দ্রব্য(Substance)সম্পর্কে বুদ্ধিবাদী দার্শনিকদের মতামত আলোচনা করো (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, দ্বিতীয় সেমিস্টার মাইনর, দর্শন)।
•আলোচনা শুরুতেই আমরা বলে রাখি যে, পাশ্চাত্য দর্শনে দ্রব্য সম্পর্কে বুদ্ধিবাদী দার্শনিকদের মতামত বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তবুও তাদের মতামতের মধ্যে বেশ কিছু ভিন্নতাও লক্ষ্য করা যায়। আর সেইসকল বুদ্ধিবাদী দার্শনিকরা হলেন- দেকার্ত,স্পিনোজা এবং লাইবনিজ।এই সকল দার্শনিকরা প্রত্যেকেই দ্রব্য সম্পর্কে নিজস্ব ধারণা পোষণ করছেন। বলা যায় যে, এই সকল ধারণা যা সামগ্রিক দার্শনিক ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করেছিল।আর সেখানে বুদ্ধিবাদী দার্শনিক
১) দেকার্তের মতে দ্রব্যঃ দেকার্তকে আধুনিক দর্শনের জনক বলা হয়। আর তিনি 'দ্রব্য' বলতে এমন একটি সত্তা বোঝান, যার অস্তিত্বের জন্য অন্য কোনো কিছুর প্রয়োজন হয় না। আসলে তাঁর মতে-"কেবল ঈশ্বরই একমাত্র দ্রব্য"। তবে, তিনি এই ধারণাটি সৃষ্ট বস্তুর ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করেন।যাদের অস্তিত্বের জন্য কেবল ঈশ্বরের সাহায্য প্রয়োজন। এক্ষেত্রে দেকার্ত 'দ্রব্য দ্বৈতবাদ' এর প্রবক্তা। তার মতে, দ্রব্য দুই প্রকার-
১) চিন্তাশীল দ্রব্য ২) বিস্তারশীল দ্রব্য। তবে সেই সকল দ্রব্য গুলি একে অপরের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।
১) চিন্তাশীল দ্রব্যঃ চিন্তাশীল দ্রব্য হলএটি হল মন বা আত্মা। যার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল চিন্তা করা বা সচেতনতা। তবে এটি অবিভাজ্য এবং এর কোনো বিস্তার নেই। কিন্তু-
২) বিস্তারশীল দ্রব্যঃ বিস্তারশীল দ্রব্য হল বস্তু বা শরীর। এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হল বিস্তার বা স্থান দখল করা। এটি বিভাজ্য এবং এর কোনো চিন্তা করার ক্ষমতা নেই। আসলে-
দেকার্তের মতে-মন এবং শরীর দুটি ভিন্ন দ্রব্য।যে দ্রব্য দুটি তাদের বৈশিষ্ট্য এবং অস্তিত্বের জন্য একে অপরের উপর নির্ভরশীল নয়। মানুষের মধ্যে এই দুটি দ্রব্য একে অপরের সাথে কীভাবে মিথস্ক্রিয়া করে, তা ব্যাখ্যা করা ছিল দেকার্তের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
২) স্পিনোজার মতে দ্রব্যঃস্পিনোজা দেকার্তের দ্বৈতবাদকে প্রত্যাখ্যান করেন। তার মতে-এই মহাবিশ্বে শুধুমাত্র একটিই দ্রব্য আছে। আর সেই দ্রব্যটি অসীম, অবিভাজ্য এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ। সেই দ্রব্যটিই হল ঈশ্বর বা প্রকৃতি।আসলে-
•স্পিনোজার দ্রব্য ধারণাটি দেকার্তের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। স্পিনোজার মতে-'দ্রব্য হল এমন কিছু, যা নিজের মধ্যে থাকে এবং নিজের মাধ্যমে বোঝা যায়।'। তবে এটি অন্য কোনো কিছুর ধারণার উপর নির্ভরশীল নয়।তাই স্পিনোজা মনে করেন, এই একমাত্র দ্রব্যের অসীম সংখ্যক গুণ রয়েছে, যার মধ্যে আমরা দুটি গুণ সম্পর্কে জানতে পারি। আর সেই দুটি গুন হল চিন্তা ও বিচার। সেখানে চিন্তা মানসিক জগতের ভুল এবং বিস্তার হলো ভৌত জগতের গুন। তবে -
স্পিনোজার মতে, মন এবং শরীর দুটি ভিন্ন দ্রব্য নয়, বরং একই দ্রব্যের দুটি ভিন্ন গুণ বা দিক। মানুষ, গাছ, পাথর—এগুলো সবই সেই একমাত্র দ্রব্যের 'পদ্ধতি'বা রূপান্তর মাত্র। অর্থাৎ, কোনো ব্যক্তি বা বস্তুকে পৃথক দ্রব্য হিসেবে দেখা যায় না, বরং তারা অসীম দ্রব্য ঈশ্বরেরই অংশ।
৩) লাইবনিজের মতে দ্রব্যঃলাইবনিজ দেকার্তের দ্বৈতবাদ এবং স্পিনোজার একাত্মবাদকে প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁর মতে, দ্রব্য হলো- অসংখ্য, সরল এবং অবিভাজ্য সত্তা, যাদেরকে তিনি 'মনাড'বলেন। তবে-
•'মনাড' হল এক ধরনের আধ্যাত্মিক বা মানসিক শক্তি। তাদের কোনো বিস্তার নেই, তাই তারা স্থান দখল করে না। প্রতিটি মনাড হল এক একটি স্বতন্ত্র জগত, যা নিজের মধ্যে সম্পূর্ণ। তারা 'জানালাবিহীন সত্তা',যারা একে অপরের সাথে সরাসরি মিথস্ক্রিয়া করে না। আসলে-
•লাইবনিৎস বিশ্বাস করতেন যে, মনাডগুলির মধ্যে একটি 'পূর্ব-প্রতিষ্ঠিত সাদৃশ্য'রয়েছে, যা ঈশ্বর কর্তৃক নির্ধারিত। এই সাদৃশ্য এমনভাবে তৈরি হয়েছে যে, প্রতিটি মোনাড তার নিজস্ব অভ্যন্তরীণ নীতির মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়, কিন্তু সেই পরিবর্তনগুলো অন্য মোনাডের পরিবর্তনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তার মতে এই মনাডগুলি থেকে সমস্ত যৌগিক দ্রব্য গঠিত হয়।যেমন,আমাদের শরীর মনাড দিক গঠিত। তবে সেখানে -
•দেকার্ত, স্পিনোজা এবং লাইবনিজ বুদ্ধিবাদী দার্শনিকের মধ্যে 'দ্রব্য' সম্পর্কে গভীর মতপার্থক্য থাকলেও, তারা সকলেই তাদের দার্শনিক ব্যবস্থার কেন্দ্রে এই ধারণাকে স্থান দিয়েছিলেন। তাই তাদের ধারণাগুলো আধুনিক অধিবিদ্যার আলোচনায় তাদের দেওয়া তথ্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে।
Comments
Post a Comment