...

ইতিহাস (3rd Semester) সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর।

 তৃতীয় সেমিস্টার ইতিহাস মাইনর সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, তৃতীয় সেমিস্টার ইতিহাস মাইনর)। ১)বন্দেগান-ই-চাহালগানি বলতে কী বোঝায়? •উত্তরঃবন্দেগান-ই-চাহালগান বলতে চল্লিশ জন তুর্কি ও অ-তুর্কি দাসদের সমন্বয়ে গঠিত একটি বাহিনীকে বোঝায়। এই বাহিনীকে ডাল চালিশা বা তুরকান-ই- চাহালগানি নামে ডাকা হতো। ২)আমির খসরু কে ছিলেন? •উত্তরঃ আমির খসরু ছিলেন প্রখ্যাত সুফি সাধক বা আরেফ নিজামউদ্দিন আওলিয়ার ছাত্র এবং অন্যতম প্রধান খলিফা। যাঁকে 'ভারতের তোতা' উপাধি দেওয়া হয়েছিল। ৩) মহরানা প্রতাপ কে ছিলেন?  •উত্তরঃ মেবারের শিশোদিয়া রাজবংশের একজন হিন্দু রাজপুত রাজা ছিলেন মহারানা প্রতাপ সিং। যিনি রাজপুতদের বীরত্ব ও দৃঢ় সংকল্পের প্রতীক। বহু বছর ধরে তিনি মুঘল সম্রাট আকবরের সঙ্গে লড়াই করেন। ৪) জায়গীরদারী সংকট কী? •উত্তরঃ জায়গিরদারী সংকট ছিল মোগল সাম্রাজ্যের একটি অর্থনৈতিক সংকট। এই সংকটে জমি বা জায়গিরের অভাব দেখা দিয়েছিল। যার ফলে প্রশাসনিক খরচ মেটানো এবং যুদ্ধের খরচ বহন করা সম্ভব হতো না। ৫) দাক্ষিণাত্য ক্ষত কী? •উত্তরঃ দাক্ষিণাত্য ক্ষত বলতে ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীত...