Skip to main content

ভাড়ুদত্ত চরিত্রটি চন্ডিমঙ্গল কাব্যের আখেটিক খন্ডে একটি ধূর্ত, চতুর, ঘৃণ্য ও প্রতারক-আলোচনা করো।

ভাড়ুদত্ত চরিত্রটি চন্ডিমঙ্গল কাব্যের আখেটিক খন্ডে একটি ধূর্ত, চতুর, ঘৃণ্য ও প্রতারক-আলোচনা করো।

            আলোচনার শুরুতেই আমরা বলে রাখি যে,চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের আখেটিক খণ্ড বা ব্যাধ খণ্ড চণ্ডীদেবীর মহিমা প্রচারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।যে খণ্ডে দেবী চণ্ডীর হাতে ভাড়ুদত্ত নামক এক দুষ্ট ও ধূর্ত চরিত্রের বিনাশ ঘটে।আর এই ভাড়ুদত্ত চরিত্রটি চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের একটি অত্যন্ত ঘৃণ্য অথচ স্মরণীয় চরিত্র।সেই চরিত্রটিতে আমরা দেখি যে-ভাড়ুদত্ত একজন ব্রাহ্মণ হলেও তার কর্ম ছিল অত্যন্ত নিন্দনীয়। আর সেই চরিত্রটির আখেটিক খন্ডে বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য আমরা দেখতে পাই।আর সেই বৈশিষ্ট্যগুলি হলো -

 ভাড়ুদত্ত প্রতারক ও ধূর্ত ব্যাক্তিঃ ভাড়ুদত্ত নীচ এবং অসৎ চরিত্রের অধিকারী। শুধু তাই নয়,সে একজন চরম ধূর্ত ও চতুর ব্যক্তি।যে মিষ্ট কথায় মানুষকে ভুলিয়ে নিজের  স্বার্থসিদ্ধি করতে অসাধারণ পটু ছিলেন। এ ছাড়াও শিকারীদের কাছ থেকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে তাদের ঠকাতো এবং তাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে নিজের মনোবাঞ্ছা পরে নিতে।

 ভাড়ুদত্ত মিথ্যাবাদী এবং কুচক্রীঃ ভাড়ুদত্তের চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল- সত্য গোপন করা ও মিথ্যাচার করা ছিল তার স্বভাব। সে যেকোনো সময়ে শিকারীদের বিপদে ফেলত এবং তাদের বিরুদ্ধে নানা রকম কুচক্র করত। শুধু তাই নয়, দেবী চণ্ডীর মহিমা ও তাঁর অস্তিত্বকে সে মেনে না নিয়ে তাঁকে উপহাস ও অস্বীকার করত।

 ভাড়ুদত্ত প্রবল অহংকারী ও দাম্ভিকঃ ভাড়ুদত্ত নিজের সামান্য ক্ষমতা নিয়েই সে অত্যন্ত অহংকারী ছিল। এই অহংবোধ ছিল তার চরিত্রের অন্যতম সম্পদ। তাই সে মনে করত যে, সে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং তার চেয়ে বুদ্ধিমান ব্যক্তি এ দুনিয়ায় আর কেউ নেই। এই অহংকারবোধই তাকে দেবীর বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেয়।

ভাড়ুদত্ত হিংসাশ্রয়ী ও পরশ্রীকাতরঃ  ভাড়ুদত্ত কখনই অন্যের ভালো সহ্য করতে পারত না বা মেনে নিতে পারত না। আর এখানে বিশেষ করে বলা যায় যে, ব্যাধ কালকেতু যখন দেবীর কৃপায় ধনসম্পদের অধিকারী হয়, তখন ভাড়ুদত্ত তার প্রতি অত্যন্ত হিংসা পোষণ করে। শুধু তাই নয়,কালকেতুর সহসা উন্নতিতে সে ঈর্ষান্বিত হয়ে তাকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে।

ভাড়ুদত্ত শোষক ও অত্যাচারীঃ ভাড়ুদত্ত প্রতিনিয়ত দুর্বল ও অসহায়দের উপর অত্যাচার করে দিনযাপনে অভ্যস্ত ছিল।সে শিকারীদের কাছ থেকে জোর করে অর্থ আদায় করত এবং সেই সাথে তাদের চরমভাবে শোষণ করত। পাশাপাশি আবার প্রজাদের উপর তার অত্যাচার চরমে পৌঁছে যেত।

 ভাড়ুদত্ত কাপুরুষের নামান্তরঃ  ভাড়ুদত্ত নিজেকে খুব শক্তিশালী মনে করত। প্রকৃতপক্ষে সে ছিল একজন কাপুরুষ। বিপদে পড়লে সে নিজের জীবন বাঁচাতে যে কোনো নীচ কাজ করে বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার পথ খুঁজে নিতে সক্ষম হয়।

আখেটিক খণ্ডে ভাড়ুদত্তের ভূমিকা:

আমরা জানি যে, চন্ডিমঙ্গল কাব্যের আখেটিক খণ্ডে ভাড়ুদত্তের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সে দেবী চণ্ডীর অলৌকিক ক্ষমতাকে অস্বীকার করে এবং কালকেতু ও তার স্ত্রী ফুল্লরার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে। শুধু তাই নয় -

 কালকেতুর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ভাড়ুদত্তঃ কালকেতু যখন দেবী চণ্ডীর বরে ধনবান হয় এবং গুজরাট নগরী পত্তন করে, তখন ভাড়ুদত্ত তার উন্নতিতে প্রবলভাবে ঈর্ষান্বিত হয়। আর এই ঈর্ষার বশবর্তী হয়ে কালকেতুর বিরুদ্ধে নানা রকম মিথ্যা অভিযোগ করে এবং তাকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করে।

 মিথ্যা অভিযোগকারী ভাড়ুদত্তঃ ভাড়ুদত্ত রাজার কাছে কালকেতুর বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করে যে, কালকেতু একজন দস্যু এবং সে প্রজাদের উপর প্রবলভাবে অত্যাচার করছে। শুধু তাই নয়,সে কালকেতুর বিরুদ্ধে নানা রকম অপপ্রচার চালায়-যাতে রাজা কালকেতুকে শাস্তি দেন এবং তার পদস্খলন হয়।

 ভাড়ুদত্ত পাপের প্রতীকঃ  ভাড়ুদত্ত চরিত্রটি চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে সমস্ত অশুভ শক্তির প্রতীক। তার চরিত্রের মাধ্যমে কবি সমাজে বিদ্যমান দুর্নীতি, শোষণ এবং মিথ্যাচারের চিত্র তুলে ধরেছেন। অবশেষে সে দেবী চণ্ডীর ক্রোধের কারণ হয়ে ওঠে। যারফলে তার পরিণতি অতি ভয়ংকর হয়ে ওঠে। আর সেই ভয়ংকর রূপের মধ্যে তাকে তার জীবনের সব পাপের ফল ভোগ করতে হয়। যেখানে কালকেতুকে প্রতিনিয়ত অপদস্ত করার কারণে তার জীবনের নেমে আসে চরম বিনাশ। যেটি ছিল তার পাপ,কুকর্মের ফল। সমাজের সকল অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটে জাগরিত হয় শুভ শক্তির বিজয় উৎসব।

            পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে,ভাড়ুদত্ত চরিত্রটি চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের পাপ ও অন্যায়ের প্রতীক হিসেবে কবি তুলে ধরেছেন। তার ধ্বংসের মাধ্যমে দেবী চণ্ডীর মহিমা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সমাজে ন্যায় ও ধর্ম পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। এই চরিত্রটি মঙ্গলকাব্যের অন্যতম প্রধান একটি পার্শ্বচরিত্র যা কাহিনীকে এগিয়ে নিয়ে যেতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং এই চরিত্রটির অবতারণা নিঃসন্দেহে আবশ্যিক ছিল।

Comments

Popular posts from this blog

দর্শন প্রথম সেমিস্টার সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তর।

দর্শন প্রথম সেমিস্টার সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, মাইনর সিলেবাস)  ১)চার্বাক মতে ভূত কয়টি ও কি কি? উত্তরঃচার্বাক মতে ভূত চারটি- ক্ষিতি, অপ্ , তেজ ও মরুৎ ২) স্বভাববাদ কী? উত্তরঃ চার্বাক জড়বাদের ভিত্তি হল স্বভাববাদ। যে মতবাদ অনুসারে স্বভাব থেকেই ভূত সৃষ্টি, আবার স্বভাব থেকেই বিচ্ছেদ। যার জন্য ঈশ্বরকে স্বীকার করা প্রয়োজন নেই। ৩) অব্যাপ্যদেশ কথাটির অর্থ লেখো। উত্তরঃ অব্যাপ্যদেশ বলতে বোঝায়- অশাব্দ অর্থাৎ যাকে শব্দের দ্বারা প্রকাশ করা যায় না। ৫) জ্ঞান লক্ষণ প্রত্যক্ষ কাকে বলে?  কোন একটি ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে তার নিজের বিষয়ীভূত গুণ ছাড়াও যদি অপর একটি ইন্দ্রিয়ের বিষয়ীভূত গুণকে প্রত্যক্ষ করার হয়, তাহলে সেই প্রত্যক্ষকে জ্ঞানলক্ষণ প্রত্যক্ষ বলা হয়। ৬) ন্যায় মতে প্রমাণের প্রকার  উত্তরঃ ন্যায় মতে প্রমাণ চার প্রকার। প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান এবং শাব্দ। ৭) সন্নিকর্ষ কাকে বলে? উত্তরঃ ন্যায় মতে ইন্দ্রিয় ও কোন বাস্তব পদার্থের মধ্যে একপ্রকার বিশেষ সম্পর্ক ঘটলে তবেই আমাদের একটি বস্তুর প্রত্যক্ষজ্ঞান ।আর ঐ বিশেষ বিশেষ সম্পর্কের পারিভাষিক নাম হলো সন...

ব্রিটিশ(3rd.Sem) পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব

ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব(পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় তৃতীয় সেমিস্টার রাষ্ট্রবিজ্ঞান মাইনর সিলেবাস)। ব্রিটেনের সংবিধান অলিখিত বলে বিভিন্ন ঐতিহাসিক দলিল, শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতি, পার্লামেন্ট প্রণীত আইন প্রভৃতির মাধ্যমে পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব অর্জিত হয়েছে। ব্রিটেনের পার্লামেন্ট আইনানুগ সার্বভৌমত্ব অর্জন করেছে, রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব নয়। আর সেখানে আইনানুগ সার্বভৌমত্ব বলা হয়, কারণ-       যেকোনো বিষয়ে পার্লামেন্ট আইন প্রণনয়নের অধিকারী। এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র হওয়ায় পার্লামেন্টে কোন আইন প্রণয়নের সময় প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় না। কমন্সসভা তথা নিম্নকক্ষের সার্বভৌমত্বকেই বলা হয় পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব।     ••ব্রিটিশ পার্লামেন্টকে সার্বভৌমত্ব বলার কারণ- ১) পার্লামেন্টের ওপর আইনগত কোনরূপ বাধানিষেধ আরোপ করা যায় না। ২) পার্লামেন্ট প্রণীত আইনের বৈধতার ব্যাপারে আদালত কোন প্রশ্ন তুলতে পারেনা। ব্রিটেনের আদালত পার্লামেন্ট প্রণীত আইনের ওপর বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার দ্বারা সীমিত করতে পারে না। ৩) ব্রিটিশ পার্লামেন্টের আইন প্রণয়ন ক্ষমতার উপর শাসনবিভাগ অনুরূপ ন...

ইতিহাস (3rd Semester) সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর।

 তৃতীয় সেমিস্টার ইতিহাস মাইনর সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, তৃতীয় সেমিস্টার ইতিহাস মাইনর)। ১)বন্দেগান-ই-চাহালগানি বলতে কী বোঝায়? •উত্তরঃবন্দেগান-ই-চাহালগান বলতে চল্লিশ জন তুর্কি ও অ-তুর্কি দাসদের সমন্বয়ে গঠিত একটি বাহিনীকে বোঝায়। এই বাহিনীকে ডাল চালিশা বা তুরকান-ই- চাহালগানি নামে ডাকা হতো। ২)আমির খসরু কে ছিলেন? •উত্তরঃ আমির খসরু ছিলেন প্রখ্যাত সুফি সাধক বা আরেফ নিজামউদ্দিন আওলিয়ার ছাত্র এবং অন্যতম প্রধান খলিফা। যাঁকে 'ভারতের তোতা' উপাধি দেওয়া হয়েছিল। ৩) মহরানা প্রতাপ কে ছিলেন?  •উত্তরঃ মেবারের শিশোদিয়া রাজবংশের একজন হিন্দু রাজপুত রাজা ছিলেন মহারানা প্রতাপ সিং। যিনি রাজপুতদের বীরত্ব ও দৃঢ় সংকল্পের প্রতীক। বহু বছর ধরে তিনি মুঘল সম্রাট আকবরের সঙ্গে লড়াই করেন। ৪) জায়গীরদারী সংকট কী? •উত্তরঃ জায়গিরদারী সংকট ছিল মোগল সাম্রাজ্যের একটি অর্থনৈতিক সংকট। এই সংকটে জমি বা জায়গিরের অভাব দেখা দিয়েছিল। যার ফলে প্রশাসনিক খরচ মেটানো এবং যুদ্ধের খরচ বহন করা সম্ভব হতো না। ৫) দাক্ষিণাত্য ক্ষত কী? •উত্তরঃ দাক্ষিণাত্য ক্ষত বলতে ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীত...